পর্নোগ্রাফি ও বিকৃত মূল্যবোধ নিউজ ডেস্ক নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৯ আমির হোসেন আল হামজা সংবাদকর্মী আধুনিক বিশ্ব আর তথ্য প্রযুক্তি একে অপরের পরিপূরক। তথ্য প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত এনে দিচ্ছে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, তথ্যের অবাধ প্রবাহ, প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক কিছইু আধুনিক পৃথিবীর করায়ত্তে। মানুষের দোরগোড়ায পৌঁছে যাচ্ছে যত্তসব সেবা। ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে নগরায়ন ও শিল্পায়নের প্রচলিত ধারণা। পৃথিবী রুপ নিচ্ছে বৈশ্বিকগ্রামে। আরো কত উন্নত পৃথিবী জন্য অপেক্ষা করছে সেটা বোধগম্য নয়! যদিও তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক হিসেবে আমাদের দেশের উন্নয়নের গতি কিছুটা মন্থর; কিন্তু মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিক শিক্ষা, পারিবারিক ও সামাজিক ভারসাম্য, শান্তি ও শৃঙ্খলার অভাব হু হু করে বাড়ছে। অনেক সেনসেটিভ বিষয় আছে যেগুলোর প্রয়োজনীয়তা বা অপব্যবহার অথবা মানবিক দিকগুলো পর্যলোচনা করা একান্ত জরুরী। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস; আমাদের সমাজ বাস্তবতা এমন যে, আমাদের সচেতনাবোধ আমাদের আহত করে। ‘সামাজিক ট্যাবু’ আর ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এমন মনোভাবের কারণেই আমরা দায় মুক্ত হয় না। আপনি ভাবতেও পারবেন না যে, আমাদের ‘নৈতিক ক্ষত’ কতটা গভীরে পৌঁছেছে। এমনি এক নৈতিক অধঃপতন আর চারিত্রিক প্রলয়ের নাম ‘পর্নোগ্রাফি’। নিরেট সত্য বলতে নেটিজেন সর্বোপরি ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক বিষয়টি নিয়ে কারো না- কারো জীবনে তিক্ত অভিজ্ঞতা নেই এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। তবে সভ্য মানুষের শীতল দুরত্ব আছে এটাই বাস্তবতা। পর্নোগ্রাফি হলো অশ্লিল ভিডিও, ছবি বা অডিও কনটেন্ট। যা স্বাভাবিক চিন্তা ও বিকৃত রুচির পরিচায়ক। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে টিএনজদের অর্থাৎ উঠতি বয়সিদের জন্য এটা কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়! সাম্প্রতিক কিছু জরিপ, গবেষণা প্রতিবেদনে এমনই কিছু অপ্রত্যাশিত ভয়াল তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফি ব্যবহারকারী কারা তা নির্ধারণের তেমন কোনো চেষ্টা এখনো হয়নি তবে স্কুল ছাত্রদের নিয়ে একটি জরিপ করেছে বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’। যেটা প্রভাবশালী জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে এসেছে। দেখা গেছে, ঢাকার স্কুল পড়ুয়াদের প্রায় ৭৭ ভাগ পর্নোগ্রাফি দেখে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগাম কো-অর্ডিনেটর আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান,‘আমাদের এই জরিপটি অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে করা হয়। আর তাতে দেখা যায়, পর্নোগ্রাফি-তারা ছবি, ভিডিও, অডিও এবং টেক্সট আকারে ব্যবহার করে। এসব পর্নোগ্রাফির আবার বড় অংশই দেশে তৈরি। এই শিক্ষার্থীরা প্রধানত মোবাইল ফোনে অনলাইনে পর্নোগ্রাফি দেখে। এর বাইরে ট্যাব, ল্যাপটপেও তারা দেখে। আবার পেনড্রাইভ অথবা মেমোরিকার্ড ব্যবহার করে বিনিময়ও করে’। বাংলাদেশে সাধারণভাবে পর্নোগ্রাফির ব্যবহার কেমন বা কারা এর ভোক্তা? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,এ নিয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট জরিপ নেই। জরিপের ফলোআপে দেখা যায়, ৩০-৩৫ বছর যাদের বয়স এবং তাদের মধ্যে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাদের শতভাগই একবার হলেও পর্নোগ্রাফি দেখেছেন। নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখেন ৯০ ভাগ। আর যুবতী নারীদের মধ্যে সংখ্যাটা শতকরা ৫০ ভাগ। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জরিপে আরো কিছু তথ্য উঠে এসেছে। তার মধ্যে বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে পর্নোগ্রাফির প্রবণতা বাড়ছে। টেক্সট, ছবি ও ভিডিও-র বাইরে অডিও পর্নোগ্রাফি একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পেশাদারদের মধ্যে সেক্স টেক্সটের অডিও তৈরি করে তা অনলাইনে ছাড়া হচ্ছে। ইউটিউব-এ ‘আপলোড’ করা হচ্ছে। এর বাজারও বাড়ছে। আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘রাস্তায় তরুণরা হাঁটছে। তখনও হেড ফোনের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে বুঁদ হয়ে আছে। আমরা হয়তো মনে করি, তিনি গান শুনছেন বা কথা বলছেন। আসলে আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, এর বড় একটি অংশ মোবাইলে অডিও পর্নোগ্রফি শোনে।’ (সূত্র: ‘ডয়চে ভেলে’ বাংলা) গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফি বেশি দেখা হয় মোবাইল ফোনে। মোবাইল ফোনে অনলাইন এবং অফ লাইন দু’ভাবেই সুযোগ আছে। আর শুধু পর্নো সাইট নয়, কিছু নিউজ পোর্টালও পর্নোগ্রফি প্রচার করে টেক্সট, ছবি এবং ভিডিও আকারে। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ২২ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে ৫ কোটি ৮৩ লাখের বেশি মোবাইল ফোন থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ফলে মোবাইল পর্নোগ্রাফি বাংলাদেশে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪ সালের জুন মাসে শিশুসাহিত্যিক টিপু কিবরিয়াকে আটক করে সিআইডি। তিনি ন’বছর ধরে মুগদাপাড়ায় একটি স্টুডিও বানিয়ে শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি করে আসছিলেন। এ বিষয়ে আদালতে তিনি স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তিনি তার আরো তিন সহযোগীকে নিয়ে পথশিশুদের সহায়তা করার নামে স্টুডিওতে এনে পর্নো ছবি তৈরি করে ইন্টারনেটে পে-ওয়েবসাইটে বিক্রি করতেন। জার্মানি, সুইজারল্যান্ডে সরাসরি পাঠাতেন চুক্তিতে। আর ঢাকায় ১৩টি দেশের নাগরিকরা সরাসরি তার শিশু পর্নো ছবির গ্রাহক ছিলেন। তারা ক্যানাডা, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, মধ্য ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের নাগরিক। একটি ফটোগ্রাফিক সোসাইটি গড়ে তুলে তার ছায়ায় আটক হওয়ার আগ পর্যন্ত এভাবে পর্নোগ্রাফির ব্যবসা চালিয়ে যান টিপু কিবরিয়া। মাসে আয় ছিলো ১০ লাখ টাকারও বেশি। মামলাটির এখনো বিচার চলছে। তবে সিআইডি বিদেশি গ্রাহকদের ব্যাপারে তদন্ত বা তাদের ধরার চেষ্টা করেনি। ধারণা করা হয়, সরাসরি পর্নোগ্রাফি তৈরির সঙ্গে আরো অনেক গ্রুপ জড়িত। তারা চাহিদার ভিত্তিতেই পর্নোগ্রাফি তৈরি করে। এটা একটা উদাহরণ মাত্র । পরিসংখ্যান বলছে অনেক এলিট পার্সনরা পর্নোগ্রাফি তৈরির কাজ করে যা দিনদিন ভয়াবহ আকার ধারন করছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর স্থানীয় পর্যায়ে চার পদ্ধতিতে পর্নোগ্রাফি তৈরি হয়: ১. নারী-পুরুষের সম্পর্কের