লাশঘরে চলছে ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট

প্রকাশিত: ১০:১০ অপরাহ্ণ, জুলাই ৩, ২০১৯

মোঃ ইলিয়াস আলী, নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর ভাতুরিয়া এলাকায় আত্মহত্যায় মৃত্যু হয় গৃহবধূ হাজেরা বেগমের। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হাজেরার লাশ গ্রামে নিতে হাসপাতালে বিভিন্ন রোগীর স্বজন মিলে তার বৃদ্ধ মা সালেহা বেগমের হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেন। মরদেহ পরের দিন মর্গে পাঠায় পুলিশ। ময়নাতদন্ত করতে সেই টাকা মর্গে দিতে হয়েছে ওই মায়ের। এমন চিত্র দেখা যায় ঠাকুরগাঁওয়ের সদর আধুনিক হাসপাতালে। মর্গে লাশ আটকে টাকা নেওয়ার প্রমাণও পাওয়া যায়।

মরেও যেন রেহাই নেই। মর্গে চলছে ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট। টাকা ছাড়া লাশ ফিরে পান না পরিবারের লোকজন। অথচ সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী মর্গে বিনা টাকায় ময়নাতদন্ত হওয়ার কথা। পাশাপাশি পুলিশ রেজুলেশন অব বেঙ্গল বা পিআরবির প্রবিধি অনুযায়ী মর্গ থেকে লাশ হস্তান্তরের সময়েই পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি তুলে দিতে হবে। সে অনুযায়ী মর্গেই লেখার কথা প্রতিবেদনটি। অবশ্য বাস্তবতার কারণে সরকারি নির্দেশনায় সে সময়টা বৃদ্ধি করে ২৪ ঘণ্টা করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, টাকা ছাড়া লাশঘর থেকে লাশ বের হয় না। ময়নাতদন্তের সময় নানা খাত দেখিয়ে নিহতের স্বজনের কাছ থেকে ২ হাজার থেকে শুরু করে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার বিধিটাও সরকারি নির্দেশনাতেই আটকে আছে। কোনো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনই নির্ধারিত সময়ে দেওয়া হয় না। ঘণ্টা পার হয়ে দিন, মাস আর বছর চলে গেলেও বেশিরভাগ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনই পাওয়া যায় না।

জানা যায়, ময়নাতদন্ত বিভাগের বিভিন্ন কর্মী সংশ্নিষ্ট মামলায় পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এই টাকা নেন। নিহতের পরিবার এই টাকার উৎস হলেও অজ্ঞাতপরিচয়ে লাশের স্বজন না থাকায় আটকে থাকে সেসব ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। কোনো কোনো ঘটনায় মামলার চার্জশিট জমা নিয়ে সময়ের বাধ্যবাধকতা থাকায় পুলিশের সংশ্নিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার পকেটের টাকা খরচ করেই নিতে হয় সেই প্রতিবেদন।

অনুসন্ধান ও বিভিন্ন থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দ্রুত পাওয়া যায়। তবে আত্মহত্যা বা অজ্ঞাতপরিচয়ে উদ্ধার লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন মাস থেকে বছর পার হলেও তা আর তৈরি হয় না। প্রতিবেদন তৈরিতে বিলম্বের সুযোগে কখনো কখনো বদলে ফেলা হয় মৃত্যুর আসল কারণ। ময়নাতদন্ত থেকে প্রতিবেদন দেওয়ার দীর্ঘ সময়ের কারণে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে চিকিৎসক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তার। বিভিন্ন সময় ভুক্তভোগীরা টাকার বিনিময়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বদলে দেওয়ার অভিযোগ তুলে আসছেন।

পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পিআরবি বিধি অনুযায়ী ময়নাতদন্ত শেষে লাশের সঙ্গে পুলিশ সদস্য বা কনস্টেবলের কাছে হস্তান্তর করা কার্বন কপিটিই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। কিন্তু বিস্তারিত রিপোর্ট দেওয়ার কথা বলে তাতে বিলম্ব করা হয়। এই বিলম্বের মধ্যেই ঘটতে পারে অঘটন। বিধি অনুযায়ী পোস্টমর্টেম রিপোর্ট একটিই। বিস্তারিত রিপোর্ট বলে আইনে বা বিধিতে কিছু নেই।

সূত্রে জানা যায়, লাশকাটা ঘরের চিত্রই ভিন্ন। মর্গে চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে বাইরে থেকে এসে যারা কাজ করেন, লাশের স্বজনের আবেগকে জিম্মি করে বিভিন্ন খাতের নামে তারা এই টাকা হাতিয়ে নেন। এ জন্য মর্গে রীতিমতো সিন্ডিকেটও গড়ে উঠেছে।

এদিকে টাকা নিয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন উল্টে দেওয়া বা টাকা ছাড়া প্রতিবেদন না পাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের আরএমও।

জানতে চাইলে সিভিল সার্জন ডা. এইচএম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সব মানুষ তো লোভের ঊর্ধ্বে নয়। সেই লোভের প্রস্তাবটা কারা দেয়, তা খুঁজে বের করা উচিত। ময়নাতদন্ত আটকে বা তথ্য ঘুরিয়ে দিয়ে টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই।

দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, হয়তো মেডিকেল কলেজগুলোতে এই সুযোগটা একেবারেই কম। কিন্তু মফস্বলের মর্গে নানা কারণে এমনটা হতে পারে। সেখানে প্রভাবিত হওয়ার যেমন পরিবেশ থাকে, তেমনি রক্তচক্ষুও উপেক্ষা করা যায় না। তাছাড়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চিকিৎসক আর পুলিশের মধ্যকার কাজ হলেও বাদী বা বিবাদী পক্ষও এসে প্রভাব দেখায়। লোভে ফেলার চেষ্টা করে। অনেক সময়ে খোদ তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার প্রভাবও থাকে।

পুলিশ কর্মকর্তার প্রভাব বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আটকে আছে শত শত ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, পুলিশ সূত্রে জানায়, সাধারণত অপমৃত্যুর মামলাগুলোর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আটকে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। এজন্য মামলার পুলিশি তদন্ত শেষ হলেও অভিযোগপত্র দেওয়া যায় না। এর ফলে বিচার কাজে দীর্ঘসূত্রতা এবং মামলার নিষ্পত্তিতেও সময় লাগে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দীর্ঘ সময় ধরে জেলায় শতাধিকের বেশি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আটকে আছে।

এমএম/

Comments