বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ যখন ভারত; খেলোয়ার তখন ১৪ জন!

প্রকাশিত: ৮:৩৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৮

মারুফ মুনির

ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তানের খেলা মানেই অঘোষিত যুদ্ধ। মাঠের লড়াই চলে আসে চায়ের টেবিলে। চলে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। ভারত-পাকিস্তান ছাড়াও সারা বিশ্বের ক্রিকেট প্রেমিরা দুই দেশের পক্ষ নিয়ে বিভক্ত হয়ে যায়। মাঠের খেলোয়ারদের মাঝেও বিরাজ করে টান টান উত্তেজনা।

সাম্প্রতিকালের ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের পারফর্মেন্সে ভাটা পড়ায় সেই উত্তেজনা কিছুটা কমার আভাস পাওয়া যায়। অন্যদিকে ভারতের বিপক্ষে লড়াইয়ে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উন্নতিতে  সেই ফোকাসটা পড়ছে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচে। বড় কোনো টুর্নামেন্ট ভারত-বাংলাদেশ মানেই নতুন কোনো মহারণের প্রস্তুতি।

২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রথম ভারত-বাংলাদেশ মুখোমুখি হয়। সেই ম্যাচে বাংলোদেশের কাছে হেরে ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায়। এরপর থেকে বাংলাদেশে মানেই ভারতের কাছে নতুন এক আতঙ্কের নাম। বিশ্বকাপে তৃতীয়বার মখোমুখি হয় ২০১৫ সালে। ওই ম্যাচে ১০৯ রানের বিশাল জয় পায় ভারত। (এর আগে ১১ সালে ভারত জয়ী হয় ৮৭ রানে)।

ভারতের জয়ে বড় অবদান রোহিত শর্মার। রোহিত করেন ১৩৭ রান। কিন্তু রোহিত শর্মা সেদিন আউট হয়ে যেতে পারতেন ৯০ রানেই। আউট হয়েছিলেনও। কিন্তু আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে মাঠের বাইরে যেতে হয়নি রোহিতকে। আউট হওয়া বলটি ‘নো’ বল ডাকেন আম্পায়ার ইয়ান গোল্ড। বাংলাদেশি ক্রিকেট প্রেমিদের আক্ষেপ রোহিতের ওই ইনিংসের কাছেই হেরে গেছে বাংলাদেশ।

৯০ রানে অপরাজিত ছিলেন ভারতীয় ব্যাটসম্যান রোহিত শর্মা, এ সময় রুবেল হোসেনের একটা ফুলটস বলে ক্যাচ তুলে দেন। কিন্তু আম্পায়ার ইয়ান গোল্ড সেটিকে ডাকেন নো বল। যদিও রিপ্লেতে দেখা যায়, বলটি কোনো ভাবেই নো বল হয় না, রোহিতের কোমরের নিচেই ছিল বল। বেঁচে গিয়ে রোহিত আরও ৪৭ রান করেন, ভারতের রানও হয়ে যায় ৩০২!

ভারতের দেয়া ৩০৩ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশে যখন ২ উইকেটে ৭২ রান সেই মুহুর্তে আবারো আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে মাঠ ছাড়তে হয় মাহমুদ উল্লাহ রিয়াদকে।এবার মাঠের আম্পায়ার ছিলেন আলিম দার। মোহাম্মদ শামির একটা বল উড়িয়ে মেরেছিলেন মাহমুদ উল্লাহ। ক্যাচ ধরেন শিখর ধাওয়ান। ক্যাচ নেওয়ার সময় তাঁর পা লেগে গিয়েছিল বাউন্ডারি দড়িতে, কিন্তু চতুর্থ রেফারি সিদ্ধান্ত দিলেন—আউট! ওই ম্যাচ শেষে আম্পায়ার আলিম দার ও ইয়ান গোল্ড ব্যাপক সমালোচনার স্বীকার হন। ওই ঘটনার প্রতিবাদে আইসিসির প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন বিসিবি সভাপতি আ হ ম মোস্তফা কামাল

একই ম্যাচে দুটি ভুল সিদ্ধান্ত। একটি আউটের আরেকটি নট আউটের। অথচ দুটি সিদ্ধান্তই বাংলাদেশের বিপক্ষে। আম্পায়ারের সাহায্য নিয়ে জয়ী ভারতের ক্রিকেটাররা বাংলাদেশ দলকে নিয়ে উপহাস, টিটকাররী-টিপ্পনী কাটতেও দ্বিধা করেনি সেসময়। বিশেষ করে বিরেন্দ্রর শেবাগ এই দিক থেকে সবার চেয়ে এগিয়ে।

ভারতীয়দের এই ঔদ্ধত্যের জবাব তিনমাস পরেই ঠিক ঠিক দিয়ে দেয় বাংলাদেশ। হোম সিরিজে ভারতকে নাকানি-চুবানি দিয়ে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজে জয় তুলে নেয় প্রথম দুই ম্যাচ জিতেই। শেষ ম্যাচে কোনো রকম মান রক্ষার জয় পায় ভারত। এরপর থেকেই ভারত বাংলাদেশ ম্যাচ মানেই নিশ্চিত কোনো ফেভারিট নেই। বাংলাদেশের দিনে ভারতে হারানো কোনো কঠিন ব্যাপার না। এক সময় ভালো খেলার দাবি থেকে বাংলাদেশের জয় চাওয়া হয়ে যায় দর্শকদের প্রাণের দাবি। অন্যদিকে ভারতের যেন প্রতিজ্ঞা যে কোনোভাবেই হোক ম্যাচ জিততে হবে।

