আইনের ভুল ব্যাখ্য বলছেন শীর্ষ আইনজীবিরা

খালেদার বিদেশে চিকিৎসায় আইন মন্ত্রণালয়ের না, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া বিএনপির

প্রকাশিত: ১১:৪৬ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১, ২০২৩

কয়েকদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য অনুমতি প্রদান প্রসঙ্গে আলোচনা চলছিলো। আইমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসনের ভাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন করলে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে বলেই গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়।

দেশের বিশিষ্ট আইনজীবিরাও এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রচলিত আইনে অনুযায়ী নির্বাহী আদেশেই খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করা যায়। গত ২৯ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আইনজীবিদের মতামত তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশের অন্যতম শীর্ষ গণমাধ্যম দৈনিক প্রথম আলো।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্ন আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে বলে মনে করেন তিনি। দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবি খুরশীদ আলম এবং জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নাও একইরকম ব্যাখ্যা তুলে ধরেন গণমাধ্যমে।

দেশের অন্যতম জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত ও মুক্তি আদালতের নির্দেশে হয়নি। সরকার নির্বাহী আদেশে তা করেছে। ফলে মন্ত্রীরা এখন আদালতের এখতিয়ারের কথা বললে, সে বক্তব্য ঠিক নয়। এটি সরকারের বিবেচনার বিষয়।

এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম বলেন, আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদন খারিজ করেছিলেন। কিন্তু আদালতকে কিছু না জানিয়ে সরকার মানবিক দিক বিবেচনার কথা বলে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছিল। ফলে বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এরমধ্যে গত শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) আইনমন্ত্রী রোববার সিদ্ধান্ত জানানোর কথা বলেছিলেন। আলোচনা-পর্যালোচনার মধ্যেই কোন দেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হবে সে বিষয়ে খোঁজ খবরও নিচ্ছিলেন বেগম জিয়ার পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু এরইমধ্যে রোববার (১ অক্টোবর) আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন বিদেশে চিকিৎসার জন্য অনুমতি দেওয়ার আইনত সুযোগ নেই।

এর জন্য সম্প্রতি ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাতকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিদেশে যেতে হলে বর্তমানে নিবার্হী আদেশে থাকা শর্ত সাপেক্ষে মুক্তির আদেশ বাতিল করে আদালতে যেতে হবে।

খালেদার বিদেশে চিকিৎসার আবেদনে আইনমন্ত্রণালয়ের ‘না’

দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে কখনো কেবিনে কখনো সিসিইউতে অবস্থান করছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তাঁর লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্‌যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তাঁর স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। এ কারণে তাঁকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। মেডিকেলে বোর্ডের চিকিৎসকরাও এই মূহুর্তে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানো জরুরি।

সেজন্য চিকিৎসকদের সুপারিশসহ খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) আবেদন পাঠান বেগম জিয়ার ভাই শামীম এস্কান্দার।

এমন অবস্থায় খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদন বাতিল করাকে অমানবিক বলছেন বিএনপি নেতারা। এর প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ প্রদিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের নেতিবাচক সিদ্ধান্ত মানবতাবিরোধী, বর্বর ও অবিচারের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রে দেওয়া বক্তব্যেরই প্রতিফলন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।

রিজভী বলেন, দেশে সুশাসন ও ন্যায়বিচার ‘কঙ্কালে’ পরিণত হয়েছে। খালেদা জিয়ার জীবন, বেঁচে থাকা এবং উন্নত চিকিৎসার সবকিছু প্রধানমন্ত্রী আর আইনমন্ত্রীর তামাশার বৃত্তে আটকে রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। এখন তাঁর উন্নত চিকিৎসায় বাধা দিয়ে দুনিয়া থেকে সরানোর নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

