আফ্রিকা সংকট

রাশিয়া কি ইউক্রেন থেকে পশ্চিমাদের নজর সরাতে চাইছে?

শাহনূর শাহীন শাহনূর শাহীন

লেখক ও মনোস্বাস্থ্য সাংবাদিক

প্রকাশিত: ৬:৪৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৩
  • এশিয়া-আফ্রিকায় নজর দিতে গিয়ে পশ্চিমাগোষ্ঠী ইউক্রেন ছেড়ে আসবে কিনা; হয়ত তেমনটাই ছঁক কষছেন পুতিন। এমতঅবস্থায় স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে রাশিয়া কি ইউক্রেন থেকে পশ্চিমাদের নজর সরাতে চাইছে?

এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই আপাতত। পূর্ব-ইউরেশিয়ার দেশ দুটিতে চলমান যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করছে পুরো পৃথিবীবাসী। এই পরিস্থিতিতে দরজায় কড়া নাড়ছে আরো দুটি বহুপক্ষীয় যুদ্ধ। চীন প্রস্তুতি নিচ্ছে তাইওয়ান দখলের। যেকোনো সময় তাইওয়ানে হামলা করতে পারে চীন। গেল মাসের শুরুর দিকে তাইওয়ান সীমান্তে পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) কমান্ড পরিদর্শনে গিয়ে দেশটির সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

জুলাই, ২০২৩-এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহজুড়ে যখন চীন-তাইওয়ান যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ছিল তুঙ্গে ঠিক সেই মুহূর্তে ওয়াশিংটন-বেইজিংয়ে চলা বাড়তি উত্তেজনার মধ্যেই চীন সফর করেন মার্কিন অর্থমন্ত্রী। এই উত্তেজনা চলছে কয়েকমাস ধরেই। এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থির সাথে বৈঠক করেন তাইপে প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন। মধ্য আমেরিকা সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রে দুইদফা যাত্রাবিরতি নেন সাই ইং। এর পর থেকেই মূলত ত্রিমুখী উত্তেজনা বাড়তে থাকে।

কিছুদিন পর জুনের মাঝামাঝি চীন সফরে আসেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তাইওয়ান প্রশ্নে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কোনো ইশারা না পেয়ে হুমকি-ধমকি দিতেই থাকেন শি জিনপিং সরকার। জুলাই মাসজুড়ে তাইওয়ান প্রণালিতে দফায় দফায় চীনের সামরিক মহড়া আর তাইওয়ানের সতর্ক দৃষ্টি ব্যাপক ঘনীভ‚ত হয়। সেই উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হতে না হতেই দৃষ্টি চলে যায় আফ্রিকায়।

প্রশান্ত মহাসাগরে চীন-রাশিয়ার যৌথ সামরিক মহড়া

মাসের শেষে এসে গত ২৬ জুলাই, বুধবার মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজারে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার ভেঙে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বাহিনী। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন দেশটির প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ডের প্রধান জেনারেল আব্দুর রহমান তিয়ানি।

পরবর্তীতে ২৮ জুলাই, শুক্রবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে নিজেকে দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন জেনারেল তিয়ানি। অভ্যুত্থানের পর থেকেই বন্দি রয়েছেন দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বাজুম। অভ্যুত্থান কার্যকলাপে স্পষ্টতই বুঝা যায় রাশিয়ার পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতায় এই অভ্যুত্থান ঘটেছে। ক্ষমতা দখলের পর সামরিক বাহিনীর সমর্থকরা নাইজার ও রাশিয়ার পতাকা হাতে নিয়ে আনন্দ উদযাপন করেছে।

