ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ছাড়া যুদ্ধ শেষ হওয়ার নয়

প্রকাশিত: ১২:২৬ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১০, ২০২৩

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সম্প্রতি ইসরায়েলে আকস্মিক এবং নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। কোনো কোনো জায়গায় হামাস সদস্যরা ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। হামাসের এই হামলায় হতচকিত হয়ে পড়েছে ইসরায়েলসহ পশ্চিমারা। হামাসের রকেট হামলার বিপরীতে ফিলিস্তিনের গাজায় ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। দুই দিনের সংঘর্ষে ১ হাজার ২শ এর বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, যার মধ্যে ৭০০ এর বেশি ইসরায়েলি নাগরিক রয়েছে। দীর্ঘ প্রস্তুতির পর হামাস এ হামলা চালিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

হামাসের সাম্প্রতিক এ হামলায় বিশ্বব্যাপী নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিষয়টিকে আমি তিনভাবে দেখছি। প্রথমত, দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের ভেতরেই সরকারের বিরুদ্ধে একটি অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জুডিশিয়াল রিফর্ম নিয়ে গোটা ইসরায়েলজুড়ে বড় ধরনের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। এমনকি প্যালেস্টাইনের ভূমি দখল করে নতুন বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধেও প্রচুর জনমত তৈরি হচ্ছিল ইসরায়েলের মধ্যেই। অনেক ইসরায়েলি এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। তারা অসন্তোষ প্রকাশ করছিলেন।

আমরা আগেও দেখেছি, বিভিন্ন সময়ে ইসরায়েল তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হামাসকে একটি অজুহাত হিসেবে দাঁড় করায়। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিভাজনকে ভেঙে তারা একটি একক মতের পথে জনগণকে নিয়ে আসতে চায়। তারা দেখাতে চায়, ইসরায়েল বড় হুমকির মধ্যে রয়েছে, দেশের সব মানুষের এই হুমকি মোকাবিলায় সরকারের পাশে থাকা উচিত এবং সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া উচিত। ইসরায়েল সরকার যে বিভিন্ন সময়ে ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের উপরে হামলা চালিয়ে দেশে তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে চায় তা আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি।

আমেরিকায় ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ।

যদি আমরা ফিলিস্তিনের দিক থেকে দেখি, তাহলে এই যুদ্ধটা তাদের জন্য একেবারেই নতুন নয়। ফিলিস্তিনিরা বছরের পর বছর ইসরায়েলি আক্রমণের মধ্যে রয়েছে। তবে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে আক্রমণটা এবার নতুন। ফিলিস্তিনি নিরীহ সাধারণ মানুষ বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলি হামলার শিকার হলেও আন্তর্জাতিক মহল তাতে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। ইসরায়েলের সব আক্রমণের ব্যাপারে একেবারে চুপ থেকেছে আন্তর্জাতিক মহল। কিন্তু এবার যেহেতু ইসরায়েলের মাটিতে পাল্টা আঘাত হেনেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামীরা তাই এবার সবার দৃষ্টি ফিলিস্তিন ইজরায়েলের দিকে।

অনেকে মনে করেছিলেন, জুডিশিয়াল রিফর্মকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নেতানিয়াহুর দিন বুঝি ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু হামাসের হামলার পর ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে আবারও নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চাচ্ছেন নেতানিয়াহু। তিনি এখানে কতটুকু সফল হবেন সেটা পরের বিষয়।

ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাইরের দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, আমেরিকা অতীতের মতো আবারও ইসরায়েলকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা দেবে। আমেরিকার অভ্যন্তরে ইসরায়েলকে সহযোগিতা দিয়ে যাওয়ার বিষয়ে যে সমালোচনা উঠেছিল সেটা আবারও ঢাকা পড়বে। হামাসের এই হামলার পর সেসব সমালোচনাকারীরা চুপ হয়ে যাবে। আমেরিকা ইতোমধ্যেই অস্ত্র এবং যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে ইসরায়েলের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। অর্থাৎ আমেরিকার মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স যারা সব সময় যুদ্ধ বাধানোর জন্য সচেষ্ট থাকে তারা আরও একটি সুযোগ পেল তাদের পথের বাধা দূর করতে। কারণ আমেরিকার মধ্যেই আমেরিকার সামরিক বাজেট কমানোর ব্যাপারে অনেক কথা উঠছিল। এখন হয়তো মিলিটারি বাজেট কমার পরিবর্তে স্বাভাবিক অবস্থার থেকে আরও বেড়ে যেতে পারে।

তৃতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যে যে নতুন ধরনের রাজনীতি শুরু হয়েছে সেটাকে নস্যাৎ করা এই সংঘাতের পেছনে একটি উদ্দেশ্য হতে পারে। আমরা দেখেছি চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সেটি আমেরিকা এবং ইসরায়েলের পছন্দ হওয়ার কথা নয়। এটি আমেরিকার কূটনীতির একটি ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়েছিল। যদিও আমেরিকা চেষ্টা করছে সৌদি আরব এবং ইসরায়েলকে একটি চুক্তির মধ্যে নিয়ে আসতে।

ঢাবি শিক্ষার্থীদের ব্যানারে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ফিলিস্তিন সংহতি সমাবেশ।

চীনের মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশ এবং সৌদি আরবের সঙ্গে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর যেমন সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন দেশগুলোর মধ্যে সমঝোতা চিন্তিত করছিল ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রকে। হামাসের এই হামলার মাধ্যমে সেই সম্ভাবনাটাকেও হয়তো খণ্ডন করতে চাইবে তারা। এখন সবাই দেখতে চাইবে চীন এবং রাশিয়া কী পদক্ষেপ নেয়? তারা কি সরাসরি ফিলিস্তিনের পক্ষ নিবে না কি দূরে থাকবে। এই সংঘাতের মাধ্যমে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে তার বিশাল অবস্থান পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করবে। মধ্যপ্রাচ্যে যে নতুন রাজনীতির শুরু হয়েছিল সেটাও তারা থামানোর চেষ্টা করবে।

