যেভাবে লাগামহীন খেজুরের দাম

শাহনূর শাহীন শাহনূর শাহীন

লেখক ও মনোস্বাস্থ্য সাংবাদিক

প্রকাশিত: ১১:১২ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ৭, ২০২৪

দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র মাহে রমজান। রজমানের আগমনী বার্তার মাস শাবান ইতোমধ্যে শেষের পথে। এ মাসেই রমজানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা। মধ্যপ্রাচ্যে আগামী ১১ মার্চ সম্ভাব্য রমজান শুরু। এরপরের দিনই বাংলাদেশের রোজা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রমজানে দিনভর পানাহারা ও স্ত্রী সম্ভোগ থেকে বিরত থেকেও ইফতার ও সাহরীতে রোজাদারদের পাতে যেন উৎসব নেমে আসে। সারাদিন খাবার খাওয়া থেকে বিরত থেকেও আনন্দের কমতি থাকে না রোজাদার মুসলিমদের।

সারাদিনের উপোস থাকার ক্লান্তি মুহূর্তেই উড়ে যায় ইফতারিতে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে এক গ্লাস শরবত আর একটি খেজুর শরীরে ভরপুর সতেজতা নিয়ে আসে। ইফতারিতে ফল খাওয়া সুন্নত। কিন্তু ফল হিসেবে ইফতারিতে সবার পছন্দ। দেশীয় ও বিদেশি নানান ফলের সঙ্গে খেজুর যেন অপরিহার্য। বরাবরই দেশে রমজান মাসে খেজুরের চাহিদা বেড়ে যায়।

প্রতি বছর ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি খেজুরের চাহিদা তৈরি হয় রমজান মাসে। রমজানে ধনী-গরীব সবার পাতেই খেজুর থাকা পরিচিত দৃশ্য। মানভেদে দামের কমবেশি হলেও খেজুর না হলে যেন ইফতারিটাই পানসে লাগে। কিন্তু এ বছর ইফতারির সেই অপরিহার্য উপদানে ভাটা পড়েছে।

খেজুরের আকাশ ছোঁয়া দামের কারণে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তারাও খেজুর পরিহার করতে যাচ্চেন। বাজারের রমজানের কেনাকাটা শুরু হলেও খেজুরের কাটতি নেই বললেই চলে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই উঠে এসেছে।

ঢাকার বাজারে মোটামুটি মানের সবচেয়ে বেশি পরিচিত খেজুর আজোয়া। গতবছর এই খেজুর বিক্রি হয়েছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে। এ বছর ১ হাজার টাকাতেও আজোয়া পাওয়া যাচ্ছে না। সবচেয়ে কমদামের খেজুর ‘জাহেদি’র দামও এবার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে।

গত বছর এই খেজুর ১২০-১৫০ টাকায় পাওয়া গেলেও এবছর খুচরা বাজারে এর দাম উঠেছে ৩০০ টাকা। মূলত আমদানিকারকদের কেনা প্রকৃত দরের ওপর এনবিআর একটি অতিরিক্ত মূল্য বসায়, যেটাকে বলা হয় অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু। তারপর সেটার ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়।

যেমন ১০০ ডলারের এক কার্টন খেজুরের দাম দেখানো হয় কমপক্ষে ২৫০ ডলার। তারপর সেটার ওপর কেজি প্রতি সমমূল্যের সমান শুল্ক আরোপ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ফলে দুই ধাপে খেজুরের দাম আকাশ ছোঁয়া হয়েছে। বিষয়টিকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না স্বয়ং ব্যবসায়ীরাও।

বিক্রেতারা বলছেন, ক্রেতারা দোকানে এসে খেজুরের দাম জিজ্ঞেস করে চলে যায়। যাওয়ার সময় গালাগাল করে যায়। তারা অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। কারণ, দাম তো তারা বাড়াচ্ছেন না। ক্রেতারা সাধারণত এসবের খবর রাখেন না যে, কোথা থেকে আসলে দাম বাড়ে।

আমদানিকারকরা বলছেন, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের কারণেই এবছর খেজুরের বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ বছর খেজুরকে বিলাসী পণ্যের তালিকায় ফেলে রাজস্ব বসিয়েছে। যার কারণে খেজুরের দাম বেড়েছে লাগামহীনভাবে। বিশ্ববাজারে এক কেজি খেজুর যে দরে কেনা তার দ্বিগুণ ও কোনোটায় দ্বিগুণেরও বেশি শুল্ক দিতে হয়।

মোটামুটি মানের খেজুরের মধ্যে বাজারে এবার বেশি দেখা যায় আজোয়া, মরিয়ম ও মেডজুল। আজোয়া প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা। মরিয়ম ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা ও মেডজুল ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা। এছাড়া মাবরুম ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা, দাবাস ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, সুক্কারি ও কলমি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা কেজি।

সবচেয়ে কম দামের জাহেদি খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৪৫০ টাকা কেজি। দুবাইয়ের বাজার থেকে এই খেজুর আমদানিকারকরা বাংলাদেশি মুদ্রায় মাত্র ৯৯ টাকা কেজিতে কেনেন। কিন্তু দেশের আনার পর এই খেজুরে কেজি প্রতি দামের চেয়েও বেশি পরিমাণ টাকা সরকারকে শুল্ক দিতে হয়। যার পুরো ভার এসে পড়ে ভোক্তার ঘাড়ে।

রাজধানীর ফলের বড় আড়ৎ বাদামতলীর ফল পট্টি। বৃহৎ এই ফলের বাজারে দেখা যায়, সেখানে জাহেদি খেজুর কেজি প্রতি ২৫০-২৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেখান থেকে পাইকারি বিক্রেতারা কিনে খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন ২৭০-২৮০ টাকায়। ভোক্তা পর্যায়ে সেই দাম পড়ছে ৩০০-৩৫০ টাকা।

আমদানিকারকরা বলছেন, গত বাজেটের পর থেকে খেজুরে যে পরিমাণ শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, সে কারণেই খেজুরের এই বাড়তি দাম।

আমদানিকারকদের তথ্য বলছে, এনবিআরের বিলাসীতায় এবার ১১০ টাকা কেজি দরের খেজুরে ১৪০ টাকা শুল্ক দিতে হচ্ছে। এরপর লাভের অংক যোগ করে সেটা বাজারে বিক্রি করতে হয়। অন্যদিকে ১২০ টাকা কেজি দরের খেজুরে শুল্ক দিতে হয় ২১০ টাকা। এভাবে মানভেদে সব ধরনের খেজুরে দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণের বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে খেজুরে। একারণেই এবার খেজুরের দাম লাগামহীন।

ইাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পল্টনের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সরকার সব সময় বলে তারা জনবান্ধব, ধর্মবান্ধব। কিন্তু হজের সময় দেখি হজযাত্রীদের বিমানের ভাড়া অন্য সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। মনে হয় শুধু ধর্মপ্রাণ হজ যাত্রীদের ঘাড়ে ভর করেই সরকার বিমানের লোকসান মেটাতে চায়। আবার এখন রমজানের আগে দেখছি রোজাদারের পছন্দের খেজুর দিয়েই রিজার্ভের ঘাটতি মেটাতে চায়।’

শনির আখড়ার উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী ইয়াসিন আহমাদ বলেন, ‘গত বছর আমরা আজোয়া খেজুর খুচরা বিক্রি করেছি ৫৫০-৬০০ টাকার মধ্যে। খেজুরের ওপর শুল্ক আরোপ করা এক ধরনের অজ্ঞতাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। সরকারে সংশ্লিষ্ট দপ্তর কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এমনটা করেছেন বুঝে উঠতে পারছি না। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নজর দেওয়া উচিত। কী কারণে, কোন উদ্দেশ্যে খেজুরে এমন উচ্চ শুল্ক ধরা হয়েছে তা খুঁজে বের করা উচিত।’

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফআইএ) সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, গত ৩৫ বছর ধরে আমি খেজুর আমদানি করি, কিন্তু কখনো শুল্ক দিতে হয়নি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই শুল্ক যুক্ত করা হয়েছে। অথচ গত বছর এক কেজি খেজুরে মাত্র ১০ টাকা শুল্ক দিতে হয়েছে। অন্যদিকে এ বছর শুল্ক দিতে হচ্ছে কেনা দরের দ্বিগুণেরও বেশি।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফআইএ) জানায়, সাধারণ কনটেইনার খেজুরের জন্য ২ হাজার ৫০০ ডলার এবং হিমায়িত কনটেইনারে খেজুরের জন্য ৪ হাজার ডলার শুল্ক নির্ধারণ করেছে এনবিআর। এতে করে খেজুরের দাম দুই থেকে তিনগুণ বেড়েছে। আগে কেজি প্রতি খেজুরে ৫ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ২১ টাকা ৮৪ পয়সা শুল্ক দিতে হত। অন্যদিকে বিএফএফআইএ সূত্রে জানা যায়, এবার ১০ শতাংশ শুল্ক কমানোর ঘোষণার পরও প্রতি কেজিতে শুল্ক দিতে হচ্ছে কেজি প্রতি ৫৪ টাকা থেকে ১৪৬ টাকা পর্যন্ত। এমনকি মানভেদে কোনো কোনো খেজুরে একশো শতাংশেরও বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে।

গত অর্থবছরের বাজেটে তাজা ও শুকনা খেজুর আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্কের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছিল। মূলত অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালুর কারণে খেজুরের দাম লাগামহীন। অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু হল কেনা দরের তুলনায় এনবিআর কর্তৃক নির্ধারিত অতিরিক্ত ভিত্তি মূল্য।

বিএফএফআইএ সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে প্রতি টন খেজুরে শুল্কায়ন মূল্য ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৭৫০ ডলার। এর সঙ্গে কাস্টমস ডিউটি ১৫ শতাংশ, রেগুলেটরি ডিউটি ৩ শতাংশ ও ভ্যাট ১৫ শতাংশ। পাশাপাশি অগ্রিম আয়কর ও অগ্রিম কর বাবদ ৫ শতাংশ মিলিয়ে ৪৩ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা ইরাক থেকে কার্টনে ৮০০-৯০০ ডলারে যে খেজুর আমদানি করছি, সেটার অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫০০ ডলার। প্রায় তিন গুণ বেশি দাম দেখিয়ে খেজুরটার শুল্ক নেওয়া হচ্ছে। এটি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।’
তিনি বলেন, এবার ইতোমধ্যে প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন খেজুর আমদানি হয়েছে এবং শুল্কায়নের অপেক্ষায় ৪০০-৫০০ কন্টেইনার খেজুর বন্দরে আটকে আছে, যেখানে ১৫ হাজার মেট্রিক টনের বেশি খেজুর রয়েছে।

‘বাড়তি অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালুর কারণে এই খেজুরগুলো ব্যবসায়ীরা ছাড়াচ্ছে না। আর নতুন করে আমদানিও করতে চাচ্ছে না’ বলেও জানিয়েছেন ফল ব্যবসায়ীদের এই শীর্ষ নেতা।

বাংলাদেশের কাস্টমস আইন-২০২৩ অনুসারে, আমদানিকৃত পণ্যের ওপর শুল্ক নির্ধারণ হয় তার দামের ভিত্তিতে বা ওই দামের নিকটতম নিরূপণযোগ্য সমতুল্য দামের ভিত্তিতে। এই নিকটতম দাম যা নির্ধারণ করা হয়, তাই ‘অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু’।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি যেই খেজুর যে মূল্যেই আনি না কেন, কনটেইনারে খেজুর আনলে তা টন প্রতি কাস্টমসের নির্ধারিত মূল্য ২৫০০ ডলার এবং হিমায়িত খেজুর প্রত্যেক টন ৪০০০ ডলার হিসেবে শুল্ক দিতে হয়।’

রমজান ঘিরে আমদানি হওয়া সবচেয়ে কম দামের খেজুর এসেছে ইরাক, দুবাই ও তিউনিসিয়া থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব খেজুরের দাম প্রতি কেজিতে ৬৫ টাকা থেকে ৭৪ টাকা। কিন্তু চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ এসব খেজুরের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ করেছে ১২০ টাকা।

‘প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি দাম ধরে শুল্ক আদায় করছে কাস্টমস’ এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি মেট্রিক টন খেজুর ৫০০-১৩০০ ডলার দিয়ে কিনে আনার পর দেশে তার অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ধরা হয়েছে শ্রেণীভেদে ১০০০-২৭৫০ ডলার।

অর্থাৎ আমদানিকারকরা যে দামে খেজুর কেনেন, তার চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে তারপর সেটার ওপর প্রায় দ্বিগুণের সমান শুল্ক আরোপ করা হয়। সেকারণে খেজুরের দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে।

অর্থাৎ সরকারি হিসাবেই শুল্কহার কমানোর পরও ৫৪ টাকা থেকে ১৪৬ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। প্রকৃত দামের তুলনায় কয়েকগুণ। ৫৪ টাকা থেকে ১৪৬ টাকা পর্যন্ত।

এ বিষয়ে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘গরিব মানুষের তো সামর্থ নেই। চাল-ডাল কিনতেই তাদের নাভিশ্বাস। বাংলাদেশে এক কোটি লোক আছে (যারা দারিদ্রসীমার নিচে) যাদের জন্য কোনো পণ্যই বিলাসী না।’ এ বিষয়ে এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও বিষয়টি নিয়ে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

Comments