বাল্যবিবাহের ছোবল থেকে রক্ষা পেলো কিশোরী নিউজ ডেস্ক নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ১২:৫৬ অপরাহ্ণ, মার্চ ২১, ২০১৯ আশরাফুল ইসলাম আবির: ‘এখনই নয়, লেখাপড়া করব, মানুষ হয়ে বাবা-মায়ের হব আমি গর্ব’ এমনি একটি ইচ্ছা নিয়ে অজপাড়া গাঁয়ের একটি নিভৃত পল্লীতে বাবা-মায়ের অভাব অটনের সংসারে বড় হতে থাকে মেয়েটি। অতিদারিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও সে হতে চায় বড় শিক্ষিতা। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। আর তাই শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে নিজেকে তুলে ধরতে চায় সমাজের মাথা উঁচু করে সাফল্যের চূঁড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আর পাঁচজন নারীর মতই। দারিদ্রসীমার একেবারেই নিচে থাকা পরিবারেই হাঁটি হাঁটি পা করে বেড়ে ওঠা সে। গ্রামের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে শুরু হয় তার শিক্ষার হাতে খড়ি। শত কষ্ট আর ক্ষুধার জ্বালা থামাতে পারেনি শিশুটিকে। পরিবারের দুই ভাই বোনের মধ্যে সে-ই বড়। প্রাথমিকের গন্ডি পেড়িয়ে এখন সে মাধ্যমিকে নবম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত। বাবা দিনমুজুর দিন আনে দিন খায়, সংসারে বলতে গেলে নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে চলে তার পরিবার। এরই মধ্যে ছোট ভাই পড়ে চতুর্থ শ্রেণীতে। এতক্ষণ যর কথা বলছিলাম তিনি হলেন নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলা পঁচারহাট গ্রামের হতদরিদ্র মানিক চন্দ্রের জৈষ্ঠ্য কন্যা ববিতা রানী (১৪)। গ্রামের পঁচারহাট জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ুয়া ববিতা গ্রামের সামাজিক কাজগুলি করে যাচ্ছে তার নিজ ইচ্ছায়। আরডিআরএস-বাংলাদেশের ইন্ডিং চাইল্ড ম্যারেজ প্রকল্পের আওতাধীন আদর্শ কিশোর-কিশোরী ক্লাবের একজন অন্যতম সদস্য হয়ে কাজ করছেন তিনি। বিদ্যালয়ের ছুটিতে বাবা-মায়ের সাথেই গেল মাসেই শিশু ববিতা বেড়াতে যায় জেলার সৈয়দপুরে জনৈক্য আত্বীয়র বাসায়। হতদরিদ্র পরিবারে বড় হলেও সে লেখাপড়ায় বেশ ভালো। চটপটে স্বভাবের। দেখতে শুনতে একেবারে মন্দও না ববিতা। ফলে ঐ আত্বীয়র বাড়ীর কাছে এক পরিবারে চোখে লেগে যায় তাকে। উঠতি বয়সের কিশোরী ববিতা ফিরে আসে বাড়িতে। চলতে থাকে লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্লাবের বাকী সব সদস্যদের নিয়ে সামাজিক ছোট ছোট উদ্যোগের কাজগুলি। এরই মধ্যে চলে আসে ববিতার বিয়ের প্রস্তাব। বাবা মানিক চন্দ্র ভেবে চিন্তে দেখেন মেয়েকে লেখাপড়া করে কি লাভ! ঘুরে আবার জামাই পেতে লাগবে ঢের টাকা-পয়সা। সাঁতপাঁচ ভেবে শিশু ববিতার বিয়ে ঠিক করে ফেলেন সে। বড় মেয়ে ববিতার বিয়ে দিবেনই সে। টুকিটাকি আয়োজন করতে থাকে ববিতার মা-বাবা। বন্ধ করে দেন মেয়েকে বিদ্যালয়ে যাওয়া। তারা ববিতাকে বিয়ে দিবেন মনস্থির করে