লেখালেখির সেকাল-একাল এবং বইমেলা

প্রকাশিত: ৪:৩২ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৯

শাহনূর শাহীন
কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মাত্রই শেষ হলো। সামনে অমর একুশে বইমেলা। লেখালেখি, লেখক, নির্বাচন, বইমেলা। অদ্ভুত তো এগুলোর সাথে কী এমন মিল? যার আলোচনা এতো কাছাকাছি আসতে পারে। হুম, আছে তুমুল ব্যস্ততার একটা সম্পর্ক আছে। ‘প্রত্যেক সাংবাদিক, লেখক নন বটে; প্রত্যেক লেখক, সাংবাদিক।

যদিও এই দুটোর কোনোটাই আমি নই। কিন্তু শিক্ষানবিস মামুলি সংবাদকর্মী হিসেবে নির্বাচনের মাসে ব্যস্ততার কোনো কিনারা খুঁজে পাইনি। বিশেষ করে মনোনয়ন পত্র যাচাই-বাছাই শুরুর দিন থেকে ফলাফল ঘোষণার আগ পর্যন্ত ব্যস্ততার কোনো সীমা ছিলো না। মাঠ কর্মী না হওয়ায় দৌঁড়পাল্লাার ঝাক্কি ঝামেলা থেকে রেহাই পেলেও দম ফেলার ফুরসত পাওয়াটাও যেন সময় নষ্ট করার মতো ব্যাপার মনে হয়েছিলো।

নির্বাচনের দিন সকাল সাড়ে সাতটায় কম্পিউটারে বসতে হয়েছে। সারাদেশ থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদ, কোথাও আবার অফিসে বসে বসেই ফোন করে তথ্য নিয়ে খবর তৈরি করে পাঠকের জন্য উপস্থাপন করা। কখন কোথায় কী ঘটলো তার খোঁজ নেয়া।

সে এক মহাব্যস্ততা। সকাল ৮ টায় বসে রাত ১২ টা পেরিয়ে ২ টা পর্যন্ত; অর্থাৎ ৩০ তারিখ থেকে ৩১ তারিখ পর্যন্ত ডেস্কে বসে বসে কিবোর্ডে আঙুল চালানোটা বড্ড ব্যস্ততারই ছিলো।

হিসেব করে দেখলাম নির্বাচন এলে সাংবাদিকদের ব্যস্ততা অন্যান্য সময়ের চেয়ে শতগুণ বেড়ে যায়। আর সেটা যদি হয় জাতীয় নির্বাচন তাহলে তো কোনো কথাই নেই। শতগুণ তখন হাজার গুণ হয়ে যায়। তবে এটা যেকোনো মাসেই হতে পারে। এর কোনো নির্দিষ্টতা নেই।

আরো পড়ুন…
বিশ্বজুড়ে বইমেলা; জেনে নিন ইতিহাস ও ইতিবৃত্ত

অন্যদিকে, প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে লেখকদের ব্যস্ততাও বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে তুমুল বেড়ে যায়। অর্থাৎ নির্বাচন আর বইমেলার চমৎকার মিল হলো লেখক-সাংবাদিকের ব্যস্ততা।

কথায় আছে ভালো লেখক হতে হলে অনেক অনেক বেশি ভালো পাঠক হতে হয়। আমার তেমন পড়ার অভ্যাস নেই। বই পাঠ নেই বললেই চলে। নিজেকে কবি দাবি করলেও নিজের বা পরের একটি কবিতাও মুখস্ত নেই। অর্থাৎ ভালো পাঠক তো দূরে থাক পাঠকই হতে পারিনি।

তার মানে নিজের লেখাও পড়ি না তা কিন্তু নয়। নিজের, পরের। সবারটাই পড়ি। ছোট, বড় একটা দুইটা কবিতা, গল্প বা প্রবন্ধ পড়ি অবসরে। কিন্তু বই পড়া শুরু করলে শেষ করতে হবে এই ভয়ে শুরুই করা হয় না।

বই পাঠে অলসতা থাকলেও ছোটবেলা থেকে সংবাদ পত্র পড়ার ক্ষেত্রে প্রচুর ঝোঁক ছিলো। এখনো আছে। পত্রিকা আছে কিন্তু পড়া হয়নি; এমনটা হয় না। এমন অবস্থায় রাত পোহাতে শুরু করলেও ঘুম আসে না। সেই তখন থেকেই একটু আধটু কবিতা লিখার অভ্যাস।

তখন ছোট ছোট ছড়া কবিতা তথা স্বরবৃত্ত ছন্দ কবিতা লিখতাম। যদিও তখন ছন্দ কী জিনিস; তা খায় নাকি মাথায় দেয়া সেটা জানতাম না। ওই সময় বিশেষত জনপ্রিয় গানের সুরে রিমেক, কিংবা পত্রিকার খবরে পড়া নতুন কোনো সিনেমার নামে টাইটেল সং লেখা ছিলো নিয়মিত অভ্যাস।

একটা সময় নিজস্ব ঢং-এ গান কবিতা লিখতে শুরু করি। সে যাই হোক, বেশি না। এই কত! ২০১৪ সাল। তখনো হাতে স্মার্টফোন আসেনি। নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হওয়ায় একটু দেরি আরকি। ওই সময়েও যা লিখতাম কাগজে লিখতাম।

আমার মনে পড়ে তখনো আমি আলিম তথা ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। শিক্ষালয়ের এক বড় ভাইয়ের নোকিয়া ফোন ধার করে বাটন চেপে চেপে চারশো-পাঁচশো শব্দের কলাম লিখতাম পত্রিকায়।