উপরের ৩টা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেখা দরকার যুদ্ধের ফলাফলটা কোন দিকে যাচ্ছে। এটা খুবই দুঃখের বিষয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে মানবাধিকারবিষয়ক ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো শুধু ইসরায়েলের পক্ষেই কথা বলে। ইসরায়েলে আক্রমণ হয়েছে এটা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ফলাও করে প্রচার করছে। কিন্তু ফিলিস্তিন যে প্রতিদিন এই ধরনের আক্রমণের শিকার হচ্ছে এবং হয়ে এসেছে তা নিয়ে তাদের কোনো তৎপরতা নেই। তবে আমার মনে হয়, এই যুদ্ধের মাধ্যমে হয়ত স্বাধীন ফিলিস্তিনের যে দাবি সেটা মেনে নেওয়ার একটি বিষয় সামনে আসতে পারে। আজ মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থানই বলে দেবে তারা সত্যিকার অর্থে মানবাধিকার চায় না কি তাদের এই চাওয়াটা খুবই সিলেক্টিভ।

তাদের এই চাওয়াটা যদি সিলেক্টিভই হয়ে থাকে তাহলে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সমস্যাটা আরও বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের জন্য তা আরও অনেক কষ্ট বয়ে আনবে। এতদিন ধরে ফিলিস্তিনের ওপর যে আক্রমণ হয়ে এসেছে। ফিলিস্তিন এবার দেখাতে পেরেছে, প্রয়োজন হলে তারাও বড় আকারের ক্ষতি করতে পারে। ফিলিস্তিনিদের স্বপ্ন যে স্বাধীনতা সেদিকে তাদের কাজ হয়ত আরও বাড়বে। বিভিন্ন দেশে আমরা ফিলিস্তিনের পক্ষে বড় বড় মিছিল দেখেছি। তুরস্ক, ইরান এমনকি কিছু কিছু পশ্চিমা দেশেও। যদি সংকটের সমাধান করতেই হয় তাহলে গাঁজা এবং ফিলিস্তিন ভূখণ্ড থেকে সরে যেতে হবে ইসরায়েলিদের। যতদিন সেখানে ইসরায়েলের কলোনিয়াল সিস্টেম থাকবে ততদিন আমরা কমবেশি এই ধরনের সংঘাত দেখতে থাকব।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আমেরিকার মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স সব সময় চায় কোথাও না কোথাও যুদ্ধ লেগে থাকুক। কারণ তাদের অস্ত্র বিক্রি করতে হবে। জাতীয় রাজনীতির বিষয়ও রয়েছে এখানে। জো-বাইডেনের জনপ্রিয়তা যেভাবে নেমে গেছে ইসরায়েলকে সাপোর্ট দেওয়ার মাধ্যমে সেই জনপ্রিয়তা আবার উপরের দিকে উঠবে কি না সেটা দেখা দরকার। ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক সমালোচনার মধ্যেও একটি জিনিস তিনি করতে পেরেছিলেন। তা হলো- তিনি তার সময়ে কোনো যুদ্ধে জড়াননি। অনেকে মনে করেন- ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন। ফলে হামাসের এই হামলার সাথে আমেরিকার ডোমেস্টিক পলিটিক্স জড়িত আছে কিনা সেটাও দেখার দরকার।

তবে আমেরিকা যেহেতু ইতোমধ্যে ইসরায়েলের পক্ষে থাকার ঘোষণা দিয়েছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন নেই। আর এই পুরো বিষয়টা নির্ভর করছে আমেরিকার জনগণের ওপর। একমাত্র আমেরিকার জনগণই ইজরায়েলের এই কলোনিয়াল সিস্টেম থামাতে পারে।

ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস জাতিসংঘের মহাসচিবকে ফোন করে গাজায় ইসরাইলি হামলা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেছেন।

আমেরিকার জনগণ যদি এই বিষয়ে গুরুত্ব না দেয় এবং সরকার যা করছে সেটাই যদি মেনে নেয় তাহলে ইসরায়েল ফিলিস্তিন পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়ত হবে না। আর মধ্যপ্রাচ্যে যেন কোনো ধরনের পরিবর্তন না হয় সেটাই চেষ্টা করবে ইসরায়েল এবং আমেরিকা। এই অবস্থার কতদিন থাকবে সেটা বলা মুশকিল। কারণ এক একটা দেশ এককভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ফিলিস্তিনিদের যেহেতু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সুতরাং তারা পাল্টা আঘাতের চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক।

১৯৭১ সালে আমাদের ওপর পাকিস্তানিরা যেভাবে হামলে পড়েছিল এবং তার বিপরীতে আমরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে নেমেছিলাম তাদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা অনেকটা এরকমই। ফিলিস্তিনিরা যেভাবে নির্যাতন এবং হত্যার শিকার হয়েছে সেটা কোনোভাবেই গণহত্যা থেকে কম নয়। এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কী করবে তা দেখার দরকার। সৌদি আরব, ইরান, তুরস্ক দেশগুলো সামরিক দিক দিয়ে বেশ শক্তি অর্জন করেছে। ফলে ফিলিস্তিন ইসরায়েল ইস্যুতে তাদের ভূমিকা কী হবে সেটাও দেখার বিষয়। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কোনো সমাধান নয় সেটা ইসরায়েলেরও বোঝা উচিত। আর ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুটি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ছাড়া শেষ হওয়া সম্ভব নয়।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক

Comments