সৈয়দ রনো’র গল্প ‘পতিতাপুরুষ’

প্রকাশিত: ১০:৫৮ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৯, ২০১৮

সৈয়দ রনো
কবি, লেখক ও সাংবাদিক

প্রথম দিকে ইনবক্সে প্রেমের প্রস্তাব পেয়ে খেঁকিয়ে উঠেছিল উর্মিলা। সদ্য বিধবা মধ্য বয়সী নারী। অনেক ত্যাগ স্বীকার করেও টিকিয়ে রাখতে পারেনি নিজের স্বামীর সৌকর্যপূর্ণ ঘর। আঘাতে আঘাতে জরাজীর্ন মনে পুরুষের প্রতি এক ধরনের ঘ্যান্না জমে গেছে উর্মিলার। রূপে, গুনে, বিদ্যা, বুদ্ধি অর্থ সম্পদ কিছুতেই কমতি নেই তার। এর পরেও বিয়ের স্বামীর বিচ্ছেদ তাকে মানষিক রুগিতে রুপান্তরিত করেছে।

মরার উপর খারার ঘা এখন আদনান। প্রতি রাতে ইনবক্সে নানান ম্যাসেজ দেয়। প্রথম দিকে ভীষনভাবে রাগান্বিত হতো উর্মিলা। ধীরে ধীরে একাকীত্বের দেয়াল টপকাতে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পায় সে। রাত দিনে অবিরাম কথা চলে তাদের। প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় কথার মাত্রা ছাপিয়ে দেদারছে চলে চ্যাট বক্স-এ কথোপকথোন। এরপর ভিডিও কল তারপর গোপন আলাপ। গোপন আলাপের ফাকে ধুরনদাজ আদনান সময় বুঝে উর্মিলার সরলতার সুযোগ নিতে থাকে। এক পর্যায়ে ইনিয়ে বিনিয়ে ধার দেনার অজুহাতে হাতিয়েনেয় উর্মিলার নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা। টাকা আদান প্রদানের পরিণত সম্পর্ক বেড রুম পর্যন্ত গড়ায়। এরপর তারপর সুযোগ বুঝে লাপাত্তা হয়ে যায় আদনান। একেতে স্বামীর বিরহ দ্বিতীয়ত প্রেমিক পুরুষের প্রতারণায় দিশেহারা হয়ে যায় উর্মিলা। চোখে শুধু সর্ষের ফুল দেখে। কারো সাথে মন খুলে কথা বলে না, সময় মতো খাওয়া দাওয়া করে না। ঘরের দরজা আটকে মুখ ভার করে শুধু বসে থাকে একা। পরিবারের সবাই চিন্তিত উর্মিলাকে নিয়ে।

অপর দিকে আদনান আবার নতুন শিকারের সন্ধানে ফেসবুকে নতুন আইডি খুলে। তার নতুন আইডির বন্ধু তালিকায় কোনো বন্ধু নেই প্রকৃত বিচারে সব বান্ধবী। বেছে বেছে সুন্দরী মধ্যবয়সী রমণীদের বন্ধু বানানোই যেন তার প্রধান কাজ। নেশা ও পেশা হচ্ছে ফেসবুকে মেয়েদের পটিয়ে তাদের সরল মনে জায়গা করে নেয়া। এরপর সরলতার সুযোগে অর্থ উপার্জনের ধান্দা ফিকির করা।

রাত জেগে অনেকের সাথে ফেসবুকে চ্যাট করতে থাকে। এর মধ্যে অল্প সময়েই তার প্রেমের ফাঁদে পা দেয় জেরিন। জেরিন সদ্য বিবাহিত মেয়ে কিন্তু তার স্বামী তাকে সময় না দিয়ে বারে সময় কাটায়। কী আর করবে হতভাগী জনম দুখী জেরিন। সেও ধীরে ধীরে ফেসবুকের আলাপে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে আদনানের সাথে। এরপর দেখা- দেখি, পার্কে ডেটিং, কফি হাউজে আড্ডা, রিকসায় ঘুরাঘুরি। ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে ওরা দু’জন। আদনান দেখতে সুদর্শন যুবক বাগমিতায়ও পারদর্শী। সুন্দর চেহারা এবং সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলাটাই তার চালান। নিজেকে বেকার না বলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়–য়া শিক্ষার্থী বলে চালিয়ে দেয় অনায়াসে। ভিডিও কলে কথপকথন ভাইবার, ইমোতে ফোনালাপ কিছুই বাদ যায় না তাদের প্রেমের অনুসঙ্গ হিসেবে। আধুনিকতার বিজ্ঞানের সকল সফলতাকে অনায়াসে কাজে লাগায় প্রেমের পরিপূর্ণতার জন্য। আদনান এক সময় বলে বসে টাকার অভাবে সে ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারছে না। জেরিন সরল বিশ্বাসে বেচে থাকার শেষ অবলম্বন হাতে তুলে দেয় স্বামীর নিকট থেকে নেয়া টাকা।

স্বামী মাহমুদ প্রতিদিন মাতাল অবস্থায় বাসায় ফিরে রাত ২ টা কিংবা ৩ টায়। এসেই অজ্ঞান অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে দশটা নাগাদ ঘুম থেকে জেগে অফিসে যাবার তাড়া। জেরিনের লাভের মধ্যে লাভ হলো মাতাল স্বামীর পকেট হাতড়ে টাকা এবং নিষিধ্য জন্ম নিয়ন্ত্রক উপকরণ নেয়া। অফিস বন্ধের দিন মাঝে মধ্যে ঝগড়া হয় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। মাহমুদের নেশার ঘোর ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে কেটে গেলে চেচিয়ে বলতে থাকে আমার টাকা কোথায়? আমার পকেটে রাখা জন্ম নিয়ন্ত্রক প্যাকেট কোথায়? জেরিনও এসব দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মুখের উপর বলে দেয় কোন মহিলার বেডে ফেলে এসেছো তা তুমিই ভালো জানো। আমি জানবো কিভাবে। মাঝে মাঝে কথা কাটা কাটি এক পর্যায়ে রাজনৈতিক কৌশলী বক্তব্যে রূপ নেয়। আবার কখনো রাজ পথের উত্তপ্ত ভাষণ কিংবা পুলিশ আর বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়নের বাস্তবিক চিত্রে রুপান্তরিত হয়। কথায় আছে- ‘‘চোরের মার বড় গলা ’’। ওদের ক্ষেত্রে এই প্রচলিত বাক্যটি সত্য। এভাবেই চলে ওদের দাম্পত্য কলহ বিবাদ। হাই সোসাইটি তাই হয়তো চুড়ান্ত পর্যায় গিয়ে দ্বাঁড়ায় না ওদের উত্তপ্ত বাক্য। তবে বাক্য তো নয় যেন বস্তির কর্কশ বাক্য বিন্যাস। জেরিনও কম নয়, রূপে, গুণে বুদ্ধি মত্তায় অনন্যা।

মাহমুদ সাহেবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদে চাকুরি নিয়ে তার বিবাহিত বৌউকে তালাক দিতে বাধ্য করিয়ে তারপর ভালোবেসে বিয়ে করেছিল মাহমুদকে। তখনতো ছিল আহ্লাদে গদগদ। অর্থ প্রাচুর্যে সুখে শান্তিতে প্রেমের প্রাসাদ গড়বে মাহমুদকে নিয়ে। দু’চোখে ছিল ভরা জোছনার স্বপ্ন। সময় গড়াতে স্বপ্ন না ছাই এখন বাস্তবিক অর্থে এক দুর্বিসহ জীবন যন্ত্রনা। ঘরে মাতাল স্বামী পাশের রুমে নাক ডেকে ঘুমায় আর জেরিন ভিডিও কলে আদনানের সাথে সময় পার করে উত্তপ্ত শরীর নিয়ে। মাহমুদ আর জেরিনের দাম্পত্য জীবনে বিন্দুমাত্র স্খু নেই। দিন দিন অতিক্রম করতে থাকে একে অপরের ভুল বুঝাবুঝির মাত্রা। গভীর রাতে সম্পর্ক যখন তুমি সম্বোধনে রোমান্টিক হবার কথা তখন তুই তুকারি ব্যবহারে ফুটে ওঠে আধুনিকতার চরম অবক্ষয়।