ভিডিও বা অডিও একজনের অজান্তে অন্যজন ধারণ করে। ২. উভয়ের সম্মতিতে ভিডিও, অডিও বা স্টিল ছবি তোলা হয় গোপন রাখার শর্তে। পরে যে কোনো একজন তা প্রকাশ করে দেয়। ৩. নারী-পুরুষের অজান্তে তাদের ডেটিং প্লেস ঠিক করে দেয়া ব্যক্তির দ্বারা ৪. বাণিজ্যিকভাবে পেশাদারদের তৈরি পর্নোগ্রাফি। পর্নো ভয়াবহ একটি স্লো পয়জন যা আপনাকে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। একটি সমীক্ষা থেকে এ কথা জানা গেছে। ফলে পর্ন ফিল্ম দেখা নিয়ে রাখঢাক করে লাভ নেই। বাস্তবটা মেনে নেওয়াই ভালো। তবে, এর কুফলও পড়তে শুরু করেছে এবং সেটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। কী দেখে, কেন দেখে- এসব আলোচনা ছেড়ে সোজাসুজি একটা কথা বুঝে নেওয়া দরকার, উপমহাদেশে সেক্স-এডুকেশন বলে কিছু নেই! ভালোমন্দ বুঝে ওঠার আগেই অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা পর্নো ছবি দেখতে শুরু করছে। আর তার চেয়ে বড় চিন্তার বিষয়, দেখে দেখে সেটাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করছে। শুধু অনুকরণই নয়, অনেকে আবার ছবি তুলে সংগ্রহ করে রাখছে নিজের কাছে। ফল যে কত মারাত্মক হতে পারে, তা চিন্তা না করেই। পর্নো ছবি দেখার আরো কুফল আছে। সেগুলো একনজরে দেখে নেওয়া যাক: পর্নোগ্রাফির যতসব ক্ষতি: সামাজিক মূল্যবোধ চরম অবক্ষয় ও সৃষ্টিশীলতা, সৃজনশীলতা ধ্বংস হচ্ছে। সারাক্ষণই যৌনতা ঘুরছে অল্পবয়সী, না বুঝে ওঠা ছেলে মেয়েদের মধ্যে। বাঁধন হারাচ্ছে সবকিছুর। সামাজিক মূল্যবোধ হারাচ্ছে। নারী হলেই হলো। সম্পর্ক দেখছে না। ছাত্রী, পাড়ার বোন, ভাবি-বাদ যাচ্ছে না কিছুই। এমনকী রেহাই পাচ্ছে না ছোটো ছোটো শিশু। সবার দিকেই লোলুপ দৃষ্টি। সামাজিক অবনমন হয়েই চলেছে দিনকে দিন। ফলে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ দেশের সকল মহলে চরম উদ্বেগ ও আতংক সৃষ্টির পাশাপাশি গোটা দেশজুড়ে মহামারী আকার ধারণ করেছে। অতি সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন। ৪ ফেব্রুয়ারী ’১৯ (সোমবার) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি এই দাবির পাশাপাশি আরো জানায়, চলতি বছর শুধু জানুয়ারি মাসেই দেশে ৫২ টি ধর্ষণ, ২২টি গণধর্ষণ এবং ৫টি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তারা গত বছরে সংঘটিত দেশের ধর্ষণ ও গণধর্ষনের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ২০১৮ সালে ৯৪২টি ধর্ষণের ঘটনা হয়েছে সারাদেশে। লিখিত বক্তব্যে মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, ২০১৮ সালে ১৮২ জন নারী গণধর্ষণ, ৬৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং ৬৯৭ টি ধর্ষণ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। (সূত্র: মহিলা পরিষদের সমীক্ষা থেকে) বিকৃত করে দিচ্ছে মস্তিষ্ক:পর্নো এবং পর্নোগ্রাফি আমাদের ব্রেইনকে কিভাবে ড্যমেজ করছে এটা স্লো পয়জনের মত আমাদের কিভাবে ক্ষতি সাধন করছে সেটা জানতে হলে আমাদেরকে মস্তিস্কের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হবে। আমাদের ব্রেনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি নিউরোট্রান্সমিটার হল ‘ডোপামিন’। ডোপামিনের অনেক কাজ। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, এটি মানুষের আনন্দ এবং সুখের অনুভূতি গুলো বহন করে সেগুলোকে চাহিদা অনুযায়ী আমাদের নিউরন বায়ু কোষে পাঠিয়ে দেয়। পর্নো বা ড্রাগস বা নেশা জাতীয় দ্রব্য এই ডোপামিনকে টার্গেট করেই তৈরি হয়। পর্নো আমাদের ডোপামিনার্জিক সিস্টেম কে ফোর্স করে প্রচুর পরিমাণ ডোপামিন রিলিজ করতে ট্রিগার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ফলে যখন আমরা ড্রাগস বা নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করি অথবা পর্নোগ্রাফিতে অভ্যস্ত হয় তখন আমাদের নিউরণ এ অতিরিক্ত ডোপামিন এর উপস্থিতির ফলে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে ভিন্ন, অস্থির এবং চরম এক সুখানুভূতি এসে আমাদের আচ্ছন্ন করে। এ অবস্থার সাথে অনেকে ‘হাই’ হওয়া হিসাবে পরিচিত। তবে এ অবস্থা সাময়িক। প্রক্রিয়াটির ধরণ এবং পরিমাণের উপর নির্ভর করে এটি কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টা অথবা কয়েক দিন পর্যন্ত ও স্থায়ী হতে পারে। তারপর এই ‘হাই’ অবস্থা যখন কেটে যায়, তখন রাজ্যের বিষন্নতা, হতাশা আর অবসাদ এসে শরীর আর মনের উপর ভর করে। আমাদের নার্ভ সিস্টেম শরীর এবং মনের উপর এই অতিরিক্ত স্ট্রেস নিতে না পেরে ডোপামিনার্জিক সিস্টেম কে সুড়সুড়ি দিতে থাকে ডোপামিন রিলিজ করার জন্য। কিন্তু গতবার যেহেতু ফোর্স করে ডোপামিনকে রিলিজ করা হয়েছিলো, তাই এবার ডোপামিনার্জিক সিস্টেম মানবিক কপট রাগের মত বেশ ভাব ধরে এবং ডোপামিন রিলিজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে নার্ভ সিস্টেমের উপর প্রেশার টা খুব-খুব বেড়ে যায়। এ্যাজ আ রেজাল্ট, আসক্ত ব্যাক্তির শরীর এবং মনে প্রচন্ড অস্থিরতা এবং জ্বালাবোধ তৈরি হয়। তাই ইচ্ছে না হলেও আবারো পর্নো আসক্ত হয়। এভাবেই এ্যাডিকশন শুরু হয় এবং এই চাহিদা দিন দিন বাড়তে বাড়তে এবং অসীমে গিয়ে পৌঁছায়। একসময় ব্যাক্তির অজান্তেই তার সুস্থ চিন্তা, মানবিক বিকৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। অসভ্য মানুষ, শুধুই দেহ:প্রেমের সম্পর্কে হারিয়ে যাচ্ছে। সবটাই শরীরসর্বস্ব হয়ে উঠছে। শরীরের চাহিদা মেটাতেই অপরের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে। পর্নোগ্রাফির ডেমো আস্তে আস্তে দখল করছে মনোজগত। ফলে ভেঙ্গে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি। বিয়ের পর, অনেক ক্ষেত্রেই যৌনতায় অতৃপ্তি তৈরি হচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত ছাড়াছাড়ি পর্যন্ত গড়াচ্ছে দাম্পত্ব সম্পর্ক। অমানবিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ: অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অমানবিক ও অশিক্ষিত পুরুষেরা অশ্রদ্ধার চোখে দেখতে শুরু করছে মেয়েদের। ভাবছে নারী বোধহয় শুধুই ভোগ্যবস্তু। শুধু সহবাসের জন্য নারীর প্রয়োজন। সমাজে নারীর গুরুত্ব হারাচ্ছে। ফলে অহরহ বাড়ছে ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির মতো ঘটনা। যে দেশে অশিক্ষিতের ও পশুত্ব লালনকারীদের সংখ্যা বেশি, সেখানে এর কুফলই বেশি আসবে তাতে সন্দেহ কী! কারণ ভালোমন্দ বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা এই পশুত্ব শ্রেণির মধ্যে নেই। অথচ হাতে আছে সিডি, ডিভিডি, পেন-ড্রাইভ, ইন্টারনেট। পর্নোগ্রাফি রোধ করতে আমরা যেসব সতর্কতা অবলম্বল করতে পারি: আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে ইন্টারনেট আর দামি মোবাইল ‘ছেলের হাতের মোয়া’। সহজলভ্য এই প্রযুক্তি দিয়ে তরুণ ও শিশুরা অনেক সময় পর্নোসাইটে ঢুকে আমাদের বিব্রতকর অভিজ্ঞতার শিকার বানায়। অথচ একটু সতর্ক হলেই এদেরকে এসব কাজ থেকে বিরত রাখা যায়। বাড়ির মোবাইল, ল্যাপটপ সাবধানে