প্রতারণার ফাঁদ: অবৈধ লাইফ কেয়ার হসপিটাল চলছে সদর হাসপাতালের আউটডোর পরিচয়ে

প্রকাশিত: ১০:৫১ অপরাহ্ণ, জুলাই ৩, ২০১৯

বিল্লাল হোসেন,যশোর প্রতিনিধি: যশোরে স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন ছাড়াই গড়ে ওঠা একটি প্রতিষ্ঠানের নাম হলো লাইফ কেয়ার হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। নামমাত্র এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা পরিবর্তন হলেও প্রতারণা থেমে নেই। অভিযোগ উঠেছে,সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ভাগানো রোগী দিয়েই চলছে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম।

প্রতারণার ফাঁদ পেতে পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ নানা অজুহাতে রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। সর্বরোগের চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত ডা. এম এম আলী এখানে রোগীর ব্যবস্থাপত্রের পাশাপশি আল্ট্রাসনো করছেন। দীর্ঘদিন ধরে লাইফ কেয়ারের প্রতারণা চলে আসলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছেনা।

যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের প্রথম গেটের গা ঘেষেই অবস্থিত লাইফ কেয়ার হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। গত বছর থেকে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন জেনারেল হাসপাতালের সাবেক আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মনির হাসান। এর আগে মালিক ছিলেন জাহিদ হোসেন।

যশোর সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার হিসেবে লাইফ কেয়ারের অনুমোদন দেয়া হয়। যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৮৩৮৩। বর্তমানে সেখানকার সাইনবোর্ড ও ব্যবস্থাপত্রে ডায়াগনস্টিকের আগে হসপিটাল লিখে কার্যক্রম প্রতারণা জোরদার করা হয়েছে। বাস্তবে হসপিটালের কোন কার্যক্রম নেই। হসপিটালের কার্যক্রম চালুর বিষয়ে অনুমোদনও নেয়া হয়নি। বরং ডায়াগনস্টিকের লাইসেন্স মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাও নবায়ন করা হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, এটি একটি নাম সর্বস্ব স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এখানে নেই বিশেষ চিকিৎসক, ডিগ্রিধারী সেবিকা, মেশিনারীজ, প্যাথলজিস্ট, ল্যাব, টেকনিশিয়ান, শয্যা ও কেবিন। যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে আসা রোগীর উপর ভর করে লাইফ কেয়ার খুলে রাখা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালের গা ঘেষে নামমাত্র এই হসপিটালটি গড়ে তোলায় দালালরাও রোগীর সাথে প্রতারণা করার সুযোগ পাচ্ছেন খুব সহজেই। সূত্র জানায়, জেনারেল হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারের সামনে থেকে শুরু করে লাইফ কেয়ারের গেট পর্যন্ত পোষ্য দালালের বিচরণ থাকে।

দালাল একজন আরেকজনের হাতে রোগীদের তুলে দেয়। দালালরা রোগী ও স্বজনদের বলে থাকে সেটি জেনারেল হাসপাতালের বহিঃবিভাগের একটি অংশ। হাসপাতালের ২, ৪, ৬ ও ৭ নম্বর কক্ষ ওই ভবনে। সেখানে ডাক্তার রোগী দেখছেন। আর রোগীরা বিশ্বাস করে সেখানে চলে যাচ্ছেন। এরপর শুরু হয় গলাকাটা বাণিজ্য।

চিকিৎসকের ফি ও পরীক্ষা নিরীক্ষা বাবদ আদায় করা হয় মোটা অংকের টাকা। বর্তমানে অবৈধ লাইফ কেয়ার হসপিটাল এন্ড ডায়াগস্টিক সেন্টারটি প্রতারণার শীর্ষে রয়েছে। চুড়ামনকাটি গ্রামের মৃত আব্দুল হাই তরফদারের ছেলে ওয়াহিদুজ্জামান মিলন জানান, তার মা জামেলা খাতুন কয়েকদিন ধরেই বুকের যন্ত্রনায় ভুগছেন। মঙ্গলবার তিনি চিকিৎসক দেখানোর জন্য যান যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে। টিকিট কাউন্টার থেকে ৫ টাকার টিকিট কেটে যাচ্ছিলেন বর্হিঃবিভাগে চিকিৎসকের কক্ষে। কিন্তু দুই পা সামনে বাড়াতেই এক দালালের খপ্পরে পড়েন।

মিলন আরো জানান, তার মাকে জানানো হয় ওই ভবনে ডাক্তার রোগী দেখছেন। ওই টিকিটে যে কক্ষের নাম লেখা আছে সেই কক্ষ ওই ভবনে অবস্থিত। ভুল বুঝিয়ে সেখানে নিয়ে গিয়ে ডা.এম এম আলীর কক্ষে পাঠানো হয়। সরকারি টিকিট বাদে নিজের ব্যক্তিগত প্যাডে ওই চিকিৎসক রোগীর ব্যবস্থাপত্রের পাশাপাশি বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার নাম লেখা হয়। এদিন তার মায়ের কাছ থেকে চিকিৎসক ফিস বাবদ ২শ টাকা ও আল্ট্রাসনো,ইসিজি, আরবিএস ও ইউরিন আর আই ই পরীক্ষা বাবদ আদায় করা হয়েছে ২৩শ টাকা।