১৪’ সালের শেষের দিকে ঢাকায় আসা। তখন হাতে কোনো রকম স্মার্টফোন বলা চলে। শুরু হলো কাগজ ছেড়ে কি-প্যাডে লেখা। ১৬ সালের বইমেলায় প্রথম কবিতার বই বের করি। পরের বছরেও গ্যাপ যায়নি। ১৮’র বইমেলা সামনে। কিন্তু কোনো প্রস্তুতি নেই। মেলার দু’মাস আগে হঠাৎ মাথায় একটা থিম আসে। লিখতে শুর করি। প্রতিদিন গুণে গুণে ৪ ফর্মার ছড়ার বই লিখে শেষ করি।

অবাক ব্যাপার হলো একটি বা দুটি ছাড়া সবগুলো ছড়া মোবাইলে এবং শেষের কয়েকটি ডেস্কটপে লেখা। বইয়ের ছড়াগুলো ছিলো সমাজের ভেতরে-বাইরে, অন্দরে যা কিছু হয় এমন সব বিষয়ের।

প্রেম-বিরহ, রোমাঞ্চ কিংবা দুনিয়ার ওপারের কথাও বাদ ছিলো না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো; মুখ্য বিষয় বা থিম ছিলো অন্য রকম আকর্ষণীয়। বর্তমান সময়ে চলতে ফিরতে বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ ‘বাঁশ’ যা আমরা সবাই কমবেশি উচ্চারণ করি প্রতিনিয়ত। আমার বইয়ের প্রত্যেকটি ছড়ায় ছিলো এই একটি শব্দ ‘বাঁশ’ এর চমৎকার উপস্থিতি।

বইয়ের প্রত্যেকটি ছড়ায় বিষয় বস্তুর সাথে মিল রেখে ‘বাঁশ’ শব্দটির উপস্থাপনা সর্বমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে বেশ। গত বই মেলায় বইটি বেশ আলোচিত একটি বই ছিলো। এই ছিলো লেখার দৌঁড়। ছড়া বা কবিতা পর্যন্তই। গল্প কিংবা উপন্যাস লেখার মতো সাহস তখনো হয়নি।

কিন্তু মেলা শেষ হতেই চিন্তা হলো আগামী বইমেলা অর্থাৎ ১৯’ সালের মেলায় ভিন্ন কিছু; মানে গল্প কিংবা উপন্যাস লিখতে হবে। ওই যে বলছিলাম, লিখতে হলে পড়তে হয়। তাই উপন্যাস আসলে কী জিনিস তা উপলব্ধি করার জন্য দেশের প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক ইমদাদুল হক মিলনের বেশ কিছু উপন্যাস পড়লাম গত কয়েক মাস ধরে।

ভাবনা ছিলো অক্টোবর-নভেম্বর এই দুই মাসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে লিখে ফেলবো। হয়নি। একেবারে পণ করলাম; ডিসেম্বরেই শেষ করবো। তা আর হলো কই। নির্বাচন চলে এলো। নাওয়া-খাওয়াও যেন এক প্রকার ভুলতে বসেছিলাম। এখন ডিসেম্বর শেষ। জানুয়ারির কত তারিখে যে লেখা শুরু করতে পারবো এখনো তা ভাবছি। এই হলো লেখক ফিরিস্তি।

আমার মতো যারা এখনো লেখক হয়ে ওঠেনি তারাও ফেব্রুয়ারি এলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নভেম্বর-জানুয়ারি, বড় বড় লেখকরা নির্বাচনের মতই ব্যস্ত থাকেন। এই সময়ে প্রকাশকরা বড় বড় লেখকদের কাছে পান্ডুলিপির জন্য প্রতিদিন খোঁজ-খবর নিতে থাকেন।

সে যাই হোক, ছোট হোক বা বড় হোক। লেখক হোক বা আমার মতো অ-লেখক হোক ব্যস্ততার এই সময়টা সেকালে কাটতো কাগজ কলম নিয়ে। আর একালে কাটে স্মার্টফোন কিংবা ডেস্কটপের মাউস-কিপ্যাড নিয়ে।

লেখালেখির সেকাল আর একালে মোটাদাগে পার্থক্য এখানেই। কাগজ-কলম আর কি-প্যাড। বইমেলার সেকাল আর একালে মৌলিক তেমন পার্থক্য তৈরি না হলেও বেড়েছে তার প্রচার-প্রসার ও পরিসর।

১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের উপর বসে কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন।

এই ৩২টি বই ছিলো চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা বই।

এরপর ১৯৭৮ সালে বইমেলার সাথে বাংলা একাডেমিকে যুক্ত করেন তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী। ১৯৭৯ সালে যুক্ত হয় সেই চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি।

১৯৮৩ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমিতে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে মেলার আয়োজন সম্পন্ন করলেও মেলা আর হয়নি তৎকালীন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে দু’জন ছাত্র মারা যাওয়ায়।

এটাও পড়ুন….
‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র গোড়াপত্তনের ইতিহাস

এরপর ১৯৮৪ সালে নতুন করে সাড়ম্বরে বর্তমান ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র সূচনা হয়। সেই যে শুরু আর পেছনে ফিরতে হয়নি। ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমিতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় মেলা সম্প্রসারণ হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত।

এরপর ২০১৫, ১৬’ ১৭’ ১৮’। একুশে বইমেলা পরিণত হয়েছে বাংলা ও বাঙালির প্রাণের মেলায়। বইমেলার সেকাল-একালে পার্থক্য খুঁজতে হলে এইটুকু ইতিহাসেই খুঁজতে হবে। ০১.০১.১৯ ইং, পূর্বাহ্ন।

নির্বাহী সম্পাদক, একুশ নিউজ২৪ ডটকম

/আরএ

Comments