রাখুন: মোবাইল, ল্যাপটপে সব পর্নোসাইট ‘ব্লক’ করে দিন। যেসব ব্রাউজে ব্যবহার করেন, তাতে নিরাপদ কিওয়ার্ডস সেট করুন। যৌন বিষয়ক কোনো ওয়েবসাইটে ঢুকলে সার্চ অপশনে গিয়ে সেগুলো ডিলিট করে দিন। বেশ কিছু সফটওয়্যার আছে, যা ব্যবহার করলে ওই ইন্টারনেটের লাইন থেকে বা নির্দিষ্ট মুঠোফোন থেকে কোনো পর্নোসাইটে প্রবেশ করা যাবে না। ইন্টারনেট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইচ্ছা করলে পর্নো সাইটগুলো বন্ধ রেখে গ্রাহককে সেবা দিতে পারে। প্রয়োজনে তাদের সাহায্য নিন। সবাইকে বুঝিয়ে বলুন: টিএজদেও মধ্যে আবেগ বেশি । তাই শিশু অথবা তরুণদের কেউ যদি ভুল করে কোনো সাইটে প্রবেশ করে থাকে, তবে রাগারাগি করবেন না। তার সঙ্গে কথা বলুন। তাকে সরাসরি বলুন, এটি নোংরা ব্যাপার। পরিবারের মধ্যে সুস্থ বিনোদনের চর্চা বাড়ান। বড়রা সতর্ক হোন: পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের দায়িত্বশীলভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে। যৌক্তিকভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার করুন। কারণ ছাড়া কম্পিউটার, মুঠোফোনের ব্যবহার পরিহার করুন। ডিজিটাল মিডিয়া আর বাস্তবতা: আপনি কম্পিউটারে যে পর্নোস্টারদের দেখেন বা টিভিতে যে মডেল আর ফিল্মস্টারদের দেখেন এরা সবাই হাজার হাজার ডলার এর সার্জারী করে, মেকাপ করে, স্পেশালিষ্ট এর অধীনে ব্যায়াম করে, মেকআপ করে তাদের শরীরের প্রতিটি ইঞ্চিকে চকচকে করে তোলে মানুষের চোখে নিজেকে আকর্ষণীয়, আবেদনময়ী করে তুলতে। তার উপর আছে হাই-ডেফিনেশন ক্যামেরা, ফটোশপ আর অত্যাধুনিক ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার এর কারসাজী। এর ফলে আপনি কম্পিউটারে, টিভিতে, ফ্যাশন ম্যাগাজিনে যে মেয়েদেরকে দেখেন তারা নিঁখুত, পার্ফেক্ট। এমনকি আপনি চাইলে মিনিটির পর মিনিট, ঘন্টার পর ঘণ্টা ধরে এই পারফেক্ট ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেন বাধা দেয়ারও কেউ নেই। কিন্তু বাস্তব জীবনের কোন মানুষই এরকম পার্ফেক্ট হয় না আর এরকম পিক্সেল বাই পিক্সেল জুম করে দেখাও যায় না। তাই ডিজিটাল মিডিয়া আর বাস্তবতা এক নয়। সতর্ক হোন, নিজেকে কাবু করে অন্ধজগতে পা দিবেন না। ধর্মীয় অনুশাসন ও নামাজ: পরিবারে ধর্মীয় অনুশাসন বাড়ান। অধীনস্থদের মাঝে ধর্মীয় মূল্যবোধের বিকাশ বৃদ্ধি করুন। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন উপদেশ কিছুতেই ১টি ওয়াক্তেরও নামাজ ছাড়বেন না। আর আপনি যদি নামাজী না হয়ে থাকেন তো আজ থেকেই ৫ ওয়াক্ত নামাজ শুরু করে দিন। কারণ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেছেন ‘নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অশ্লীল কাজ ও পাপাচার থেকে দূরে রাখে’ (সূরা আনকাবুত ২৯:৪৫)। এক ঘরে যেমন একইভাবে আলো আর অন্ধকার থাকে না, তেমনি একই হৃদয়ে একইসাথে নামাজ আর পর্নোগ্রাফি থাকতে পারবে না। একবার সাহাবারা রাসূলুল্লাহ সা. কে বললো অমুক সাহাবী বিভিন্ন ধরনের খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়েছে। রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলেন সে কি এখনো নামাজ পড়ে ? সবাই বললো হ্যাঁ, পড়ে। রাসূলুল্লাহ সা বললেন, সে যদি নামাজ পড়তে থাকে তাহলে নামাজ তাকে অবশ্যই একদিন খারাপ কাজ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। পর্নোগ্রাফি বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। পাশাপাশি যারা পর্নোসাইটে প্রবেশ করে তাদের নাম প্রকাশের পরিকল্পনা নিয়ে শুরু হয়ে যায় বিতর্ক। ১ হাজার ৩১৪টি পর্নসাইট বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার। নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক আইডির এক পোস্টে মন্ত্রী লিখেছেন, ২৪৪টি পর্নসাইট ইতোমধ্যে বন্ধ করা হয়েছে। আমাদের টিম আরো ১ হাজার ৩১৪টা পর্ন সাইটের সন্ধান পেয়েছে। আমরা এগুলো বন্ধ করার কাজে হাত দিয়েছি। আশা করি সহসাই এখানে সফলতা আসবে। আমরা যেমনি ডিজিটাল হচ্ছি, তেমনি ডিজিটাল নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। শিশুসহ দেশের সব নাগরিককে ডিজিটাল বিশ্বে নিরাপত্তা বিধান করা আমাদের প্রত্যয়। পর্নোগ্রাফির শাস্তি ও নিয়ন্ত্রণ আইন: (১) পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২-তে বলা হয়েছে, পর্নোগ্রাফি হলো যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোনো অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য যা চলচ্চিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থির চিত্র, গ্রাফিক্স বা অন্য কোনো উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যাহার কোনো শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই। যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অশ্লীল বই, সাময়িকী, ভাস্কর্য, কল্পমূর্তি, মূর্তি, কাটুর্ন বা লিফলেট। (২) ‘পর্নোগ্রাফি সরঞ্জাম’ অর্থ পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, সংরক্ষণ, ধারণ বা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত ক্যামেরা, কম্পিউটার বা কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, সিডি, ভিসিডি, ডিভিডি, অপটিক্যাল ডিভাইস, ম্যাগনেটিক ডিভাইস, মোবাইল ফোন বা উহার যন্ত্রাংশ এবং যে কোনো ইলেক্ট্রনিক, ডিজিটাল বা অন্য কোনো প্রযুক্তিভিত্তিক ডিভাইস। পর্নোগ্রাফি আইনে পর্নোগ্রাফি তৈরি, বিতরণ, বিক্রি এবং ব্যবহারের আলাদা আলাদা শাস্তির বিধান রয়েছে। সর্বনিম্ন শাস্তি দুই বছর এবং সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদন্ড এর সঙ্গে আর্থিক জরিমানার বিধানও আছে। এর সঙ্গে পর্নোগ্রাফি উৎপাদনের সরঞ্জাম, প্রচার সরঞ্জাম বা মাধ্যম জব্দ করার বিধানও আছে। তবে বিদ্যমান এ শাস্তি পর্যাপ্ত নয়। আমরা আরও কঠোর প্রদক্ষেপ কামনা করি। আমাদের আরো সচেতনতা ও জবাবদিহীতার পরিচয় দিতে হবে। মনে রাখবেন, আপনি যত পাপ করেন না কেন আল্লাহ্ তার চেয়েও বেশী ক্ষমা করতে পারেন কিন্তু শর্ত হলো আপনাকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হোন আর কোনোদিন পর্নো দেখবেন না। আপনি পারবেন। যদি শয়তানের ফাঁদে পড়ে কখনো দেখে ফেলেন তো সাথে সাথে গোসল করে দুই রাকআত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে তাওবা করে নিন, দেরী করবেন না। তারপর দ্বিগুন দৃঢ়তা নিয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন। আর কোনদিন পর্নো দেখবেন না, আপনি আর শয়তানের দাস হবেন না, শয়তান বরং আপনার দাস হবে। কিছুতেই হাল ছাড়বেন না, কিছুতেই না, শয়তান তার শয়তানিতে হাল ছাড়েনি। আপনি তো মানুষ, আপনার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করুন। সঠিক ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে কখনও কার্পণ্য করবেন না। আপনিও আপনার বিশ্বাস আরো সুদৃঢ় হোক। আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। /আরএ/এসএস Comments SHARES মুক্তমত বিষয়: