পশ্চিমবঙ্গ কি বাম থেকে ‘রাম’ রাজনীতির দিকে যাচ্ছে?

প্রকাশিত: ৬:২০ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৬, ২০১৮

স্টাফ রিপোর্টার : রামচন্দ্র- দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে রয়েছেন, বিশেষত উত্তর ভারতে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এটা নতুন।

কিন্তু সেই রামচন্দ্রকে কেন্দ্র করেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বেশ কয়েকটি এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-সংঘর্ষ ঘটেছে গত সপ্তাহে। মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৫ জনের, পুলিশ কর্মকর্তাসহ আহত হয়েছেন আরো অনেকে। ভাঙা হয়েছে বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বহু দোকান-বাড়িঘর।

কেন দাঙ্গা শুরু হল রামনবমীকে কেন্দ্র করে, তা নিয়ে উঠে আসছে নানা তত্ত্ব, যার মধ্যে একটা কথা সকলেই বলছেন- ‘এর পিছনে ধর্ম নেই, রয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াই’।

পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্প শহর আসানসোলে যেদিন রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হল, সেই সময়ে সেখানে হাজির কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিক যে ছবি তুলেছেন, তাতে দেখা গেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষ একদিকে রামনবমীর মিছিল নিয়ে যাচ্ছেন, মাঝখানে মাঠে হাতে-গোনা কয়েকজন পুলিশ কর্মী। আর অন্যদিকে জড়ো হয়েছেন প্রচুর সংখ্যায় মুসলমান ।

পরের অবস্থা সবাই দেখেছেন বিভিন্ন নিউজের মাধ্যমে।  ছবিতে দেখা গেছে কোথাও জ্বলে যাওয়া দোকান, পুড়ে যাওয়া গাড়ির কঙ্কাল বা রাস্তার ধারে বাতি-স্তম্ভে ঝুলছে ভেঙ্গে দেওয়া ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা। রেল-কর্মীদের আবাসনে একের পর এক কোয়ার্টার তালাবন্ধ। তবুও ছিলেন কয়েকজন নারী পুরুষ। তারা অভিযোগ করছিলেন যে- কীভাবে রামনবমীর মিছিলের ওপরে পাথর ছোঁড়া শুরু হয়। কেউ বর্ণনা দিচ্ছিলেন কীভাবে ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার পানের দোকান।


দাঙ্গায় পুড়ছে বাড়িঘর

একজন প্রবীণ ব্যক্তি, যিনি বহু বছর আছেন এই এলাকায়। তিনি বললেন, ‘আগে হয়তো ছোটখাটো অশান্তি হয়েছে, কিন্তু এত বড় দাঙ্গা কখনও হয় নি।” তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, “তাহলে এবার দাঙ্গা হওয়ার কারণ কি?” জবাবে ওখানে হাজির ৪/৫ জন একসঙ্গেই বললেন, “এটা রাজনীতির ব্যাপার।”

ওই আবাসনের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছিলেন কাছেই গড়ে তোলা একটা শিবিরে। তাদেরই কয়েকজন বলছিলেন, “আমার মিষ্টির দোকানটা লুট করে জ্বালিয়ে দিল। পাশাপাশি আরও দশ-বারোটা দোকান জ্বালিয়ে দিয়েছে। চার-পাঁচটা গাড়িও জ্বালিয়েছে। ভয়ে পালিয়ে এসেছি বাড়ি থেকে’।

ওই রেল কলোনি পেরিয়ে বেশ কিছুটা দূরেই কুরেশী মহল্লায়। সেখানে পাল্টা অভিযোগ শুনা গেল , আমরা কোনদিন হিন্দুদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি নি। দুর্গাপুজোর সময়ে আমরা মুসলমানরা ওদের জল খাওয়ার ব্যবস্থা করি। এখানেও তো এতগুলো হিন্দু বাড়ি, দোকান আছে, জ্বালিয়েছি আমরা একটাও? ওরা কেন মিছিল থেকে আমাদের গালিগালাজ করতে থাকল?

হিন্দু প্রধান এলাকায় যেমন অনেকেরই অভিযোগের তীর মুসলমানদের দিকে, তেমন কুরেশী মহল্লায়ও অভিযোগের তীর হিন্দুদের প্রতি। শিল্পাঞ্চল আসানসোল অথবা কয়লাখনি অঞ্চল রাণীগঞ্জে সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা দেখা যায় নি।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মভূমি চুরুলিয়ার খুব কাছের শহর আসানসোলের আনুষ্ঠানিক নামই সৌভ্রাতৃত্বের শহর। কিন্তু গত সপ্তাহের দাঙ্গার পরে সাধারণ মানুষও ভাবছেন যে কবে কীভাবে পাল্টে গেল তাদের চেনা শহরটা?