আইন সংশোধন করে হলেও খালেদাকে বিদেশ পাঠানোর দাবি আ’লীগ নেতার

এ বিষয়ে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যরিস্টার কায়সার কামাল বলেন, এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয়েছে দেশে আইনের শাসন নেই। এর মাধ্যমে খালেদা জিয়ার প্রতি এক ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, সরকার চাইলেই নির্বাহী আদেশে তাঁকে মুক্তি দিতে পারতেন এবং বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে পারতেন।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে রাজবন্দীদের মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসা করানোর দৃষ্টান্ত রয়েছে বলে উল্লেখ করে ব্যরিস্টার কায়সার কামাল বলেন, খালেদা জিয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এর ব্যাখ্যায় কায়সার কামাল বলেন, ‘আইনমন্ত্রী পাবলিক স্টেটমেন্ট দিয়ে বলেছিলেন খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে যদি আবেদন করা হয়, সেটি সুবিবেচনা করা হবে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার গত ২৫ সেপ্টেম্বর আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সেই আবেদনটি আইনগতভাবে বিবেচনা না করে, রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফলাফল আজকে আমরা এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি।’

অনুমতি না দেয়ার প্রসঙ্গে এক ব্যাখ্যায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় কোনো দরখাস্ত যদি একবার নিষ্পত্তি করা হয়, সেই নিষ্পত্তি করা দরখাস্ত পুনর্বিবেচনা করার অবকাশ আইনে থাকে না। আমরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর উপধারা ১, ২, ৩, ৪, ৫ এবং সর্বশেষ উপধারা ৬ ব্যাখ্যা করে মতামত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। সেই মতামত হচ্ছে, ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে যে দরখাস্ত নিষ্পত্তি করা হয়েছে, সেটি অতীত ও শেষ হয়ে গেছে। এটি আর খোলার কোনো উপায় নেই।

রোববার (১ অক্টোবর) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের কাছে এ বিষয়ে বিস্তারিত আইনি ব্যাখ্যা তুলে ধরেন তিনি। এ সময় একজন সাংবাদিক জানতে চান, এই অবস্থায় যদি খালেদা জিয়ার পরিবার তাঁকে বিদেশে পাঠাতে চায়, তাহলে কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, তিনি বারবারই বলছেন, সেটি হলো তাঁকে ফৌজদারি ৪০১ ধারায় দুটি শর্তযুক্তভাবে যে আদেশবলে সাজা স্থগিত রেখে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেটি বাতিল করে তারপর আবার পুনরায় বিবেচনা করার সুযোগ থাকলে তা করা হবে।

আইনমন্ত্রী বলেন, প্রথম যে আবেদনটি ছিল, যা ২০২০ সালের মার্চে নিষ্পত্তি হয়, সেই আবেদনে বলা ছিল, খালেদা জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ, তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা যেন করা হয়। তখন দুটি শর্তে তাঁর দণ্ডাদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এটি ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর উপধারা-১-এর ক্ষমতাবলে দেওয়া হয়েছিল। শর্তগুলো হলো, প্রথমত তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন। দ্বিতীয়ত, তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। সেই শর্তগুলো মেনে খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্ত হন এবং বাসায় ফিরে যান। সেভাবেই সেই দরখাস্ত নিষ্পত্তি করা হয়। তবে প্রতি ছয় মাস বৃদ্ধি করা যাবে কি না, বিষয়টি উন্মুক্ত ছিল। এরপর সেই সময় ছয় মাস করে মোট আটবার বাড়ানো হয়েছে।

এ বিষয়ে সম্প্রতি ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে আইনমন্ত্রীর কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপমহাদেশে ৪০১ ধারার ক্ষমতা যখন সরকার প্রয়োগ করে, তখন সেটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় না বলে সিদ্ধান্ত আছে। প্রধানমন্ত্রী যেটা বলেছেন, ‘‘সেটি হচ্ছে, এখন যে আদেশ আছে, সেটি যদি বাতিল করা হয়, বাতিল করে তাঁকে যদি আবার কারাগারে নেওয়া হয়, তাহলে আদালতে যেতে পারেন। এই অবস্থায় তিনি আদালতে যেতে পারেন বলে এ রকম সুযোগ নেই। তখন একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, তাহলে সেই আদেশ বাতিল করা হবে কি না। জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, বাতিল করাটি অমানবিক হবে, বাতিল করব না।’’

বিদেশ যেতে হলে খালেদাকে আবার জেলে যেতে হবে : শেখ হাসিনা

দুর্নীতির দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দী হন। দুই বছরের বেশি সময় কারাবন্দী ছিলেন তিনি। দেশে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে ওই দুই শর্তে মুক্তি দিয়েছিল। এরপর দফায় দফায় সময় বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ১২ সেপ্টেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ আগামী ২৫ মার্চ পর্যন্ত আরো ছয় মাস বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

Comments