চলতি এশিয়া গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ভারত জয়ী হলেও শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠা বাংলাদেশকে কোনোভাবেই হালকা প্রতিপক্ষ ভাবতে রাজী হয়নি ভারতের সাবেক-বর্তমান কোনো ক্রিকেটারই। ফাইনালে ভারতকে প্রতিপক্ষ পেয়ে বাংলাদেশিদের সামনেও উঠে আসে সেই ১৫’ বিশ্বকাপের স্মৃতি। খেলা শুরুর আগে বাংলাদেশি দর্শক-শ্রোতা ক্রিকেট প্রেমিদের মনে পুরনো সেই ভয় উঁকি দিতে থাকে। রুবাইয়াত হোসেন নামে এক বাংলাদেশি ফেসবুকার খেলা শুরুর আগে স্টাটাস দেন আজ বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ১৪ জন। ১১ জন খেলোয়ার এবং ৩ জন আম্পায়ার।

রুবাইয়াত হাসান সহ বাংলাদেশি দর্শকদের সেই আশঙ্কাই খেলা চলাকালীন বাস্তবে হয়ে ধরা দিলো। টসে জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় ভারতীয় দলপতি রোহিত। ওপেনিং জুটিতে ১২০ রান তোলে লিটন দাস ও মেহেদি হাসান মিরাজ। এরপর মিরাজ আউট হলেও একপ্রান্ত আগলে রেখে খেলেতেছিলেন লিটন। ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিও তুলে নেন।

ইনিংসের ৪১তম ওভারের শেষ বলে (কুলদীপ যাদবের) এগিয়ে মারতে চেয়েছিলেন লিটন। টিভি রিপ্লাইয়ে দেখা গেছে, প্রথম পর্যায়ে পা ঠিক না থাকলেও ধোনি বল স্ট্যাম্পিং করার আগে নিরাপদে পা ছিল লিটন দাসের। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে থার্ড আম্পায়ার রড টাকার লিটন দাসকে আউট ঘোষণা করেন।

ওই মুহুর্তে লিটনের ওই উইকেটটি না পড়লে ম্যাচের ফলাফল ভিন্নরকম হতে পারতো। আরো কিছু রান অবশ্যই বাংলাদেশের স্কোর বোর্ডে জোগ হতো। কারণ ওই সময় লিটন ছাড়া আর কোনো ব্যাটসম্যাননই ক্রিজে সেট হতে পারছিলেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সামলোচনার ঝেরে রড টাকারে ফেসবুক আইডি ডিজেবল করে দেয়া হয়।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২২২ রানেই অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। আর মাত্র ২২৩ রানের লক্ষ্য নিয়ে খেলতে নেমে বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইন আপের দল ভারতে খেলতে হয়েছে ইনিংসের শেষ বল পর্যন্ত। এমনকি শেষ বলে যখন ১ রানের প্রয়োজন ছিলো ভারতের ঠিক রানই নিয়েছে। বেশি নিতে পারেনি। তাহলে বলাই যায় লিটন ক্রিজে থাকলে অল্প কয়েকটা রান হলেই পরাজয় বরণ করতে হতো ভারতকে।

বিশ্বকাপের ওই ম্যাচের পর আম্পায়ারদের পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিলও করে দেশের ক্রিকেট প্রেমিরা। আর এবার এশিয়া কাপে তো স্বয়ং টুর্নামেন্টের আয়োজকরাই ছিলো ভারতের পক্ষাপাতিত্বের ভুমিকায়। গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলো যখন অন্যান্য দল দুবাই-আবুদাবি আসা যাওয়া করে খেলছিলো সেখানে ভারতের সবগুলো ম্যাচ পড়ে দুবাইতে। এ নিয়েও সমালোচনা কম হয়নি। এমনকি ভারতের খেলা দুবাইতে রাখার জন্য টুর্নামেন্টের শেষ পর্যায়ে এসেও নিয়মের পরিবর্তন করে অনিয়ম করা হয়।

গ্রুব পর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন বা রানার্সআপ হওয়া পরের পর্বে প্রতিপক্ষ নির্ধারণে ভুমিকা রাখলেও এশিয়া কাপে এই বিষয়টাকে একেবারে গুরুত্বহীন করে ফেলে কর্তৃপক্ষ। এবারও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি আইসিসির কাছে অভিয়োগ জানিয়েছে। কিন্তু কী লাভ এই অভিযোগ জানিয়ে? কোনো ফলাফল আসবে কী? সম্ভাবনা নেই।

কেনন, এখনো সেই ১৫’ বিশ্বকাপের গাদ্দারির শাস্তি দেয়া হয়নি আম্পারদের। সতর্ক করা হয়নি ভারতকে। দিনকে দিন প্রতিটা টুর্নামেন্টে ভারতকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে জিতিয়ে দিতে যেন ক্রিকেট সংস্থাগুলো ওয়াদাবদ্ধ হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে ক্রিকেটের ভবিষ্যত যে খুব ভালো হবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। ক্রিকেটে ভারতের অবৈধ আধিপত্যের অবসান হোক এটা সারা বিশ্বের ক্রিকেট প্রেমিদের দাবি। যতদিন না আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থাগুলো এই দাবির মর্ম বুঝতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত ফিরবে না ক্রিকেটের সু-দিন।

/এমএম

Comments