পুড়ে গেছে ঘর-বাড়িসহ সব কিছুই

আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইউনাইটেড রিলিজিয়নস ইনিশিয়েটিভের ভারতের সমন্বয়ক ও আসানসোল লাগোয়া বর্ণপুরের বাসিন্দা বিশ্বদেব চক্রবর্তী এ প্রশ্নরে উত্তরে বলেন, এটা আমাদের কাছেও খুব আশ্চর্যের। যেভাবে আমরা ছোট থেকে সবাই বড় হয়েছি, সবার সঙ্গে মেলামেশা করেছি, তাতে এই শহরে এরকম সাম্প্রদায়িক অশান্তি হওয়ার কথা নয়। তবে তৃণমূল স্তরে কাজ করতে গিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে টের পাচ্ছিলাম যে একটা কিছু দানা বাঁধছে। তবে বারুদের স্তূপটা যে এত তাড়াতাড়ি জ্বলে উঠবে, সেটা আন্দাজ করা যায় নি। এর জন্য শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতারা দায়ী- কোন ধর্মের মানুষের এতে কোন ভূমিকা নেই।

তৃণমূল কংগ্রেসের শিল্পাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও আসানসোল শহরের মেয়র জিতেন্দ্র তেওয়ারী বলছিলেন গত সপ্তাহে যা ঘটেছে, তার পরেও শিল্পাঞ্চলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি অটুটই রয়েছে।

তার কথায়, এত কিছুর পরেও বলব যে আসানসোলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রয়েছে। আপনি হিন্দু প্রধান এলাকায় গিয়ে দেখুন সেখানে যাতে মুসলমানরা নিরাপদে থাকেন, তার ব্যবস্থা করছে হিন্দুরা, আবার মুসলমান এলাকাতেও একই ঘটনা। তাহলে এটা তদন্ত করে দেখা দরকার যে রামনবমীকে কেন্দ্র করে অশান্তিটা বাইরে থেকে এসে কারা বাঁধাল?

‘রামনবমীকে কেন্দ্র করে আগে কোন দিন শুনেছেন আসানসোল অথবা পশ্চিমবঙ্গের কোথাও সংখ্যালঘুদের ওপরে আক্রমণ হয়েছে, কারও মৃত্যু হয়েছে? চিরাচরিতভাবেই তো অস্ত্র নিয়ে মিছিল হয়। ওটা তো আমাদের পুজোর অঙ্গ- কাউকে আক্রমণ করার জন্য নয়। এবার হঠাৎ করে রাজ্য প্রশাসন এই অস্ত্র নিয়ে মিছিল করাকে কেন্দ্র করে এত বড় ইস্যু কেন তৈরি করল?’ প্রশ্ন পশ্চিম বর্ধমান জেলা বিজেপির মুখপাত্র প্রশান্ত চক্রবর্তীর।


বাড়তি নিরাপত্তা

গত সপ্তাহে দাঙ্গা যে শুধু আসানসোল শিল্পাঞ্চলে হয়েছে, তা নয়। পশ্চিমবঙ্গের নানা এলাকাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল রামনবমী পালনকে কেন্দ্র করে সেই অশান্তি।

কলকাতায় বসে সেই সব ঘটনার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অধ্যাপক মীরাতুন নাহারের মনে হয়েছে, “একদিকে রয়েছে এমন একটি দল, যারা মুখোশ খুলে ফেলে একেবারে সরাসরি এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটানোর ব্যবস্থা করছে। ওই দলটি হিন্দু জাতি রক্ষার জন্য রামনবমীর মতো নানা ইস্যুতে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা করার কাজে নিজেদের নিমগ্ন রেখেছে। এটাই তাদের যেন জাতীয় কর্তব্য। আবার অন্য একটি দল, যারা দেখাতে চায় যে এই রাজ্যের মুসলমানদের প্রতি তাদের সহানুভূতি আছে, এই বিষয়ে তারা কোন আপোষ করবে না। তার ফলে আবার অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা ধর্মান্ধ, গোঁড়া, তাদের ইন্ধন যোগানো হচ্ছে। এটা একেবারেই ঠিক হচ্ছে না।”

মিসেস নাহার যে দল দুটির নাম না করে ঘটনাগুলির বিশ্লেষণ করছিলেন, সেই দুটি দলের নাম করেই বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের প্রধান মুহম্মদ কামরুজ্জামান।

সবটাই ক্ষমতা দখলের লড়াই। কিন্তু যেভাবে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি উভয়ই রামনবমীর মিছিল করল, সেটা বাংলার জন্য একটা অশুভ ইঙ্গিত। এ রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তো মমতা ব্যানার্জীর প্রশাসনের প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রদর্শন করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কী করে মুসলিম এলাকাগুলোর মধ্যে দিয়ে ওই সব অস্ত্র হাতে মিছিল যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হল? সেই প্রশ্নের জবাব আমরা পাচ্ছি না।

অনেকেই অভিযোগ করছেন, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর বিরোধিতা করতে গিয়ে নিজেরাও রামনবমীর মিছিল করার মাধ্যমে সরাসরি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সক্রিয় হয়ে মস্ত ভুল করেছে রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস।


জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে মোটর সাইকেলও

‘বিজেপি যে হিন্দুত্বের রাজনীতি করতে চায়, তাকে মোকাবিলা করতে গিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস যদি নরম হিন্দুত্বের পথে হাঁটেন, সেটা কিন্তু আগুনকে ডেকে আনা। সারা ভারতেই বিজেপি এই রাজনীতিতে চ্যাম্পিয়ন, এটা তাদের চেনা মাঠ। সেই মাঠে কেন তৃণমূল খেলতে নামবে? রাজনৈতিক ভাবে বিজেপির বিরোধিতা করতে হলে তো তৃণমূল কংগ্রেসের উচিত ছিল নিজেদের চেনা রাজনীতির ময়দানে বিজেপিকে নিয়ে আসা। এই ভুল যদি তৃণমূল কংগ্রেস না শোধরায়, ওই আগুনে তারাও পুড়বে একদিন,’  বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিত ভট্টাচার্য।

ধর্মভিত্তিক এই রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে নতুন হলেও কলকাতার চারুচন্দ্র কলেজের অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ বলছিলেন, রামকে কেন্দ্র করে রাজনীতি মোটেই ভারতে নতুন নয়। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীও রাজনীতিতে রামকে নিয়ে এসেছেন একভাবে, আবার বিজেপিও পশ্চিমবঙ্গে শক্তি বাড়াতে আঁকড়ে ধরেছে সেই রামচন্দ্রকেই।

পশ্চিমবঙ্গে পায়ের তলার জমি শক্ত করতে বিজেপির কিছু ইস্যু দরকার। নানা বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতা করা বা বিরোধী রাজনীতিকে এখানে যেভাবে জায়গা দেওয়া হচ্ছে না বলে তারা মনে করছে, এগুলো তো আছেই। কিন্তু ভোট বাড়ানোর জন্য তাদের এর বাইরেও কিছু ইস্যু প্রয়োজন। সেরকমই একটা ইস্যু হচ্ছে রাম। কোনো একসময়ে তিনি হয়তো শুধুই মহাকাব্যিক চরিত্র ছিলেন, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই রাম ভারতীয় রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছেন। পশ্চিমবঙ্গেও গত কয়েক বছর ধরে যে আকারে রামনবমীর মিছিল দেখছি, তাতে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে রাম এই রাজ্যেও রাজনীতিতে এসে পড়েছেন।


ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রামনবমী পালনকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় অন্তত ৫ জন নিহত হয়েছে

তবে রামনবমী এবং রামচন্দ্রকে কেন্দ্র করে যে দাঙ্গা, তার মধ্যেই হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির এক অনন্য নজির তৈরি করেছেন আসানসোল শহরেরই এক ইমাম। ওই দাঙ্গার পরের দিন ১৬ বছর বয়সী ছেলের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ খুঁজে পাওয়ার পরেও মাওলানা মুহম্মদ ইমদাদুল্লাহ রশিদী মাইক হাতে এলাকায় বলে বেরিয়েছেন যে তার ছেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কেউ যেন দাঙ্গা না লাগায়। সেদিন আর মহুয়াডাঙ্গাল এলাকায় দাঙ্গা ছড়ায় নি।

ইমাম রশিদিকে যেমন সেলাম করছেন ওই এলাকার হিন্দু মুসলমান, তেমনই কবিতা বা গানের মধ্যে দিয়ে সেলাম জানিয়েছেন মন্দাক্রান্তা সেন আর কবীর সুমন। দাঙ্গাবাজদের কাছেও সম্ভবত পৌঁছেছে ওই বার্তা। তাই আপাতত স্তিমিত হয়েছে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ।

বিবিসি

Comments