রিয়েল ভালবাসা

প্রকাশিত: ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৮

এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা আমাকে নক করে জানতে চেয়েছেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানে এমন কোন মেডিসিন বা ড্রাগ আছে কিনা যেটা খাইয়ে একটা মানুষকে মারা সম্ভব কিন্তু কোন প্রমাণ থাকবে না। কেউ বুঝতে পারবে না লোকটা কিভাবে মারা গেল। এরকম কি সিস্টেম আছে?

মানুষের বিচিত্র ইনবক্সের কারণে আমি এখন চমকে যাই না। তারপরও খানিকটা চমকে বললাম, জ্বি না। আমার জানামতে চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনো এতটা স্মার্ট নয়। আপনি যেভাবে যাকে মারতে চান না কেন, প্রমাণ থাকবেই।
– ও আচ্ছা।
– কাকে মারতে চান?
– আমার হাজবেন্ডকে!
আমি আরেকটু চমকে বললাম, উনাকে কেন মারতে চান? উনার কি দোষ?

তিনি রিপ্লেতে বললেন, কারণ আপনাকে বলব না। তবে এটা জেনে রাখুন আমি সুস্থ মানুষ। আমার দুইটা বাচ্চাকে এতিম শুধু শুধু করতে চাইছি না। নিশ্চয়ই বড় কারণ আছে। একটু বলি। তার চারিত্রিক সমস্যা খুব মারাত্মক। এতদিন সহ্য করা গেলেও আর সহ্য করতে পারছি না। মহিলা আর ইনবক্স করেন নি।

আমিও নাম ভুলে গেছি। কয়েকশ ইনবক্সের নিচে চাপা পড়া নাম খুঁজে বের করতে ইচ্ছেও করছে না।
ঈদ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু ঈদের ঘোরাঘুরি চলছে এখনো।

আমার লিস্টে মধ্যবয়সী সিনিয়র বিবাহিত মানুষের সংখ্যাই বেশি। প্রচুর পরিমাণে ফ্যামেলি ছবি দেখতে পাচ্ছি। দেশ বিদেশে ঘোরাঘুরির ছবি। হাসি হাসি মুখে সুখী সুখী চেহারার বিত্তবান দম্পত্তিদের দেখে ভালো লাগার কথা।

কিন্তু আমার খটকা যাচ্ছে না। কোন এক অদ্ভূত কারণে ফেসবুকের বেশ কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন আমি বোধহয় সাইকোলজিস্ট বা এই টাইপের কিছু একটা। সেই ধারণা থেকে অনেক মানুষের অসংখ্য জীবন কাহিনী বা সমস্যা আমার ইনবক্সে জমা হয়।
এসব সমস্যার বড় অংশই মধ্যবয়সীদের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা ভুক্তভোগী। তবে পুরুষরাও যে ভুক্তভোগী না, এমন নয়।


আমি ফ্যামেলি ট্যুরের ছবিগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখি। এক হাতে স্ত্রীর শরীর জড়িয়ে ধরে সেলফি তোলা স্বামীর হাতের দিকে তাকাই। স্পষ্ট দেখতে পাই জড়িয়ে ধরা হাতটা বহু নারীদেহ জড়িয়ে ধরতে অভ্যস্ত। আমি হাসিমুখে দাঁড়ানো পুরুষের চোখের দিকে তাকাই। ঐ চোখেও ধূর্ততা, ঐ হাসিমুখেও প্রচুর পরিমাণে খাঁদ। আমি ঐ নারীর হাসিমুখ দেখি। দেখে অনুভব করি এই হাসি এক প্রকার অভিনয়। ক্যামেরা ফ্ল্যাশ করলে হাসার নিয়ম, তাই হাসার চেষ্টা করছে।

কখনো কখনো একদম গা ঘেষে দাঁড়ানো বাচ্চাগুলোর দিকে তাকাই। ছবিতে এরা বাবা মায়ের যতটা কাছে, বাস্তবে তার থেকে অনেক দূরে।
এমনও বাচ্চা আছে যারা এমন ছবি তোলা মুহুর্ত ছাড়া বাবা মাকে কখনো এক সাথে দেখে নি। এসব জুটি সমুদ্রকে সামনে রেখে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে, পাহাড়কে পেছনে রেখে হাতে হাত রাখে, দামী খাবার সামনে রেখে মুচকি হাসে।
এদের ভালোবাসার পেছনে এই সমুদ্র, পাহাড় আর চিকেনের প্রচুর ভূমিকা। সবচেয়ে বড় ভূমিকা একটা ফ্ল্যাশওয়ালা প্রতিপ্রভা যন্ত্রের।

পাহাড়, নদী, সাগর, ঝর্ণা এবং এই অদ্ভূত যন্ত্র না থাকলে এই মানব মানবীরা কখনো হাসাহাসির সুযোগ পেত না।

কি ভাবছেন?
বেশি বলছি, কিংবা একটা সমস্যাকে হাইলাইটস করে বলার জন্য বলছি? মোটেই না।
নিজের স্বামীকে খুন করতে চাওয়া স্ত্রীর সংখ্যা একজন না। নিজের স্ত্রীকে বস্তাবন্দি করতে চাওয়া স্বামীর সংখ্যাও প্রচুর। এরা সবাই সুযোগ পায় না, যন্ত্র যোগাড় করতে পারে না, বেশিরভাগেরই সাহস হয় না। সবচেয়ে বড় কথা সামাজিক এবং ধর্মীয় একটা বিধিনিষেধ এদেরকে আটকে দেয়।
কারণ কি এসবের?

কারণ অসংখ্য। সবচেয়ে বড় কারণ অর্থলিপ্সা এবং সামাজিক অবক্ষয়। বর্তমান সিস্টেমে সবাই টাকাকে ধাওয়া করে ছুটছে। ছুটছে তো ছুটছেই…
এক লাখকে দশ লাখ বানাতে হবে, দশ লাখকে কোটি বানাতে হবে, কোটিকে বিলিয়ন করতে হবে….
বাইককে গাড়ি করতে হবে, গাড়িকে মার্সিডিজ করতে হবে..তিন তলাকে ত্রিশ তলা করতে হবে।
সুতরাং বসে থাকা যাবে না… এই দৌড়ের কারণে স্বামী স্ত্রীকে সময় দিচ্ছে না, স্ত্রী স্বামীকে সময় দিচ্ছে না। পারস্পারিক বিশ্বাস এবং ভালোবাসা কর্পোরের মতো উড়ে যাচ্ছে।

পুরুষ তার স্ত্রীর বিকল্প পেয়ে যাচ্ছে বাইরে। কখনো কখনো স্ত্রীও খুঁজে নিচ্ছে বিকল্প ব্যবস্থা। সামাজিক নিয়মে এক ছাদের নিচে থাকতে হয় বলেই তারা থাকছে। ঈদের সময় ঘুরতে হয় বলেই তারা ঘুরছে। হাসি মুখে পোজ দিতে হয় বলেই দিচ্ছে। কিন্তু তারাও ঠিক জানে, একজন আরেকজনকে ঠকাচ্ছে। যে ঠকাতে পারছে না সে বিষ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
মরার জন্য, নয়তো মারার জন্য…

এই সামাজিক এনট্রপি বৃদ্ধির ফলাফল এখনো হাতেনাতে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে খুব শীঘ্রই পাওয়া যাবে। হাসিমুখে সাগরকে পেছন দিয়ে সামনে যে সব বাচ্চাকে নিয়ে এসব জুটি দাঁড়াচ্ছে তারা যখন বড় হবে তখন বোঝা যাবে আসল স্বরূপ। টাকা ছাড়া কিছুই হয়না ব্যাপারটা অসম্ভব রকম বাস্তব।
কিন্তু প্রচুর পরিমাণে টাকার পেছনে তাড়া করাও খারাপ। কিছু সময় নিজের সঙ্গী বা বাচ্চাদের জন্য বরাদ্দ রাখা উচিত।

ভালোবাসা পাহাড়, নদী, বন-জঙ্গলে গিয়ে দেখানোর জিনিস না। ভালোবাসা দামী কাপড় পড়ে দামী ফোন দিয়ে দামী খাবার সামনে রেখে রেখে তোলা ছবি না।
স্ত্রীকে গয়নার ভারে কুঁজো করে, দামী শাড়ি পরিয়ে রাখার নাম দায়িত্ব না।


একবারও কি ভেবেছেন? গ্রামে কেন ডিভোর্স এত কম? স্বামীরা স্ত্রীদের এত অত্যাচার করে, মৌলিক অধিকারও পূর্ণ হয়না অধিকাংশ সময়..তাও কেন ডিভোর্স নেই? অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার বাইরেও বড় কারণ গ্রামের দম্পত্তিদের মধ্যে বিশ্বাস নামের একটা ব্যাপার খানিকটা হলেও থাকে। সারা দিন রিকশা টেনে বা হালচাষ করা লোকটা রাতের বেলা তার স্ত্রী-সন্তানকে কিছুটা সময় দিতে পারে। তাদের সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য কোন সেলফি তুলতে হয় না। সমুদ্রে গিয়ে বেড়াতে হয় না। চিকেন ফিকেন খেতে হয় না।

ভালোবাসা শো আপ করার জিনিস নয়। ভালোবাসা ক্যামেরা নির্ভর কোন বিষয় না। ভালোবাসার চর্চা শুরু করুন ঘরে, নিভৃতে এবং সবার অগোচরে।
আপনি যদি টাকাকেই সবকিছুর উর্ধ্বে বিবেচনা করেন, বহুগামীতাকে স্বাভাবিক স্মার্টনেস ভাবেন..
তবে জেনে রাখুন.. নিজের বেটারহাফকে বছরে দুই চারটা অকেশনে ফেসবুকে ট্যাগ করে “ফিলিং লাভ” ক্যাপশন দেয়া কয়েকটা ছবির কারণে আপনার কোনই লাভ হবে না। দামী পোশাক, দামী খাবার এবং দামী ফোন দেয়া এ মানুষটাই আপনাকে মারার জন্য আপনার টাকা দিয়েই দামী বিষ খুঁজে বের করবে। সস্তা কোন জিনিসে সে হাত দেবে না। সস্তা বিষে বাঁচার সম্ভাবনা থাকলেও দামী বিষের আপনার বাঁচার কোন সম্ভাবনাই থাকবে না। আপনি বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, এটাই সত্য।

লেখক
ডা.জয়নাল আবেদীন

Comments