সরকারি হাসপাতালে এতো টাকা নিচ্ছেন কেনো জানতে চাইলে লাইফ কেয়ারের কর্মচারীরা রোগী জামেলা বেগমকে তড়িঘড়ি করে পাঠিয়ে দেন। ওয়াহিদুজ্জামান মিলন আরো জানান, ওই সময় লাইফ কেয়ার হসপিটালে যেসব রোগী ছিলেন তাদের অধিকাংশের হাতে ছিলো জেনারেল হাপাতালের বর্হিঃবিভাগের টিকিট। ওই রোগীরা প্রতারিত হয়ে এখানে এসেছেন। চুড়ামনকাটি উত্তর পাড়ার ইমদাদুল হক জানান, এদিন তিনি তার শাশুড়িকে ডাক্তার দেখানোর জন্য জেনারেল হাসপাতালে এসেছিলেন। তিনিও দালালের খপ্পরে পড়েছিলেন। কিন্তু প্রতারণা বুঝতে পারায় দালালের কথায় লাইফ কেয়ারে চিকিৎসার জন্য যাননি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রোগী ও স্বজনরা লাইন দিয়ে বসে আছেন।

একটি কেেক্ষর ভিতরে রোগী দেখছেন ডা. এম এম আলী। তিনি আবার রোগীর আল্ট্রাসনো করছেন। তার ব্যবস্থাপত্রে লেখা আছে এমবিবিএস পাস ছাড়া আজগবী বিভিন্ন কোর্স করার নাম লিখেছেন।এটা মেডিসিন,পরিপাকতন্ত্র,কিডনী,চর্মরোগ ও বিশেষ প্রশিক্ষণ ইএনটি। নওয়াদাগা গ্রামের জুলিয়া খাতুন জানান, সদর হাসপাতালের কথা বলে তাদের এখানে আনা হয়েছে। তারা আবার পর বুঝেছেন প্রতারিত হয়েছেন। কিন্তু সাথে কোন পুরুষ না থাকায় কিছু বলথে সাহস পাননি। সূত্র জানায়, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর তিনটা পর্যন্ত লাইফ কেয়ারে জোর প্রতারণা চলে।

বহু বছর ধরে এখানে রোগীদের ভাগিয়ে এনে ডাক্তার, ক্লিনিক মালিক ও দালালেরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। আর টাকা ব্যয় করে সঠিক চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। সূত্র জানায়, বিগত দিনে যশোরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত লাইফ কেয়ারে অভিযান চালায়।

এসময় ভ্রাম্যমান আদালত দেখতে পান, বিভিন্ন মেডিকেল টেস্টের জন্য নির্ধারিত ফিস/মূল্যের প্রদর্শিত তালিকা নেই। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ মূল্য/ফিস আদায় করা হয়। এই অভিযানে পাওয়া যায় একজন ডাক্তারের
স্বাক্ষরিত মেডিকেল টেস্ট রিপোর্টের প্রায় ২শ’ খালি পাতা। যা পরবর্তীতে রোগীদের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়ন ছাড়াই হসপিটাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের ইচ্ছামতো রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেন। আর্থিক জরিমানার পরও লাইফ কেয়ারের প্রতারণা থামেনি। বর্তমানে আরো জোরদার হয়েছে।

এই বিষয়ে ডা.এম এম আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন সরকারি হাসপাতাল থেকে ভাগিয়ে আনা কোন রোগীর তিনি ব্যবস্থাপত্র দেননা। নিজের ইচ্ছায় আসা রোগীদের তিনি ব্যবস্থাপত্রের পাশাপাশি আল্ট্রাসনো করে থাকেন। লাইফ কেয়ার পরিচালনাকারী ডা. মনির হাসানের বক্তব্য নেয়ার জন্য তার মুঠোফোনের নম্বরে কল করা হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ না করে নম্বর ব্যস্ত দেখিয়ে কেটে দেন। যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল কালাম আজাদ লিটু জানান, লাইফ কেয়ার হসপিটালে প্রতারণার ফাঁদ পাতা হয়েছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। সেখানকার ভবন জেনারেল হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগ হিসেবে পরিচয় দিয়ে দালালরা প্রতিনিয়ত রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এই বিষয়ে তিনি রোগী ও স্বজনদের সচেতন হওয়ার আহবান জানিয়েছেন।

যশোরের সিভিল সার্জন ডা. দিলীপ কমার রায় বলেন, অবৈধ হসপিটাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। কার্যক্রমের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। অনুমোদন ছাড়াই গড়ে ওঠা লাইফ কেয়ার হসপিটাল ও ডায়াগনস্টিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

-এটি

Comments