পথ যেখানে আকাশ ছুঁইয়েছে!

প্রকাশিত: ৭:৩২ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৯, ২০১৮

বশির ইবনে জাফর

জায়গাটা সাইমার পছন্দ। অনেক আগে একবার গিয়েছিলো সেখানে। চারদিক নাকি শুধু পানি আর পানি। নৌকায় করে ঘুরার মতো চমৎকার এক জায়গা।

রাতেই ফোন করে রাখলাম টাঙ্গাইল থেকে ছেড়ে আসা ময়মনসিংহ হয়ে কিশোরগঞ্জগামী ইশা পরিবহনের সুপারভাইজারকে, যেন সকালে ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ যাবার জন্য একটা সিট রাখে। কোথা থেকে উঠবো জানিয়ে রাখলাম। সুপারভাইজার জানালেন সকাল আটটা বিশ নাগাদ চলে আসবে তার আগেই যেন উপস্থিত থাকি।

শীতের সকালে আরামের ঘুম ছেড়ে খুব ভোরে শয্যা ত্যাগের প্রয়োজন হলো না। বাসার সামনে থেকেই বাসে উঠা যাবে, তাই আটটা বাজে পনেরো মিনিটে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম। নির্দিষ্ট সময়েই বাস এলো এবং সকাল দশটায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছে গেলাম।

সাইমার জন্য অপেক্ষা করলাম খানিকটা সময়। সাড়ে দশটায় সে এলো। চমৎকার একটা বোরখা পড়েছে আজ সে। কেমন যেন বড় বড় লাগছে পিচ্চিটাকে তাই। একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা ঠিক করে তার পরিচিত জায়গার দিকে রওয়ানা হয়ে গেলাম দুজনে।

শহরের কোলাহল ছেড়ে দুপাশের ধানক্ষেত মাড়িয়ে এগিয়ে চললো রিকশা চামড়া ঘাটের দিকে। পথে পথে গ্রাম্য পরিবেশ, হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস। চমৎকার এক মুগ্ধতা দিয়ে যাচ্ছিলো। দুজনে মিলে গল্প করতে করতে ৪০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ঘাটে।

ঘাটে পৌঁছে সাইমা তো অবাক! নদীর ওপাড়ে বিশাল চর। এটা নাকি আগেরবার ছিলো না। সৌন্দর্য নাকি একেবারেই কমে গেলো বলে এখানে আসাটাকেই বৃথা ভাবতে শুরু করলো। তার উপর মাথায় প্রচন্ড তাপ দিচ্ছে দুপুরের সূর্য্যটা। কেমন এক অস্বস্তি প্রকাশ করছে বারবার সে। এতদা সত্বেও দাঁড়িয়ে থাকা কার্গোগুলোতে উঠে গেলাম দুজনে। আমার কাছে চমৎকার লাগছে পরিবেশটা, এটা তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম।

নিজ হাতে রান্না করে খিচুড়ি নিয়ে এসেছে সে আমার জন্য। নদীর উপর ভাসমান প্রায় মানশূণ্য একাধিক কার্গো ঘুরে ভালো একটা জায়গা ঠিক করে সেখানে বসে খাবারটা সেরে নিলাম। চমৎকার রান্না করেছে গোশতের ভূনা খিচুড়ি। আমার যে এই খিচুড়িটা খুব প্রিয় খাবারের একটি এটি অবশ্য সে জানে না। এর আগে আমার জন্য একবার বিরিয়ানি রান্না করে খাইয়েছিলো। আজ তাই ভিন্ন আইটেম নিয়ে এলো।

খাবার শেষ করে কিছু ছবি তুললাম চারদিকের। ইঞ্জিনচালিত প্রচুর নৌকা এবং কিছু বিশালাকার কার্গো জানান দিচ্ছে এটা আসলেই একটা নদীবন্দর। এখন মালামাল বুঝাই কার্গো না চলতে পারলেও ভাটিয়ালি লোকজনের যাতায়াতের জন্য প্রচুর পানি রয়েছে নদীটিতে। একের পর এক ট্রলার ছেড়ে যাচ্ছে বিভিন্ন গন্তব্যে। ইটনা, মিঠামন কিংবা আরো নানান জায়গায়। সাপের মতো একেঁ বেঁকে বয়ে চলা নদীটা ধরে যাত্রীরা ছুটে যাচ্ছে তাদের আপন গন্তব্যে।