সময়ে অসময়ে আবেগের ক্ষিপ্রতায় জেরিন মাত্রাতিরিক্ত ঝুকে পরে আদনানের প্রেমে। আদনানও পাকা অভিনেতা, মেয়েলি সরলতার সুযোগে হাতিয়ে নিতে থাকে টাকার বস্তা। স্বপ্ন দেখায় ঘর বাঁধতে হবে, তার জন্য আগেই গুছিয়ে নিতে হবে সব। জেরিন প্রতিদিন সাধ্যমতো টাকা তুলে দেয় আদনানের হাতে। সম্পর্ক রাস্তার অলিগলি পার হয়ে পূত-পবিত্রতায় আশ্রয় নেয় বন্ধ ঘরের কুঠরিতে। কষ্ট করে ফেসবুকে আর ইমোতে কথা বলতে হয় না, কথা হয় দু’জন দু’জনার মুখোমুখি বসে। দেদারচে চলে জেরিনের বাসায় যাতায়াত। অবশেষে ঠিক হয় জেরিন আর আদনান বিয়ে করবে। দিনক্ষণ সময় সেই মতো ঠিক হয়। আদনানও শেষ বারের মতো টাকা নিয়ে জানিয়ে দেয় ধানমন্ডিতে বাসা নেয়া হয়েছে, বাসা নাম্বার ইত্যাদি ইত্যাদি।

রবিবার সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে জেরিন। মাহমুদ অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলেই লাগেজ গুছিয়ে হাজির হয় আদনানের জানানো ঠিকানায়। বিধি বাম! সেখানে অন্য চিত্র! আদনান ইতোমধ্যেই পরিবর্তন করে ফেলেছে তার ফোন নাম্বারসহ যোগাযোগের সব মাধ্যম। জেরিন কোনো অবস্থায় আদনানের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে ফিরে আসার পথ ধরে।

আদনানের নতুন বান্ধবী জোছনা। সামনা সামনি দেখা সাক্ষাত না হলেও ফেসবুকের প্রোফাইলে ছবি দেখেই আদনান অনুমান করেছে চেহারাটাও জোছনার মতো সাদা ধবধবে। দুধে আলতা গায়ের বরন হবে বলেই আদনানের ধারনা। আইডিতে লেখা অবিবাহিত। মনে মনে ফন্দি আটে আদনান কী ভাবে বাগে আনা যায় মেয়েটিকে। এর পূর্বে অবিবাহিত মেয়েদের সাথে প্রেম করার অভিজ্ঞতা একেবারেই নেই বললেই চলে। পরিকল্পনা মাফিক এগুতে হবে বলে মনোস্থির করে আদনান। ইনবক্সে কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হবার পর, স্কাইপিতে ফোন করে বসে। জোছনাও অবজার্ভ করছিল আদনানকে। আদনান ও পরিকল্পনা মাফিক এগুতে থাকে। ফেসবুকে আইডিতে নিজেকে ডাক্তার হিসেবে উল্লেখ করে। ডাক্তারি পোষাক পরা রোগী দেখা অবস্থার কিছু ছবি আপলোড করতেই সাড়া দেয় জোছনা। এরপর আলোচ্য গল্পের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী এগুতে থাকে গল্পের প্লট। মোম জ্বলতে জ্বলতে নরম হয় যেমন তেমনি ধীরে ধীরে আকৃষ্ঠ হয় জোছনা। এখন জোছনাও মাঝে মাঝে ফোন করে আদনানকে। আদনানও মহা খুশি। দীর্ঘদিন ধরে সতর্কতা নিয়ে এগুতে থাকে আদনান। মধু জমে পাথর হতে থাকে দিনদিন তেমনি প্রেমও পূর্ণতার দিকে এগুতে থাকে সময়ের হাত ধরে।

