যেভাবে এসেছে নোবেল পুরষ্কার

প্রকাশিত: ৪:১৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৩, ২০১৮

বশির ইবনে জাফর

নোবেল পুরস্কার এর কথা কমবেশি আমরা সবাই জানি। যারা না জানি তারাও অন্তত নোবেল পুরস্কার যে বড় একটা অর্জন এইটুকু মনে করে থাকি। কিন্তু এ নোবেল পুরস্কার কোত্থেকে এসেছে বা তার প্রকৃত ইতিহাস কি তা আমরা অনেকেই জানি না।

আজ নোবেল পুরস্কার সম্পর্কে কিছু মৌলিক কথা লিখা গেলো। শুরুতেই জেনে নেয়া যাক নোবেল পুরস্কার আসলে কী। সুইডিশ নাগরিক আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল নামের বিত্তশালী এক মহাপুরুষ তাঁর সারা জীবনের উপার্জিত অঢেল সম্পত্তি মৃত্যুর পূর্বে একটি উইলের মাধ্যমে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে বন্টনের কথা উল্লেখ করে যান। তারই একটি খাত হচ্ছে এই ‘নোবেল পুরস্কার’। এটি মূলত তার রেখে যাওয়া সঞ্চিত অর্থের লভ্যাংশ থেকে গৃহীত হয়।

১৯০১ সাল থেকে সর্বপ্রথম শুরু হয়ে প্রতিবছর পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে অবদানের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়। প্রকৃত নোবেল এই পাঁচটি খাতেই সীমাবদ্ধ এবং প্রত্যেকটি খাতের কথা আলফ্রেড নোবেলের উইলে উল্লেখ করা আছে।

তবে ১৯৮৬ সালে এসে অর্থনীতিতেও নোবেল দেয়া হচ্ছে যা মূলত একটি সম্মাননা এবং এর অর্থ আলফ্রেড নোবেলের রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকেও আসে না। চিকিৎসাবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, ও রসায়নের গবেষণায় সাফল্যের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি নোবেল পুরষ্কার।

সাহিত্যে যিনি নোবেল পুরষ্কার পান – তাঁর পাঠকপ্রিয়তা এই সময় হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তার জন্য নোবেল শান্তি পুরষ্কার পান যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান – নোবেল পুরষ্কার পাবার সাথে সাথে সেই ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ও মর্যাদা বেড়ে যায় অনেকগুণ; অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতাও বেড়ে যায়।

উদাহরণ স্বরুপ বাংলাদেশের ড. ইউনুসের কথাই ধরা যাক। একসময় গ্রামীণ ব্যাংক সকলে না চিনলেও শান্তিতে তাঁর নোবেল পুরষ্কার পাবার পর গ্রামীণ ব্যাংকের খ্যাতি বেড়ে যায় যা ড. ইউনুসেরই প্রতিষ্ঠান। সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার যাঁরা পান তাঁদের নিয়ে প্রায় সময়ই নানারকম বিতর্ক তৈরি হলেও অন্য তিনটি অবদানের ক্ষেত্রে সে বিতর্ক সাধারণত তৈরি হয় না । অবশ্য এসব বিতর্কে নোবেল পুরষ্কারের মর্যাদা কখনো কোন অংশেই কমে না, বরং বেড়ে যায়। এই ছিলো নোবেল পুরষ্কারের এর মূল কথা।

এবার জেনে নেয়া যাক তার উইল সম্পর্কে;
১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর তারিখে আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল তাঁর উইলে স্বাক্ষর করেছিলেন। সুইডিশ ভাষায় তাঁর নিজ হাতে লেখা চার পৃষ্ঠার উইলে সারাজীবনের সঞ্চিত ধন-সম্পদের বিলিবন্টনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। দেখা যাক আলফ্রেড নোবেলের উইলে ঠিক কী কী লেখা আছে। মূল উইলটি সুইডিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে নোবেল কমিটি।

ইংরেজি থেকে বাংলায় অনূদিত উইলের পূর্ণ-বিবরণ: “আমি, নিম্নস্বাক্ষরকারী, আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল, এই মর্মে সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় ঘোষণা করছি যে আমার মৃত্যুর পর আমার অর্জিত সম্পদের বিলি-বন্টন সম্পর্কে এখানে বর্ণিত বিবরণই হবে আমার অন্তিম ইচ্ছা। আমার মৃত্যুর পর আমার ভাই রবার্ট নোবেলের দুই ছেলে হালমার নোবেল ও লুডভিগ নোবেল – তাদের প্রত্যেককে আমি দুই লক্ষ ক্রাউন করে দিয়ে যাচ্ছি। আমার ভাইপো ইমানুয়েল নোবেলকে দেয়া হবে তিন লক্ষ ক্রাউন, এবং আমার ভাইঝি মিনা নোবেলকে দেয়া হবে এক লক্ষ ক্রাউন। আমার ভাই রবার্ট নোবেলের মেয়ে – ইনগিবোর্গ ও টায়রা – দুজনের প্রত্যেককে এক লক্ষ ক্রাউন করে দেয়া হবে।

আলফ্রেড নোবেল-এর ঐতিহাসিক উইল

বর্তমানে প্যারিসের সেন্ট ফ্লোরেন্টিন রোডের ১০ নম্বর বাড়িতে মিসেস ব্র্যান্ডের সাথে অবস্থানরত মিসেস ওলগা বোয়েতগারকে দেয়া হবে এক লক্ষ ফ্রাংক। মিসেস সোফি ক্যাপি ভন ক্যাপিভার যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন তাঁকে বছরে ছয় হাজার হাঙ্গেরিয়ান ফ্লোরিন দেয়া হবে। তাঁর ঠিকানা ভিয়েনার অ্যাংলো-ওয়েস্টেরেইসিসে ব্যাংকে দেয়া আছে। ঐ ব্যাংকই তাঁর কাছে তাঁর বাৎসরিক বরাদ্দ পাঠিয়ে দেবেন। সেজন্য আমি হাঙ্গেরিয়ান স্টেট বন্ডের মাধ্যমে ঐ ব্যাংকে দেড় লক্ষ ফ্লোরিন জমা রেখেছি। বর্তমান স্টকহোমের ২৬ নম্বর স্টুরগ্যাটেন নিবাসী মিস্টার আলারিক লিয়েদবেককে দেয়া হবে এক লক্ষ ক্রাউন। বর্তমানে প্যারিসের দ্য লুবেক রোডের ৩২ নম্বর বাড়িতে অবস্থানরত মিস এলিস অ্যান্টুন যতদিন বেঁচে থাকবেন বছরে আড়াই হাজার ফ্রাংক করে পাবেন। তাছাড়া তাঁর নিজের যে আটচল্লিশ হাজার ফ্রাংক বর্তমানে আমার কাছে জমা আছে তাও তাঁকে ফেরত দেয়া হবে।

আমেরিকার টেক্সাসের ওয়াটারফোর্ড নিবাসী মিস্টার আলফ্রেড হ্যামন্ডকে দেয়া হবে দশ হাজার আমেরিকান ডলার। মিস এমি উইংকেলমান ও মিস মেরি উইংকেলমান, ঠিকানা: ৫১ পটসড্যামারেস্ট্রেসে, বার্লিন। এই দুজনকে পঞ্চাশ হাজার ফ্রাংক করে দেয়া হবে। মিসেস গাউসের, ঠিকানা: ২ বিস বুলেভার্ড দু ভিয়াদুক, নিমস, ফ্রান্স; পাবেন এক লক্ষ ফ্রাংক। আমার স্যান রেমোর ল্যাবোরেটরিতে কর্মরত আমার কর্মচারী অগাস্তে অসওয়ার্ল্ড ও তার স্ত্রী আলফন্সে টুরন্যান্ড – দুজনের প্রত্যেকে আজীবন বছরে এক হাজার ফ্রাংক করে পাবেন।

আমার প্রাক্তন কর্মচারী জোসেফ গিরারডট, ঠিকানা: ৫ প্লেস স্ট্রিট, লরেন্ট, সালোন্‌স স্যু সাওন যতদিন বেঁচে থাকবে বছরে পাঁচ শত ফ্রাংক করে পাবে। আমার প্রাক্তন মালী জাঁ লেকফ, বর্তমান ঠিকানা: মিসেস ডেসোট্টার, রিসেভ্যুর কুরালিস্তে, মেসনিল, অউব্রি পাওর ইকোওয়েন, এস এন্ড ও, ফ্রান্স; যতদিন বেঁচে থাকবে বছরে তিন শত ফ্রাংক করে পাবে। মিস্টার জর্জেস ফারেনবাখ, ঠিকানা: ২, রু কম্পিয়েঁজ, প্যারিস; ১লা জানুয়ারি ১৮৯৬ থেকে ১লা জানুয়ারি ১৮৯৯ পর্যন্ত বছরে পাঁচ হাজার ফ্রাঙ্ক করে অবসরভাতা পাবেন।

আমার ভাইয়ের ছেলেমেয়ে হালমার, লুডভিগ, ইনগিবার্গ ও টায়রা – তাদের প্রত্যেকের জন্য বিশ হাজার ক্রাউন করে আমার কাছে জমা আছে। তাদের প্রত্যেককে এই অর্থ ফেরত দেয়া হবে। আমার বাকি সব সম্পদের বিলিবন্টন করা হবে এভাবে: আমার মূলধন যা আমার নির্বাহী কর্মকর্তারা নিরাপদে বিনিয়োগ করেছেন তা দিয়ে একটা তহবিল গঠন করা হবে। এই তহবিল থেকে বার্ষিক যে সুদ পাওয়া যাবে তা প্রতি বছর পুরষ্কার হিসেবে ভাগ করে দেয়া হবে তাদেরকে যাঁরা আগের বছর মানুষের কল্যাণে সর্বোচ্চ অবদান রেখেছেন।

বার্ষিক অর্জিত মোট সুদকে সমান পাঁচ ভাগে ভাগ করে: এক ভাগ দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করবেন; এক ভাগ দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক আবিষ্কার বা উন্নয়ন করবেন; এক ভাগ দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি শরীরতত্ত্ব কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করবেন; এক ভাগ দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি কোন আদর্শ স্থাপনের লক্ষ্যে সাহিত্যে সবচেয়ে ভালো কাজ করবেন; এবং এক ভাগ দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি দুটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে, সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি বা সৈন্যসংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে, শান্তি সম্মেলনের আয়োজন ও প্রচারের লক্ষ্যে সবচেয়ে বেশি কিংবা সবচেয়ে ভালো কাজ করবেন।

পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের পুরষ্কার দেবে সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস; শরীরতত্ত্ব কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞানের পুরষ্কার দেবে স্টকহোমের ক্যারোলিন ইন্সটিটিউট; সাহিত্যের পুরষ্কার দেবে অ্যাকাডেমি ইন স্টকহোম; এবং শান্তি পুরষ্কার দেবে নরওয়ের পার্লামেন্ট (স্টরটিং) কর্তৃক নিয়োজিত পাঁচ সদস্যের এক কমিটি। এই পুরষ্কার দেয়ার জন্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে কোন ধরনের জাতীয়তার প্রতিবন্ধকতা থাকবে না; স্ক্যানডিন্যাভিয়ান হোক বা না হোক, যোগ্যতম ব্যক্তিই এই পুরষ্কার পাবে এটাই আমার ইচ্ছা।

