পদ্মাসেতুর দৈর্ঘ্য ১৫৪ কিলোমিটার, রেলের ভাড়ায় ‘চোখ কপালে’

প্রকাশিত: ১১:৫০ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১০, ২০২৩
ট্রেনে পদ্মাসেতু পাড়ি দিতে পেরে যাত্রীদের উচ্ছাস।

শাহনূর শাহীন, ঢাকা : দিনক্ষণ পুরোপুরি ঠিক না হলেও আগামী মাস থেকে পদ্মাসেতু হয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার কথা। আজ মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত নতুন রেলপথ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এরই মধ্যে রেল মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত ভাড়ার তালিকা প্রকাশ হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সর্বত্রই সমালোচনা শুরু হয়েছে। এই পথে ট্রেন চলাচল শুরুর আশায় যারা অপেক্ষায় আছে বিস্ময়ে তাদের চোখ যেন কপালে উঠে গেছে। রেলের প্রস্তাবিত ভাড়া অনুযায়ী ঢাকা থেকে ফরিদপুর পর্যন্ত ট্রেনের ভাড়া বাসের চেয়েও বেশি হবে।

জানা গেছে, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা যেতে বাসযাত্রীদের খরচ পড়ে ২৫০ টাকা আর এসিতে ৫০০ টাকার মতো। রেল মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশন পর্যন্ত দূরত্ব ৭৭ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু হয়ে ট্রেনে ভাঙ্গা যেতে যাত্রীদের আন্তঃনগর ট্রেনে (নন-এসি) চেয়ার কোচে সম্ভাব্য ভাড়া ৩৫৫ টাকা। এসি চেয়ারে ৬৭৯ টাকা। সব মিলিয়ে বাসের চেয়ে ট্রেনে গুনতে হবে ১০৫-১৭৯ টাকা পর্যন্ত বেশি।

পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে যেসব ট্রেন চলাচল করবে, সেগুলোর জন্য এমন বিস্ময়কর ভাড়া প্রস্তাব করেছে রেলওয়ের কমিটি।

অতিরিক্ত ভাড়া প্রস্তাবনার পেছনে রয়েছে অদ্ভূত এক পদ্ধতি। পদ্মাসেতুর ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যকে হিসাব করা হয়েছে কিলোমিটার প্রতি ২৫ কিলোমিটার পথ। এই হিসাবে পদ্মাসেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ১৫৪ কিলোমিটার। অন্যদিকে গেন্ডারিয়া থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত প্রতি কিলোমিটারকে ৫ কিলো ধরে ২৩ কিলোমিটার উড়ালপথকে ১১৫ কিলোমিটার রেলপথ ধরা হয়েছে। রেলওয়ের গঠিত কমিটি ভাড়া নির্ধারণে এই পদ্ধতি অনুসরণ করে বিস্মিত করেছেন এই পথের সম্ভাব্য যাত্রীদের।

আলম নামের ভাঙ্গার কাঁচামাল (সবজি) ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিদিন আমাদের ঢাকায় যেতে হয়। নিয়মিত চলাচলে বাসে যাওয়াটা একটু কষ্টকর। ট্রেন চালু হলে আমাদের জন্য উপকার হবে। কিন্তু ভাড়া যদি বাসের থেকে বেশি হয় তাহলে তো আমরা ট্রেনে উঠতে পারবো না। ব্যবসা করে দশ টাকা আয় করার জন্য ঢাকা যাই, অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হয় তাহলে ব্যবসা করবো কীভাবে? প্রশ্ন আলমের।

  • ঢাবি শিক্ষার্থী ও শিবচরের বাসিন্দা আফসানা রহমান বলেন, পদ্মাসেতু হয়ে রেলযোগাযোগ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটা মাইলফলক। বর্তমান সরকারের বড় একটি সফলতা হবে এটি। পুরো দক্ষিনাঞ্চলের মানুষ এর সুফল ভোগ করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নানা সময়ে নানান উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। ভাড়া নির্ধারণে পেছনে এটাও কোনো কারণ হতে পারে। এভাবে বিবেচনা করলে সাধারণ মানুষের জন্য সুফল ভোগ করা কষ্টকর হয়ে যাবে।

ফরিদপুরের বাসিন্দা এনজিও কর্মী ফরিদুর রহমান বলেন, বাসের চেয়ে যদি ট্রেনের ভাড়া বেশি হয় সেটা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। কর্তৃপক্ষ তাদের দুর্নীতির ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে জনসাধারণের ওপর বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। যেটা পুরোপুরি অন্যায়।

রেলওয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এটা রেলওয়ে পন্টেজ চার্জের জন্য বাড়তি দূরত্ব। আর গেন্ডারিয়া থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত উড়ালপথের প্রতি কিলোমিটারকে ধরা হয়েছে ৫ কিলোমিটার। এ জন্যই ঢাকা থেকে ভাঙ্গার প্রকৃত দূরত্ব ৭৭ কিলোমিটার হলেও রেলওয়ে আদায় করতে চায় ৩৫৩ কিলোমিটার দূরত্বের ভাড়া।

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (সিসিএম) নাজমুল ইসলামকে প্রধান করে সাত সদস্যের এ কমিটি করা হয়েছে। সেই কমিটিই প্রস্তাব করেছে এই লাগামহীন এই ট্রেনভাড়া।

রেল কর্তৃপক্ষ তাদের প্রস্তাবনায় বলছে, ট্রেনের ভাড়া বাড়ার পেছনে প্রধান দুটি বিষয় উঠে এসেছে। একটি পদ্মা সেতু, অন্যটি গেন্ডারিয়া-কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত উড়ালপথ। এই পথের জন্য অতিরিক্ত পথ যোগ করে ভাড়া বেশি ধরা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর প্রতি কিলোমিটারকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্ব ধরে ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতুকে ১৫৪ কিলোমিটার রেলপথ ধরা হয়েছে।

অন্যদিকে গেন্ডারিয়া থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত উড়ালপথের প্রতি কিলোমিটারকে ধরা হয়েছে ৫ কিলোমিটার। প্রায় ২৩ কিলোমিটার উড়ালপথকে ১১৫ কিলোমিটার রেলপথ ধরা হয়েছে।

ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিককে বলেন, পদ্মা সেতু ও কেরানীগঞ্জের উড়ালপথের জন্য ভাড়া বেশি হবে। তবে যশোর পর্যন্ত পুরো রেলপথ চালু হয়ে গেলে ভাড়া কমে যাবে। ভাঙ্গা পর্যন্ত যাত্রীদের জন্য কোনো ছাড় থাকবে কি না, এ বিষয়ে তিনি বলেন, এখনো ছাড় (ডিসকাউন্ট) রাখা হয়নি। তবে কম রাখার নিয়ম রয়েছে। যাত্রী চাহিদার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে এসব বিষয় বিবেচনার কথা জানান তিনি।

তবে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বাসের চেয়ে যেন ট্রেনের ভাড়া বেশি না হয় সে চিন্তাও আমাদের রয়েছে।

সেতুর ভেতর দিয়ে ট্রেনে চড়ে পদ্মা নদীর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য মোহিত করবে যাত্রীদের।

প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকার কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত দীর্ঘ ১৭২ কিলোমিটার রেললাইন নির্মিত হচ্ছে। প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ঢাকা-মাওয়া ৪০ কি.মি. ও মাওয়া-ভাঙ্গা ৪২ কিলোমিটার রেলপথ উদ্বোধন করা হবে। প্রকল্পের তৃতীয় অংশ ভাঙ্গা-যশোর ৮৭ কি.মি. রেললাইনের নির্মাণকাজ ২০২৪ সালের জুনে শেষ হবে।

আজ দুপুর পৌনে ১২টায় মাওয়া রেলস্টেশনে হুইসেল বাজিয়ে ও পতাকা নেড়ে মাওয়া-ভাঙ্গা অংশে ট্রেন চলাচলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সফরসঙ্গীদের নিয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে এক ঘণ্টা যাত্রা শেষে ভাঙ্গা রেলস্টেশনে গিয়ে নামবেন। এর আগে মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশে ভাষণ দেবেন।

রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের সভাপতিত্বে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সেনাপ্রধান, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য দেওয়ার কথা রয়েছে।

Comments