ছোট কোন নৌকা খুঁজছিলাম নদীটা ঘুরে দেখার জন্য। পেলাম না। তবে স্থানীয় দোকানগুলোতে জিজ্ঞেস করে ওপারে যাবার জন্য ট্রলার পেলাম। দশটাকায় দুজনে পাড় হলাম নদীটা। আরো অনেকেই ছিলো। কিন্তু পাড় হবার পর আর তাদের দেখা যায়নি কারণ এপারে এতো বিশাল এলাকা দৃষ্টিগোচর চলো যেখানে কিছু সময় কোন দিকে চললেই দৃষ্টির আড়াল হয়ে কেমন যেন আকাশে মিশে যেতে থাকে সব।

চমৎকার এক বিশাল প্রান্তর। চারদিক ফসলের মাঠ। তারই মাঝ দিয়ে স্কেলের মতো সোজা চওড়া একটা কনক্রিটের পথ চলে গেছে অজানা গন্তব্যের দিকে। পথের অপর প্রান্তে তাকালে মনে হচ্ছে আকাশে মিশে গেছে তার গন্তব্য। দু’একটা অটো রিকশা সে পথে কয়েকজন যাত্রী নিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে হতে।

আমরা দুজনে হেঁটে চললাম আকাশের দিকে চলা পথ ধরে। মিনিট ত্রিশেক হাঁটার পর চারদিক আর কোন মানুষই নজরে এলো না। কেমন যেন নিজেকে এই বিশাল প্রান্তরের রাজা অনুভব হতে লাগলো। মনে হচ্ছিলো পুরোটা প্রান্তর আমার। এখানে শুধু আমার রাজত্ব চলবে। প্রজাহীন রাজত্বে পাশে রবে শুধু সে।

রোদমাখা সবুজ প্রান্তর মাড়িয়ে আরো খানিকটা সময় চলার পর কোথাও একটু বসার জন্য জায়গা খুঁজলাম। রাস্তা ছেড়ে একটি ক্ষেতের আলে বসলাম দুজনে। বাম পাশে একটু দূরে হাওরের বিশাল জলাশয়। মানুষজন নেই কোথাও। একটি নৌকা বাধা আছে জলাশয়ের একপ্রান্তের দিকে। সূর্য তার প্রতিচ্ছবি এঁকেছে কম্পমান জলের পাতায়। সামনে, ডানে এবং পিছনে ফসলের বিশাল প্রান্তর। যেন সবুজের গালিচা।


দূরে কোন এক পাম্প মেশিনে মাটির তলা থেকে তোলা হচ্ছে পানি। যে পানি ক্ষেতের আল ঘেষে মাটি দিয়ে বানানো ড্রেন বেয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নির্দিষ্ট কারো জামিতে। হালকা মৃদু সে শব্দ বাতাসে ভেসে ভেসে কানে এসে প্রতিধ্বনি তুলছে। ছোট ছোট অনেক প্রজাপতি চারপাশে উড়ে উড়ে স্বাগতম জানাচ্ছে তাদের রাজ্যের এই নবাগত রাজপরিবারেকে।

মুগ্ধতা আর ভালোবাসা নিয়ে সেসব দৃশ্য দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল চলে এলো। সূর্যটা পশ্চিমাকাশের দিকে হেলে পড়তে শুরু করলে আমরা নীড়ের পথ ধরলাম। সন্ধ্যা হবার আগেই পৌঁছে গেলাম শহরে।

কিন্তু মন পড়ে থাকলো সবুজের সে গালিচায়। প্রজাপতিরা যেখানে ভালোবাসার সংসারাবদ্ধ জীবন কাটায়। পৃথিবীর কোলহল যেখানে ম্লান হয়ে যায় নিরবতার অতল সাগরে।

বিআইজে/

Comments