আমার উইল কার্যকর করার জন্য আমি দু’জন নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ করছি: মিস্টার র্যা গনার শোলম্যান, ঠিকানা: বফর্স, ভার্মল্যান্ড; এবং মিস্টার রুডল্‌ফ লিজেকুইস্ট, ঠিকানা: ৩১ মাল্মস্কিলন্যাডসগ্যাটান, স্টকহোম ও বেংগটস্ফোরে উড্ডেভেলার কাছে। এই কাজের জন্য তাঁরা যে কষ্ট করবেন তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে মিস্টার র্যা গনার শোলম্যানকে এক লক্ষ ক্রাউন দিচ্ছি কারণ তাঁকেই এই কাজে বেশি সময় দিতে হবে; এবং মিস্টার রুডল্‌ফ লিজেকুইস্টকে পঞ্চাশ হাজার ক্রাউন দিচ্ছি।

বর্তমানে আমার সম্পদের মধ্যে আছে কিছু অংশ আছে প্যারিস এবং সেন্ট রেমোতে রিয়েল এস্টেট হিসেবে; আর আমানত হিসেবে জমা আছে: ইউনিয়ন ব্যাংক অব স্টকল্যান্ডের গ্লাসগো এবং লন্ডন শাখায়; প্যারিসের কম্পটয়ের ন্যাশনাল ডি-স্কম্পটি, এবং আলফেন মেসিন অ্যান্ড কোম্পানিতে; প্যারিসের স্টকব্রোকার এম ভি পিটার অব ব্যাংক ট্রান্স-আটলান্টিকে; বার্লিনের ডিরেকশান ডার ডিসকনটো গেশেলস্ক্রাফ্‌ট এবং জোসেফ গোল্ডস্মিডট অ্যান্ড কোম্পানিতে; রাশিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকে এবং পিটারসবুর্গে মিস্টার ইমানুয়েল নোবেলের কাছে; গুটেনবার্গ ও স্টকহোমে স্ক্যানডিনাভিস্কা ক্রেডিট আক্টিয়েবোলাগেটে; এবং প্যারিসের ৫৯ নম্বর মালাকফ অ্যাভিনিউতে রক্ষিত আমার স্ট্রং-বক্সে। এগুলো ছাড়াও আছে প্যাটেন্ট, প্যাটেন্ট ফি বা রয়্যালটি থেকে আয়। আমার নির্বাহীরা এই হিসেবের পূর্ণ বিবরণ আমার দলিলপত্র থেকে খুঁজে বের করবেন।

আমার এই উইলটিই হলো একমাত্র বৈধ উইল। আমার মৃত্যুর পর যদি এর আগে করা কোন উইল খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে সেগুলো বৈধ বলে গণ্য হবে না।

সবশেষে আমার বিশেষ ইচ্ছা এই যে আমার মৃত্যুর পর কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আমার শিরা কেটে দেখবেন এবং আমার মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হবেন। তারপর আমার দেহ কোন শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হবে। স্বাক্ষর
প্যারিস, ২৭ নভেম্বর, ১৮৯৫
আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল
___________
আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীগণ এই মর্মে ঘোষণা করছি যে মিস্টার আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল সুস্থ মস্তিষ্কে, স্বেচ্ছায় ঘোষণা করেছেন যে উপরে বর্ণিত উইলটি তাঁর শেষ উইল। তিনি আমাদের সবার সামনে উইলে স্বাক্ষর করেছেন, এবং আমরাও সবাই সবার সামনে উইলে স্বাক্ষর করলাম।

সিগার্ড এরেনবোর্গ।
অবসরপ্রাপ্ত ল্যাফটেন্যান্ট
প্যারিস: ৮৪ বুলেভার্ড হাউসম্যান
আর ডাব্লিউ স্ট্রেলেনার্ট
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার
৪, প্যাসেজ ক্যারোলিন

থস নরডেনফেল্ট
কনস্ট্রাক্টর
৮, রু অবার, প্যারিস

লিওনার্ড হাওয়াস
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার
৪, প্যাসেজ ক্যারোলিন”

/আরএ

Comments