রাজ পরিবারের সমালোচক তিন রাজপুত্রের হদিস আছে কি?

প্রকাশিত: ১২:৫৬ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৫, ২০১৮

শাহূর শাহীন: ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ইউরোপে বসবাসরত তিনজন সৌদি রাজপুত্র নিখোঁজ হয়ে যান যাদের প্রত্যেকেই সৌদি সরকারের সমালোচক ছিলেন।

সৌদি রাজপরিবারে সমালোচক আমেরিকায় স্বেচ্চা নির্বাসিত সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার পর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। প্রশ্ন উঠছে তবে কি তাদেরও একই পরিণিতি বরণ করতে হয়েছে।

সৌদি আরবের রাজ পরিবারের সমালোচনাকারী স্বেচ্ছা নির্বাসিত সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে গত ২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলের সৌদি কন্স্যুলেটে হত্যা করা হয়।

বিষয়টি প্রথম দিকে সৌদি সরকার অস্বীকার করলেও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ১৭ অক্টোবর তা স্বীকার করে।

তুরস্কের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমানের নির্দেশেই খাশোগিকে হত্যা করা হয়েছে।

এমনকি খাশোগিকে নির্মামভাবে হত্যার পর তার লাশ টুকরো টুকরো করে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তুর্কি গণমাধ্যম এও বলেছে সৌদি কনস্যুলেটের ভিতরেই পাওয়া গেছে তার লাশের খন্ডিত একটি টুকরো।

রাজপুত্র তুর্কি বিন বান্দার, সুলতান বিন তুর্কি বিন আব্দুল আজিজ, রাজপুত্র সউদ বিন সাইফ আল-নাসের

তাদের তিনজনকেই অপহরণ করে সৌদি আরবে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছিলো- এমন প্রমাণও রয়েছে। আর অপহরণের পর থেকে তাদের সম্পর্কে আর কিছু জানা যায়নি।

রাজপুত্র তুর্কি বিন বান্দার

একসময় সৌদি পুলিশের একজন মেজর ছিলেন রাজপুত্র তুর্কি বিন বান্দার। যিনি রাজপরিবারের সদস্যদের পুলিশি সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

কিন্তু উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্বে পরিবারের সদস্যদের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পরলে একসময় তাকে কারাদণ্ডও দেয়া হয়।

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ২০১২ সালে প্যারিসে চলে যান তিনি। সেখানে গিয়েই সৌদি আরবের সংস্কার চেয়ে ইউটিউবে ধারাবাহিক ভিডিও পোস্ট করা শুরু করেন রাজপুত্র তুর্কি বিন বান্দার।

২০০৩ সালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে যুবরাজ তুর্কি বিন বান্দার

রাজপুত্র সুলতানের মত তুর্কিকেও আলোচনার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে সৌদি কর্তৃপক্ষ। তবে রাজপুত্র তুর্কির মন গলাতে পারেনি সৌদি সরকারি কর্মকর্তারা। তুর্কি ফিরে যাননি সৌদি আরব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা হয়নি। তাকেও গুম হতে হয়।

২০১৫ সালের জুলাই মাসে সর্ব শেষ ইউটিউবে ভিডিও পোস্ট করেন তুর্কি বিন বান্দার। এরপর বছরের শেষদিকে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যান তিনি। তারপর এখন পর্যন্ত রাজপুত্র তুর্কি বিন বান্দার এর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

সুলতান বিন তুর্কি বিন আব্দুল আজিজ

২০০৩ সালের ১২ই জুন সকালের ঘটনা। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের বাইরে একটি প্রাসাদে ঢুকতে দেখা যায় একজন সৌদি রাজপুত্র সুলতান বিন তুর্কি বিন আব্দুল আজিজকে।

বাদশাহ ফাহাদের ছেলে রাজপুত্র আবদুল আজিজ বিন ফাহাদের সাথে সকালের নাস্তা খেতে প্রাসাদে যান সুলতান।

নাস্তার আলাপচারিতায় একপর্যায়ে সুলতানকে নিজ দেশ সৌদি আরবে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন আব্দুল আজিজ। সঙ্গে ছিলেন সৌদি আরবের ইসলাম ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী শেখ সালেহ আল-শেখ।

সুলতান ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানালে আব্দুল আজিজ ওই কক্ষ থেকে বের হয়ে কাউকে ফোন করেন। মন্ত্রী শেখ সালেহ আল-শেখও বের হয়ে যান সেখান থেকে।

এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই মুখোশ পরা কয়েকজন ঘরে ঢুকে এবং সুলতানকে চেতনাহীন করে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়।

অজ্ঞান অবস্থাতেই সুলতানকে জেনেভা বিমানবন্দরে নেয়া হয় এবং সেখানে অপেক্ষারত একটি বিমানে ওঠানো হয় তাঁকে।

জেনেভার ওই হোটেলে থাকা সুলতানের সঙ্গীসাথীদের জানানো হয় যে সুলতানকে রিয়াদ নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাই তাদের আর কোনো প্রয়োজন নেই।

সঙ্গীদের সাথে যুবরাজ সুলতান বিন তুর্কি (মাঝে)

অনেক বছর পর সুইজারল্যান্ডের একটি আদালতে ঠিক এভাবেই সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করছিলেন সুলতান।

সৌদি আরবে ফেরত গিয়ে সুলতানের ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা জানা না গেলেও এটা জানা যায় তাকে কারাগারে এবং কিছু সময় নিজ বাড়িতে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো ।

দীর্ঘসময় কারাগারে এবং বাড়িতে আটক থাকার পর সুলতানের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে সম্মত হয় রাজপরিবার।

২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে সুইস আদালতে আব্দুল আজিজ বিন ফাহাদ এবং শেখ সালেহ আল-শেখ এর বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করেন সুলতান।

প্রথমবার কোনো সৌদি রাজপরিবারের সদস্যের আরেক রাজপরিবারের সদস্যের বিরুদ্ধে পশ্চিমা আদালতে মামলা দায়েরের ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। সেখান থেকে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ইউরোপ যান সুলতান।

চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ইউরোপে পৌঁছানোর পর থেকেই সৌদি সরকারের সমালোচনা করে বিভিন্ন ইউরোপিয় গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে শুরু করেন সুলতান।

তার সাক্ষাৎকারে রাজপরিবারের সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন তিনি।

কিন্তু এরপর ২০১৬ সালে সুলতান এবং তাঁর ১৮ জন সফরসঙ্গীকে প্যারিস থেকে কায়রো নিয়ে যাওয়া হবে বলে একটি বিমানে উঠিয়ে রিয়াদে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে আর কোনে খোঁজ পাওয়া যায়নি সুলতান বিন তুর্কির।

রাজপুত্র সউদ বিন সাইফ আল-নাসের

রাজপুত্র তুর্কি নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কাছাকাছি সময় একই ধরণের পরিণতি হয় আরেক রাজপুত্রসউদ বিন সাইফ আল-নাসেরের।

ইউরোপে বিলাসবহুল জীবনযাপনে উৎসাহী ছিলেন এই রাজপুত্র। ২০১৪ সাল থেকে টুইটারে সৌদি রাজতন্ত্রের সমালোচনা করে পোস্ট দেয়া শুরু করেন সৌদ বিন সাইফ।

পরের বছর বাদশাহ সালমানকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে অজ্ঞাতনামা একজন সৌদি রাজপুত্রের লেখা দু’টি চিঠি ফাঁস হলে ঐ যুবরাজের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন সৌদ।

যুবরাজ সউদ বিন সাইফ আল-নাসের

এক টুইটে ঐ চিঠির বিষয়বস্তুকে গুরুত্বের সাথে নিতে সৌদি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান সৌদ বিন সাইফ। এর কিছুদিন পর থেকে তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্টটি নিরব হয়ে যায়। সেই সাথে নিরব হয়ে যায় সৌদ বিন সাইফ আল নাসেরও।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক বৈঠকের কথা বলে কৌশলে সৌদকে বিন সাইফকে রিয়াদে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। এমনটাই ধারণা জার্মানিতে পালিয়ে যাওয়া আরেকজন সৌদি রাজপুত্র খালেদ বিন ফারহানের

রাজপুত্র খালেদ বিন ফারহান বলেন, সৌদি রাজতন্ত্রের সমালোচনা করা আমার চারজনই ইউরোপে ছিলাম। যাদের মধ্যে আমি বাদে বাকী তিনজনকেই অপহরণ করা হয়েছে।

রাজপুত্র খালেদ বিন ফারহান আশঙ্কা করছেন নিকট ভবিষ্যতে তাঁকেও অপহরণ করা হতে পারে।

তথ্যসুত্র বিবিসি বাংলা

/আরএ

Comments