ফেলেন। এদিকে ঘটকের আসা-যাওয়া আর বাবা-মায়ের বিয়ের দেয়ার আনাগোনা কিছুটা টের পেয়ে যায় শিশু ববিতা। স্বপ্ন ভাঙ্গতে থাকে তার। লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে সে। কিন্তু আর বুঝি সম্ভব নয়। এমনিই চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে সে। খবর পাঠিয়ে দেয় আদর্শ কিশোর-কিশোরী ক্লাবের অন্যসব সদস্যদের। কিছুতেই বিয়েতে বসবে না ববিতা। খবর পৌঁছে যায় ক্লাবের সদস্য প্রতিমা রানী ও মনি আক্তারের কাছে। শিশু ববিতার বিয়ে হবে এটা কিছুতেই মানা যায় না, ভেবে তারা ফ্রেব্রুয়ারীর ২৮ তারিখে জরুরী বৈঠকে বসে ক্লাবের সকল সদস্যদের নিয়ে। আলোচনা চলতে থাকে ক্লাবের সদস্যদের ববিতাকে নিয়েই। এ বিয়ে ঠেকাতেই হবে। কিছুতেই বিয়ে দিতে দেওয়া যাবে না ববিতার। প্রাথমিক ভাবে সকল সদস্য মিলে ববিতার বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে বাল্য বিবাহর কুফল ও দুষ্ট চক্রের বিষয়টি তুলে ধরেন। কিন্তু না কিছুতেই যেন বাবা-মায়ের মন গলছে না, তারা মেয়ের বিয়ে দিবেনেই। এতে থেমে যায়নি ক্লাবের সদস্যরা। খবর পাঠায় তারা উক্ত বে-সরকারী সংস্থার ইন্ডিং চাইল্ড ম্যারেজ প্রকল্পের ইউনিয়ন ফ্যাসিলিটেটর মোছা: ববিতা আক্তারের কাছে। ঘটনার সংবাদ পেয়ে তিনি ছুটে যান স্থানীয় ইউপি সদস্য তোজাম্মেল হকের কাছে। তিনি সব শুনে আশস্ত করেন শিশু ববিতার বিয়ে ঠেকানো হবে, কিছুতেই হবে না এ বিয়ে। এবার ইউপি সদস্যকে সাথে নিয়ে ক্লাবের সদস্যরা আবারও ছুটে যায় ববিতার বাড়ীতে। মুখ খুলে শিশু ববিতা। লাজে রাঙ্গা হয়ে বাবা-মায়ের মুখের উপর সকলের সামনে বলে দেয় “আমি বিয়ে করবো না”। আমি মানুষের মত মানুষ হয়ে তোমাদের মাথা উঁচু করতে চাই। বড় হয়ে কাজ করতে চাই সমাজের। আমি সুযোগ চাই। আমাকে সুযোগ দিন। মেয়ের মুখে এসব কথা শুনে বাবা-মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় মেয়ের পানে। অবশেষে সম্মতি দেয় বিয়ে না দেওয়ার। বন্ধ হয় শিশু ববিতার বিয়ে। এ ঘটনায় আদর্শ কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সদস্যদের সাহসী উদ্যোগকে স্বাগত জানান ইউপি সদস্য তোজ্জামেল হক। বাল্যবিবাহর হাত থেকে বেঁচে যায় একটি শিশু। বেঁচে থাকলো তার স্বপ্ন। এখন স্বপ্ন পুরনের প্রত্যাশায় নিয়োমিত বিদ্যালয়ে যেতে শুরু করেছে ববিতা রানী অন্যসব কিশোরীদের সাথে। যেন সে আবারও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে। বিয়ে ঠেকানোর জন্য ক্লাবের সকল সদস্যদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে সে। বিয়ে বন্ধ হয়ে আবারও লেখাপড়ায় যোগ দিতে পেরে খুবই খুশি ববিতা। সে জানায়, আমার মত দেশের সকল মেয়েরা যেন বাল্য বিবাহকে না বলে। জীবনের সকল শক্তি দিয়ে ঠেঁকিয়ে দেয় শিশু বিয়ে। আমি যত দিন বাঁচবো বাল্য বিয়ে ঠেঁকাতে এ সমাজে কাজ করে যাব এ আমার দৃঢ় প্রতি। /এফএফ Comments SHARES ফিচার বিষয়: