মাকে আমার মনে পড়ে না

প্রকাশিত: ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ২, ২০২০

নাজমুল হাসান
সংবাদকর্মী

মা শব্দটা শুনলেই নিউরন জেগে উঠে। হাত কিছুটা কেঁপে উঠে। চোখ নিমিষেই ঝাপসা হয়। মা আর আমার মাঝে মেঘনার খরস্রোত বহমান।মাঝে এসে করোনা হানা দিল। মাকে বুকের বাঁ দিকে যত্নে রেখে আমি ডান দিকে কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরে জেগে উঠে মোবাইল নিয়ে খোঁজ নেই। বুকের বাঁ দিকে ব্যথা করছে, মা আমার ঠিক আছে তো?

মা আমাদের জন্যে উদ্বিগ্ন থাকে, সব সময়। এটা চিরন্তন বাণী। আমার মা চিঠি পড়তে পারে না।পারলে লিখে পাঠাতাম, ”জানো মা, আকাশে মেঘ দেখলে আমার তোমার কথা মনে পড়ে। নির্ঘুম কাটে রাত। বজ্রপাত হলে ভীষণ ভয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি বলি, হে আল্লাহ,তুমি উপকারী বৃষ্টি দাও। জানি না, আমার মা হয়তো বাইরে কোনো কাজে বের হয়েছে।”

মায়ের গন্ধ ছেলেমেয়েদের ভাল লাগে। ভাল লাগে আঁচলে মুখ মুছে তৃপ্তির হাসি হাসতে। ভাত খেয়ে আঁচলে মুখ মুছে উঠে তাই আমি বলি, “মা আমার ক্ষুধা লাগছে।” কী অদ্ভুত আমার মা। এটা সেটা খেতে বলে।

বলছি গন্ধের কথা। আমার মায়ের পায়ে নখচিপা আছে। এটা থেকে অদ্ভুত গন্ধ বের হয়। বাড়িতে গিয়ে আমি যখন নখ কাটতে বসি, গোপনে তার ঘ্রাণ নেই। অদ্ভুত সুগন্ধে হৃদয় ভরে যায়।

প্রত্যেক সন্তানের ভেতর মা ঘুমন্ত থাকে। আমি বিশ্বাস করতাম না। আমার ভেতর কোনো মা নেই। সে-বার মায়ের ভীষণ জ্বর। উঠতে পারছে না।বাড়িতে কেউ নেই। আমি কলেজ ছাত্র। ঘরের কাজ করতে করতে আমার বেহাল দশা। তার উপরে মা অসুস্থ। সন্ধ্যায় ঘুমে টলিয়ে পড়েছি।মধ্যরাতে মা মা শব্দে জেগে উঠি। আমার মা ঘুমের ঘোরে মা মা করছে।

সেদিন আমার ভিতরে এক মেয়ের জন্ম হল। আমি মা হলাম। আমার মেয়ে আমার পাশে জ্বরে মা মা করছে। আর আমাকে বুকে চেপে ধরছে। সেই জ্বরে এক অলিখিত চুক্তিতেই আমি আমার মায়ের মা হলাম। আমি সেদিন বুঝেছি, আমার তো একজন মা আছেন। আমার মায়ের একজন মা ভীষণ দরকার।

মেয়েরা বাপ সোহাগী হয়, ছেলরা মা সোহাগী।আমার ক্ষেত্রে উল্টো হয়নি।জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মা এতই জীবন্ত। সেখানে বাবাকে প্রতিবেশী প্রতিবেশী লাগে। প্রতিটি মেয়ে এক সময় মাকে পর করে দেয়। নতুন কাউকে পেয়ে মাকে ঠেলে দেয় দূরে। একদিন ভুল ভাঙে। ভেঙে যায় মেয়ে আর মায়ের দেয়াল। সেদিন মেয়ে শব্দ বিলুপ্ত হয়ে যায়। মা শব্দটা পৃথিবীর বুক জুড়ে তার মহিমা প্রকাশ করে। অন্যদিকে ছেলেরা কাছে থেকেও অনেক সময় দূরে সরে যায় মায়ের থেকে।

খুব ছোটবেলায় একবার মায়ের সাথে গিয়েছি বাড়ি থেকে বহুদূরে। নদীর পাড়ে। আমরা ভাঙনতীরের মানুষ। একজায়গা ভাঙলে অন্য জায়গায় ঠাঁই নেই। মায়ের পুরাতন বাড়ির কবরস্থান ভাঙছে। মামাতো ভাই এসে মাকে বললো, ফুফু নানুর কবর ভেঙে যাচ্ছে। শেষ দেখা দেখবেন, চলেন। সেই সুবাদে মায়ের আঁচল ধরে আমিও নদীর ধারে।

