যে চার কারণে বাশার এখনও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট

প্রকাশিত: ১০:১৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৫, ২০১৮

ডেস্ক রিপোর্টার : সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ৭ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এই ৭ বছরে অধিকাংশ এলাকাই এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। এতো বছর ধরে চলা যুদ্ধ আর আন্তর্জাতিক মোড়লদের প্রবল চাপের পরও এখনও ক্ষমতায় টিকে আছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আসাদ।

গত সপ্তাহে সিরিয়ার দুমা শহরে হওয়া ‘রাসায়নিক হামলার জবাবে’ শনিবার দেশটিতে যৌথ বিমান হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। সিরিয়াকে নিজ শাসনের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করতে বাশারের প্রচেষ্টার প্রতি এটি একটি আঘাত। কিন্তু এই হামলার লক্ষ্য যে আসাদের প্রেসিডেন্সির ইতি টানা, তেমন কোন আভাস পাওয়া যায়নি।

আসাদের কর্তৃত্বপরায়ন শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরুর প্রথমদিকে বিদ্রোহীদের সাফল্যের হার দ্রুতই বাড়ছিলো। তখন অনেকেই ধারনা করেছিলো, আরব শাসকদের পতনের তালিকায় যুক্ত হবে তার নাম। কিন্তু বর্তমানে বিদ্রোহীরাই পিছিয়ে। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কতে এবং উত্তরাঞ্চলের শহর আলেপ্পোতে শক্ত অবস্থান হারিয়েছে বিদ্রোহীরা।

এমনকি সিরিয়া সরকারের বিরোধিতা করা জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকরা, যেমন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনও বলেছিলেন, সিরিয়া শাসন চালিয়ে যেতে পারবেন আসাদ। গত বছরের জানুয়ারিতে তিনি এমনটি জানিয়ে বলেছিলেন, সিরিয়ার পুনর্নির্বাচনে আসাদ অংশগ্রহণ করতে পারেন।

বিশ্লেষকরা বাশারের এখনও টিকে থাকার পেছনের যে কারণগুলো নির্ধারণ করেছেন তা হলো…

১. বিদেশি সাহায্য

২০১২ সালের গ্রীষ্মে বিদ্রোহীদের অবস্থানই তুলনামূলক ভালো ছিল। দামেস্ক-এর কেন্দ্রে এক বোমা বিস্ফোরণে সিরিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তাদের কয়েকজন নিহত হয়েছিলেন। নিহতদের সেই তালিকায় ছিলেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং আসাদের স্ত্রীর ভাই আসিফ শাওকাত। বিদ্রোহীরা ভেবেছিল বিজয় সন্নিকটে।

সেসময় ফ্রি সিরিয়ান আর্মি কমান্ডার বাশার আল-জৌবি আল জাজিরাকে জানিয়েছিলেন, সিরিয়ার সেনাবাহিনীর প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন দেশটিতে হস্তক্ষেপে এগিয়ে এসেছিল ইরান। তারা প্রশিক্ষণ, শিয়া মিলিশিয়ার আদলে অভিজ্ঞ কমান্ডার এবং পদাতিক সেনা পাঠায় সিরিয়ায়।

ইরানের গণমাধ্যম জানায়, সিরিয়া সরকারের সমর্থনে তেহরানের পাঠানো যোদ্ধার সংখ্যা প্রায় এক লাখ।

৯০ হাজার সেনা নিয়ে ইরানের প্রশিক্ষিত জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সেনারা সিরিয়ার পক্ষে সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে উঠে। যুদ্ধের গতিপ্রবাহ পাল্টে দেওয়ার জন্য তাদের অবদানই ব্যাপকভাবে স্বীকৃত।

ইরানের জন্য আসাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। এই অঞ্চলে ইরানের স্বার্থ রক্ষার জন্যও তারা গুরুত্বপূর্ণ। ইরানের বড় আকারে স্থল বাহিনী পাঠানোর মধ্যেই রাশিয়া আসাদের জন্য সবচেয়ে বড় সাহায্য নিয়ে আবির্ভূত হয়। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মস্কো সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠির বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করে। রুশ বিমান অভিযানের মুখে বিদ্রোহীদের শক্ত অবস্থান আলেপ্পো এবং পূর্বাংশের ঘৌতা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় বিদ্রোহীরা।

২. বিদ্রোহীদের মধ্যে বিভাজন

বিদ্রোহীদের মধ্যে বিভাজনও আসাদের পক্ষে গিয়েছে। নমনীয়ভাবে জোটবদ্ধ ফ্রি সিরিয়ান আর্মি ভেঙ্গে যায়। কট্টরপন্থী গ্রুপগুলো সরকারবিরোধী অবস্থানে নিজেদের অবস্থানও শক্তিশালী করে তুলে।

বিদ্রোহী গ্রুপগুলো প্রাথমিকভাবে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিদের সমর্থনকে স্বাগত জানায়। কিন্তু শীঘ্রই তারা দেখে আইএসের বিরুদ্ধেই তাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে। বিদ্রোহীদের সম্পদ ও যোদ্ধাদের আসাদ বিরোধী অভিযান থেকে সরিয়ে নিচ্ছে আইএস। বিদ্রোহীদের মূল ঘাঁটি রাকা জয় করে নেয় আইএস। বিদ্রোহীদের দেশটির একটি বিশাল অঞ্চল থেকে তারা তাড়িয়েও দেয়। পরবর্তীতে আইএসের কাছ থেকে বিদ্রোহীরা কিছু অঞ্চল পুনর্দখল করতে পারলেও সাবেক বিদ্রোহী অঞ্চল আবার দখল করে নেয় কুর্দিশ যোদ্ধারা ও সরকারি বাহিনী।

বিদ্রোহীদের জন্য শুধু আইএসই কাঁটা হিসেবে আসেনি, বর্তমান সময়ে সেখানে বিদ্রোহীদের অনেকগুলো ভাগ রয়েছে। আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা, জাতিগত পরিচয়, রাজনৈতিক অবস্থান এবং ধর্মীয় সংশ্লিষ্টতার ভিত্তিতে এই বিভাজন।

৩. আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ

পশ্চিমা দেশগুলো এবং আঞ্চলিক শক্তি, যেমন তুরস্ক ও সৌদি আরব আসাদের বিরোধিতায় সরব হলেও সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে সরাতে তারা কোন চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়নি। বিদ্রোহীদের আবেদন সত্ত্বেও লিবিয়ার মতো কোন সামরিক হস্তক্ষেপও এড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। লিবিয়ায় সেই মার্কিন হস্তক্ষেপে বিদ্রোহীরা দেশটির দীর্ঘ সময়ের নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন ঘটিয়েছিল।

বিদ্রোহী গ্রুপের কাছে অস্ত্র এলেও তাদের অভিযোগ ছিল যে এটা সিরিয়া সরকারের বিমান শক্তির হুমকি মোকাবেলার জন্য অপর্যাপ্ত। কিন্তু পর্যাপ্ত অস্ত্র পাঠাতে যুক্তরাষ্ট্রের নারাজির পেছনেও কিছু আশঙ্কা প্রভাব ফেলেছে। শঙ্কা ছিলো আইএসের মতো জঙ্গি দলের কাছে অস্ত্রগুলো চলে যাওয়ার, যা পরবর্তীতে পশ্চিমা স্বার্থের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হতে পারে। যুদ্ধের সময় যখন বাড়ছেই, পশ্চিমা অনেক দায়িত্বশীল কর্মকর্তাও আসাদকে সরানোর ক্ষেত্রে আর তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এমন মনোভাবও বাড়ছে।

২০১৭ সালের মার্চে, জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি বলেছিলেন, আসাদ থেকে মুক্তি এখন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির মূল কেন্দ্রে নেই। দুই মাস আগে, ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, একটি শান্তি চুক্তির অংশ হিসেবে আসাদ থাকতে পারেন।

৪. অভ্যন্তরীণ সমর্থন

আসাদ শাসনের বিরোধীদের অংশ ব্যাপক হলেও, তিনি সিরিয়ায় একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সমর্থক গোষ্ঠি ধরে রাখতে পেরেছেন। তার আলউয়াইট সম্প্রদায়ের বাইরেও এই সমর্থন ছড়িয়ে পড়েছে। সুন্নি সম্প্রদায়ের অনেকেই তার পক্ষ নিয়েছে। এরা তার শাসনামলে আর্থিক ভাবে লাভবান হয়েছে। তারা মনে করে, এই অবস্থার পরিবর্তনে তাদের খুব একটা লাভ হবে না।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্তের বিপ্লবে অনুপ্রাণিত হয়ে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ২০১১ তে প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হয় সিরিয়ার দক্ষিণের শহর ‘ডেরা’য়। বিক্ষোভ শুরুর অনেক আগে থেকেই কর্মসংস্থানের অভাব, দুর্নীতির মতো নানা কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছিল সিরিয়ায়। এই বিক্ষোভকে ‘বিদেশী মদদপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যা দেন প্রেসিডেন্ট আসাদ। বিক্ষোভ দমন করতে আসাদ সরকারের বাহিনী অভিযান চালায়।

এই আন্দোলন-বিরোধী অভিযান শক্তিশালী হলে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের জন্য আন্দোলন শুরু হয় পুরো দেশে। দ্রুতই সারাদেশে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে, বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযানও জোরদার হয়।বিদ্রোহীরা শুরুতে নিজেদের জীবন রক্ষার্থে অস্ত্রধারণ করে। পরে তার এক হয়ে নিজেদের এলাকার সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা সিরিয়ান অবজার্ভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮’র মার্চ পর্যন্ত ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৯০০ মানুষ মারা গেছে সিরিয়ায়। তাদের মধ্যে ১ লাখ ৬ হাজার জনই বেসামরিক। এর বাইরেও নিখোঁজ রয়েছে ৫৬ হাজার ৯০০ জন।  আরও ১ লাখ মানুষের মৃত্যুর তথ্য নথিভুক্ত করা হয়নি।

সূত্র : আল জাজিরা / এসআর

Comments