জোছনা অন্য পাঁচজন মেয়ের মতো সহজ সরল আবেগ প্রবণ নন। অনেক কুশলী এবং চতুর। শিক্ষার্থী হিসেবেও মেধাবী। আবেগের দাসত্ব করতে গিয়ে সব কিছু বিকিয়ে দিতে হবে এ মতোবাদেও একত্ব পোষন করেননি কোনোদিন। সস্তা প্রেমের উপাখ্যানে পূর্ণতা পাবে তার ভরা যৌবন, সেটাও তার পছন্দ নয়। ভেতরে ভেতরে দলে-মুচরে ভেঙ্গে-চুড়ে খান খান হলেও তা সহ্য করার মতো মনোবলে উদীপ্ত এক পূর্ণাঙ্গ যৌবনা। ভরা ভাদ্রের উত্তাল তরঙ্গ তার শরীরে আঁচড়ে পড়লেও বিচলিত হবে না মোটেই। সব কিছুর পরেও মানুষ প্রকৃতির নিয়মনীতির শৃংখল ছিন্ন করতে পারেনি কোনো কালে আর পারবে বলেও ধারনা পোষন করা সমুচিত নয়। সময়ের গতি প্রকৃতির সাথে পায়ে পা ফেলে নির্দিষ্ট দূরুত্ব বজায় রেখে এগুতে থাকে জোছনা আর আদনানের প্রণয় উপাখ্যান।

ফোনালাপে পাকা কথা হয় দু’জন দু’জনের সামনা সামনি হবে। বড় বোনের সাথে সমস্ত কথা শেয়ার করে জোছনা। কারণ চোখের সামনে সে দেখেছে বড় বোনের করুণ পরিণতি। যে নারী নিজের জীবনে জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার সে তো সদা সচেষ্ট। কেমন পুরুষ হলে পুড়াতে পারে তার আগুন সেটা খুব ভালো করেই জানে জোছনার বড় বোন। জোছনা এবং আদনানের দেখা হবে কফি হাউজে সন্ধ্যায়, সেখানে আর কেউ থাকবে না, থাকবে ওরা দু’জন। কিন্তু না জোছনা তার বড় বোনকে সব বলেছে বিষয়টি গোপন করেছে সে নিজে।

আদনান নির্দিষ্ট সময়ে কফি হাউজে এসে হাজির। কয়েক মিনিটের ব্যাবধানে জোছনাও হাজির। দু’জন দু’জনার মুখোমুখি হতেই হোটেলে ঢুকে জেরিন জোছনার বড় বোন। এক বার দেখেই চিনে ফেলে আদনানকে। রাগে, ক্ষোভে দুঃখে থর থর করে কাপতে থাকে জেরিন মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবার উপক্রম দৌড়ে এসে ধরে ফেলে জোছনা। মুখে বলে-আপা কী হয়েছে। আদনানও কিংকর্তব্যবিমুঢ়। জীবনে এতো বড় সমস্যার সম্মুখীন হবে ভাবেনি কোনোদিন। ভেতরে ভেতরে শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে অন্তর আত্মা। আসামীর ন্যায় ঠায় দাড়িয়ে থাকে। ভেবে স্থির করতে পারে না তার কী করা প্রয়োজন। অপর দিকে রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে শুধু মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে-বলে ভুল করেছিস জোছনা। জেরিন আয় বোন। ও মানুষ না, ও পতিতাপুরুষ।

সম্পাদক: দৈনিক আলোকিত প্রতিদিন

/এমএম

Comments