এই ঘটনায় প্রতিবেশি দেশ নাইজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত তিনদিন ধরে চলা বৈঠক শেষে ৩০ জুলাই (রোববার) আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় জোট ‘দ্য ইকোনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস’ (ইসিওডব্লিউএএস বা ইকোওয়াস) এক জরুরি শীর্ষ সম্মেলন করে বাজুমকে এক সপ্তাহের মধ্যে পুনর্বহাল করার দাবি জানায়। অন্যথায় ব্লকটি সাংবিধানিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সামরিক পদক্ষেপের হুমকি দেয়। ওই সম্মেলনের পর প্রেস বিফিংয়ে ইকোওয়াসের রাজনীতিবিষয়ক কমিশনার আবদেল ফাতাউ মুসাহ বলেছেন, ইকোওয়াস যেখানে যখন অভিযান চালাবে, সেখানে তারা অভ্যুত্থানকারীদের কোনো ছাড় দেবেন না।

পশ্চিম আফ্রিকান জোটটি সেদিনই জানায়, সতর্ক করার সময় নেই, এখন পদক্ষেপ নেওয়ার সময়। এক সপ্তাহের সেই আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার পর আরো কয়েকদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ইকোওয়াস। এর মধ্যে তারা বিষয়টি কূটনৈতিকভাবে সমাধের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।

সুতরাং ধারণা করা হচ্ছিলো যেকোনো সময় সামরিক অভিযানে যাবে আঞ্চলিক এই জোট। ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক নানা বিভিন্ন সহযোগিতা বন্ধ ও নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। মার্কিন সরকারও সহায়তা বন্ধ করবে বলে জানিয়েছে। এরইমধ্যে গত বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) আফ্রিকান এই জোটের শীর্ষ নেতারা নাইজারে সামরিক হস্তক্ষেপের অনুমোদন দেন। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে সামরিক সরকার। আগেই আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করেছে সামরিক সরকার।

টানটান এই উত্তেজনার মধ্যে মালি সফর করেছে অভ্যুত্থানকারী সামরিক সরকারের এক শীর্ষ জেনারেল। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেখানে অবস্থানরত রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনী ভাগনারের সহায়তা চেয়েছে নাইজার সামরিক বাহিনী। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউফান সেন্টারের ওয়াসিম নাসেরের সূত্রে ৬ আগস্ট এ খবর জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এপি। ওয়াসিম নাসের এপিকে বলেছেন, অভ্যুত্থানকারী নেতা জেনারেল সালিফো মোদি সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ মালি সফর করেছেন। সেখানে তিনি ভাগনারের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করে ভাড়াটে যোদ্ধাদের সহযোগিতা চেয়েছেন।

ধারণা করা হচ্ছে ভাগনার বাহিনী নাইজার সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করবে। কেননা, সামরিক শাসকরা রাশিয়াপন্থী এবং আগে থেকেই মালি ও বুরকিনা ফাসোর সামরিক শাসকদের সহায়তা করে চলছে ভাগনার বাহিনী। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমা ও ইউরোপীয়রা গণতান্ত্রিক সরকার ফেরাতে সামরিক অভিযানে সমর্থন দিবে। বিষয়টি গভীরভাবেই পর্যবেক্ষণ করছে পশ্চিমারা। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের একজন সামরিক কর্মকর্তার বরাতে এপি জানিয়েছে, সামরিক হস্তক্ষেপের পদক্ষেপ নিলে প্রেসিডেন্ট বাজুমকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছে জান্তা সরকার।

নাইজার সামরিক জান্তার বিশেষ প্রতিনিধি যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি অফ স্টেট ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডকে এ হুমকি দিয়েছেন। সতর্ক করেছে জান্তা সরকারের নিরব সমর্থক রাশিয়াও। মস্কো বলছে, সামরিক হস্তক্ষেপ দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষের সৃষ্টি করবে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, নাইজারে সামরিক হস্তক্ষেপ হলে পুরো অঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হবে।

এই ঘটনার আগে জান্তা সরকারের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছে আগে থেকেই সামরিক শাসনে থাকা দেশ মালি ও বুরকিনা ফাসো। যৌথ বিবৃতিতে দেশ দুটি বলেছে, নাইজারে সামরিক হস্তক্ষেপ তাদের দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার সমান। তারা বলছে, নাইজারে যেকোনো ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপ করা হলে মালি ও বুরকিনা ফাসোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ভৌগোলিকভাবে আফ্রিকার মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত হওয়া এবং প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে নাইজার।

২০২১ সালে অনুষ্ঠিত ভোটে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন বাজুম। নির্বাচিত হওয়ার পর নাইজারের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করেছিলেন প্রেসিডেন্ট বাজুম। তিনি পশ্চিমাপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যা এই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় রাশিয়ার জন্য বড় বাধা হিসেবে বিবেচিত। অন্যদিকে পুতিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শি জিনপিং তো প্রকাশ্যেই সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। এটা যে, শুধুমাত্র কথার কথা না সেটা সাম্প্রতিককালে চীনের বিভিন্ন রসদ মজুদের দিকে তাকালে সন্দেহ আরো প্রগাঢ় হবে। দশ বছর ধরেই জ¦লানি তেল মজুদে নজর দিয়েছে চীন। বিগত বছর থেকে সেটার পরিমাণ বেড়েছে কয়েকগুণ।

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিদিনের আমদানি হিসাবে লাখ থেকে কোটি ব্যারেলে পৌঁছেছে চীনের জ্বালানি পরিসংখ্যান। বাড়িয়েছে খাদ্যশস্য, বিশেষত সয়াবিন আমদানি। শূকরের খাবার জোগাতে সয়াবিন আমদানি বৃদ্ধির মানে হলো পর্যাপ্ত মাংস মজুদ করা। দেশটির মোট মাংস চাহিদার ৬০ ভাগ শূকরের। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে অত্যাধুনিক অস্ত্র তৈরীতে ব্যবহৃত বিশেষ দুটি ধাতু বেরিলিয়াম ও নিওবিয়াম আমদানি বাড়িয়েছে জিনপিং সরকার।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন

এসব কিছু যুদ্ধের আলামতই প্রকাশ করে। খুব সম্ভবত তাইওয়ান দখলে আর বেশি সময় অপেক্ষা করতে চাইছেন না জিনপিং। গেল বৃহস্পতিবারও (১০ আগস্ট) তাইওয়ানের আকাশসীমায় ৩৩টি যুদ্ধবিমান ও ছয়টি রণতরি পাঠিয়েছেন জিনপিং। বিমানগুলোর মধ্যে ১০টি বিমান তাইওয়ানের ‘এয়ার ডিফেন্স জোনে’ ঢুকে পড়েছিল বলছে স্বশাসিত তাইপের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এই অবস্থায় পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই শনিবার (১২ আগস্ট) যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে উড়াল দিয়েছেন তাইওয়ানের ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম লাই। উইলিয়ামের এই সফরকে স্পর্শকাতর সফর বিবেচনা করা হচ্ছে। খবর প্রকাশ হওয়া মাত্রই কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চীন। চীন থেকে নাইজার; উত্তর-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে আটলান্টিক সাগরের পূর্বপাড়। যেন অসম দৌঁড়ের লড়াই। ইউক্রেনে মনযোগ ধরে রেখে কোনদিকে যাবে যুক্তরাষ্ট্র? আফ্রিকা নাকি এশিয়া?

জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে মনে হয়েছিলো এই বুঝি তাইওয়ানে আক্রমণ করছে চীন। সেই পরিস্থিতি কিছুটা প্রশমিত হতেই নাইজারে সামরিক অভ্যুত্থান। নজর চলে যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে সোজা মধ্য আফ্রিকা। সর্বশেষ দুই প্রান্তেই বাজছে যুদ্ধের দামাম। এই পরিস্থিতিতে এশিয়া-আফ্রিকায় নজর দিতে গিয়ে পশ্চিমাগোষ্ঠী ইউক্রেন ছেড়ে আসবে কিনা; হয়ত তেমনটাই ছঁক কষছেন পুতিন। এমতঅবস্থায় স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে রাশিয়া কি ইউক্রেন থেকে পশ্চিমাদের নজর সরাতে চাইছে?

/এম.বি.নূর/একুশনিউজ/

Comments