নদীর তীরের মানুষের সবচেয়ে বড় দুঃখ। তারা মা বাবাকে বার বার বিদায় দেয়।এই মেঘনা আমাদের ঘর নিয়েছে, বাড়ি নিয়েছে, নিয়েছে ক্ষেত খামার।শেষে নিয়ে যায় প্রিয়জনের কবর। পুরো নদী হয়ে যায় মা বাবা। পুরো নদী হয়ে যায় প্রেম, প্রিয়, প্রিয়তম।

সেই নদীর পাড়ে আমার জীবনের সবচেয়ে ট্র‍্যাজিডি দৃশ্যধারণ হয়েছে যা আজো ভুলতে পারিনি। স্মৃতি দগ্ধ আগুন। বুকের মাংসল অংশটাকে কুড়েকুড়ে খায়। আমার মাকে সেদিন পাগলির মত কান্না করতে দেখেছি। বেড়ীর প্রতিটি মাটি আর ঘাস ভিজে গেছে এক রমনীর অশ্রুতে।

পাগলের মত ছুটেছিল মামাতো ভাই। নানীকে নদীর পাড় থেকে নিয়ে অন্য কোথাও কবর দেবার আশা নিয়ে কত দেন দরবার।নপূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় আশার তৈরি মেঘনার স্রোতে জগতের যাবতীয় ঘটনার আড়ালে চলে গেলো।

“আমার মা নেই, মায়ের কবর নেই”।

হতভাগ্য মায়ের সেই উক্তি শেলের মত বুকে বিঁধে আমার। আমি ছিলাম সেই নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকা এক শিশু।

হাতিয়া ভাঙবে। থামবে না। থামাবার কেউ নেই। মায়ের গল্প, মায়ের কবরের গল্প আমাদের কাছে ধরা দিবে বাস্তব হিসেবে। আমাদের একদিন মা ও মায়ের কবর থাকবে না। এসব ভাবতেই হাতিয়াকে রাক্ষস রাক্ষস মনে হয়।

প্রিয়জনের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আমরা বলতে পারবো না, এই তোর নানির কবর। দোয়া মাঙ। যেমনটা বলতে পারেনি, আমার মা। একফোঁটা অশ্রু মাকে দেখিয়ে ফেলবে, এই ভাগ্যটুকু আমার মায়ের নেই।

এবার বাড়িতে যাওয়া হবে না। আমার মা একটা জিনিস ভীষণ মিস করবে। প্রতিটি ট্রলারের শব্দ মাকে জানিয়ে দিবে না, আমরা আসছি। অপেক্ষার প্রহর শেষ। তারপরেও কেন জানি মনে হয়,আমার মা নদীর পাড়ে দিনে বেশ কয়েকবার চক্কর দিয়ে যাবে, কোনোভাবে যদি পৌঁছে যায়।

আমার মনে হয় মায়েদের প্রত্যেক সন্তানের জন্য আলাদা খোপ আছে। এখানে সবাই আলাদা হয়ে থাকে। আর প্রত্যেকের ব্যাপারে মা সবসময় সজাগ থাকে। প্রকাশ করুক, আর নাই করুক। মায়েরা এর থেকে বের হতে পারে না।

আমার মা এ দেশের প্রতিচ্ছবি। শুধু এইটুকু বলা যায়, মায়ের শেষ সন্তান হিশেবে জন্মের সময় সবটুকু রক্ত চুষে জন্মছি আমি। তাই মাঝে মাঝে রক্তের কণিকারা আলাদা হয়ে যায়। রক্তরসে মায়ের মুখ ভেসে উঠে সাদা শূন্য সে মুখ। আমাকে পৃথিবীতে আনতে একজন তার শেষ রক্ত ঢেলে দিলো, সেরা হতে আর কী চাই!!

আমার কখনো মোটিভেশান এর দরকার হয়নি।আমার মা-ই হলো আমার সেরা মোটিভেশন।

শেষ করছি রবীন্দ্রনাথের একটা উক্তি দিয়ে,’মাকে আমার পড়ে না মনে’। সত্যি মাকে আমার মনে পড়ে না, শুধু চোখ জোড়া ভিজে যায়। বয়ে যায় হৃদয়ে ভাঙন, মেঘনার ভাঙনের চেয়ে কম নয়।

লেখক : শিক্ষার্থী,গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Comments