মুফতি ফয়জুল করীম: বিতর্ক কেনো হয়, দায় কার?

প্রকাশিত: ৫:০৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৯

পলাশ রহমান
ইতালী প্রবাসী কলামিস্ট ও সাংবাদিক

সৈয়দ ফয়জুল করিম, বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি এবং ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির। একজন টগবগে আলেম। বয়স এবং অভিজ্ঞতার তুলনায় তার খ্যাতি, যশ ছড়িয়ে পড়েছে অনেক বেশি। আর দায়িত্ব? সেতো পাহাড় সমান। আমি চিন্তাও করত পারি না, এতএত দায়িত্বের বোঝা মাথা নিয়ে তিনি আর দশজনের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করেন কীভাবে।

সাম্প্রতিক তার একটি বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। চরমোনাইর সদ্যসমাপ্ত ফালগুনের মাহফিলে প্রদান করা তার একটি ওয়াজের খন্ডাংশ ছড়িয়ে পড়েছে সোস্যাল মিডিয়ায়। নিন্দুকরা বলার চেষ্টা করছে, তিনি একজন সাহাবির সমালোচনা করেছেন। তিনি মনের ভেতরে সাহাবিদের সম্পর্কে বিদ্বেষ পোষণ করেন।

এ বিষয়ে সৈয়দ ফয়জুল করিম খুব দ্রুতো এক ভিডিও বার্তা দিয়ে নিজের অবস্থান পরিস্কার করেছেন। তার ওই ভিডিও বার্তা প্রকাশের পর আর কোনো ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই। তিনি বা তার দল, প্রতিষ্ঠান নিয়ে নতুন কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই।

এখন প্রশ্ন হলো- বিতর্কের সৃষ্টি হলো কেনো? এ প্রসঙ্গে আমি একটা কথা বলতে পারি- ছোট সময়ে হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদির একটা ওয়াজ শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ওয়াজ করার জন্য প্রথম শর্ত হলো বক্তার ভেতরে এলেম বা জ্ঞান থাকতে হবে। বক্তা যে বিষয়ে ওয়াজ করতে চান সে বিষয়ে ঝরঝরে জ্ঞান থাকতে হবে। পাশাপাশি যারা ওয়াজ শুনবেন, অর্থাৎ শ্রোতাদের মধ্যেও কিছু জ্ঞান থাকতে হবে। শ্রোতারা যদি বক্তার কথার ভেতরে প্রবেশ করার মতো জ্ঞানটুকুও না রাখে তখন বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ভুল বোঝাবুঝির জন্ম হয়।

যে বয়সে মাওলানা যুক্তিবাদির এই বক্তব্য শুনেছিলাম, সে বয়সে এ কথার গভীরতা বোঝার বুদ্ধি আমার ছিলো না। এখন বুঝতে পারি বড়বড় দার্শনিক, বিজ্ঞানী, আলেম, সমাজ সংস্কারকদের নিয়ে কেনো বিতর্ক তৈরী হয়। কেনো ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।

মাওলানা যুক্তিবাদির বক্তব্য তুলে ধরে আমি কোনো ভাবেই প্রমান করতে চেষ্ট করছি না যে, বিতর্ক বা ভুল বোঝাবুঝির জন্য বক্তা বা দার্শনিক, বিজ্ঞানী, আলেম, লেখক, সমাজ সংস্কারকদের কোনো দায় নেই। বরং সব থেকে বেশি দায় তাদের। তারা অনেক সময়ে অসতর্ক মূলক কথা বলেন, লেখেন। কেউ কেউ তার নিজের দর্শন, চিন্তা সঠিক ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না। তাছাড়া সার্বজনিন ভুল করার সুযোগ তো আছেই।

সাহাবিদের ব্যাপারে আমাদের দেশের হকপন্থী আলেমদের মনোভাব হলো তাঁদের বেপারে কোনো সমালোচনা গ্রহণযোগ্য নয়। সাহাবিদের মধ্যে ভুল থাকতে পারে, ভিন্নমত থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলো নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার আমাদের নেই। বিশেষ করে যারা নির্ভরযোগ্য সাহাবী ছিলেন, যারা দুনিয়া থেকে বেহেস্তের সুসংবাদ প্রাপ্ত ছিলেন তাদের বেপারে কোনো অপোষ নেই। যে কারনে জামায়াতের প্রতিষ্ঠতা মাওলানা মওদুদির সাথে আমাদের উপমহাদেশের আলেমদের প্রধান মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। মাওলানা মওদুদি নির্বাচিত দশ সাহাবিদের মধ্যে অন্যতম একজনের সমালোচনা করেছেন খোলাখুলি ভাবে। যা কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য মনে করেননি আলেমগণ।

আমি জানি সৈয়দ ফয়জুল করিম প্রচন্ড ব্যাস্ত একজন মানুষ। নিজের সমাজ, সংসার, ব্যবসা তো আছেই। সাথে বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি, ইসলামি আন্দোলনসহ আরো কতো কী। প্রতিদিন তাকে একাধিক মাহফিল অথবা রাজনৈতিক প্রোগ্রাম করতে হয়। কতো বড়বড় বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরতে হয় তা ভুক্তভুগি ছাড়া কারো পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয়।

বিশেষ করে যখন চরমোনাইর মাহফিল হয়- এতবড় দায়িত্ব, এত মানুষের জিম্মাদারি মাথায় নিয়ে সব কিছু ঠিকঠাক পরিচালনা করা, বয়ান করা আমার কাছে কিছুটা অলৌকিকই মনে হয়। সরাসরি আল্লাহর রহমত ছাড়া এই চাপ সহ্য করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব বলে আমি মনে করি না। সুতরাং ভুল হওয়া তার বা তাদের পক্ষে অবাস্তব কোনো বিষয় নয়। তারাও সকল প্রকারের মানবিক ত্রুটিপূর্ণ মানুষ। পার্থক্য হলো তারা যতো সহজে মানবিক ত্রুটি দমন করতে পারেন, সাধারণ মানুষ তা পারে না। এ কারনেই তারা বিশেষভাবে সম্মানিত।

এরপরেও আমি মনে করি অনাকাঙ্খিত বিতর্কের দায় সব থেকে বেশি তার। তরুণ আলেম হারিবুর রহমান মিসবাহ ফেসবুকে লিখেছেন, অসাবধানতামূলক বিষয়টি কেউ তাকে বলেনি। কেউ তাকে ধরিয়ে দেয়নি। এই কথার অর্থ কী দাঁড়ায়?

আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, তেলবাজ, ঠিক ঠিকবাজ, মোসাহেবদের থেকে নিজেকে মুক্ত রাখুন। ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বিষয়ে আলাদা আলাদা ব্যক্তিগত সচিব বা উপদেষ্ট নিয়োগ দিন। নেতাকর্মীদের মধ্যে ভয়মুক্ত কথা বলার সুযোগ তৈরী করুন। ব্যস্ততা কিছুটা কমিয়ে নিজেকে সময় দিন।

মনে রাখা দরকার, দশটা গতানুগতিক মাহফিলের করার চেয়ে একটা কোয়ালিটি মাহফিল করা অনেক ভালো। বর্তমান মিডিয়ার যুগে একটা কোয়ালিটি বয়ান হাজারটা সাধারণ বয়ান থেকে অনেক বেশি কাজে আসে। তাছাড়া আপনাদের মতো দায়িত্বশীল বড় মানুষদের কাছ থেকে অসর্তমূলক কথা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হয় না।

/আরএ

Comments