বিচারপতি সিনহা; আইনমন্ত্রীর অভিযোগ ও দুদক চেয়ারম্যানের বিব্রতবোধ

প্রকাশিত: ৮:৫০ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৮

শাহনূর শাহীন

সম্প্রতি সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার আত্মজীবনীমূলক বই ‘এ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেস’ প্রকাশ হয়। বইটি প্রকাশের পর থেকেই বিচারপতি থাকাকালীন ষোড়ষ ষংশোধনী রায় নিয়ে সরকারের সাথে প্রধান বিচারপতির সম্পর্কের টানাপোড়েনসহ নানান বিষয় নতুন করে আলোচনায় ওঠে আসে। ২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর বিচার বিভাগের অবকাশকালীন ছুটিতে বিদেশ যান। গণমাধ্যমের ভাষ্যানুযায়ী, বিদেশে যাওয়ার আগে বেশ কিছুদিন কার্যত তিনি অবরুদ্ধ ছিলেন।

সরকারের পক্ষ থেকে সে সময় বলা হয় বিচারপতি সিনহা অসুস্থ। কিন্ত দেশ ছাড়ার আগে বিচারপতি সিনহা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সামনে রীতিমত বোমা ফাটান। তিনি অসুস্থ নন এবং চিকিৎসার জন্যও বিদেশ যাচ্ছেন না বলে সাংবাদিকদের জানান। এরপর বিদেশ থেকেই বিচারপতি সিনহা পদত্যাদ করেন।

গণমাধ্যমের ভাষ্যমতে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর ক্ষমতাসীনদের রোষের মুখে থাকা বিচারপতি সিনহা গত অক্টোবরে ছুটি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর পর সেখান থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। এরপর তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে; তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, দুদক এমন একটি দুর্নীতির অনুসন্ধানেও নামে। সম্প্রতি বিচারপতি সিনহা তার লেখা বইয়ে দাবি করেন, তাকে জোর করে পদত্যাগ করিয়ে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে (বিডি নিউজ, সোমবার-২৪.০৯.১৮)।

এসকে সিনহা তারা আত্মজীবনীমূরক বইয়ে বিচারপতি থাকাকালীন সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের টানাপোড়েনসহ তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা সহ নানান অভিযোগ আনেন। এরই প্রেক্ষিতে সিনহার বক্তব্যের সমালোচনা করেন আইনমন্ত্রী। গত রোববার আইনমন্ত্রী সিনহার বক্তব্যকে পরাজিত ব্যক্তির হা-হুতাশ উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখছে দুদক (প্রথম আলো, রোববার-২৩.০৯.১৮)।

বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পরও আইনমন্ত্রী জানিয়েছেলেন, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগের কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়। বলা হয়, ওইসব অভিযোগের কারণে আপিল বিভাগের অন্য বিচারকরা আর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসে মামলা নিষ্পত্তিতে রাজি নন।

এসব বিষয়েই সিনহার বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ তদন্ত কিংবা মামলা হবে কিনা দুদক চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চান সাংবাদিকরা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদুক চেয়ারম্যান বিব্রতবোধ করেন। মাননীয় মন্ত্রীর কথায় এসকে সিনহার বিরুদ্ধে মামলা হবে না, অনুসন্ধানও হবে না। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে আইনমন্ত্রীর দূর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এমন কথাই বলেছেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।

সিনহার বিরুদ্ধে তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, শোনেন, মাননীয় মন্ত্রী উনার ইচ্ছা যা, বলতেই পারেন। মাননীয় মন্ত্রীর কথায় তো মামলা হবে না, অনুসন্ধানও হবে না। সরকার নিজেরাই বলে স্বাধীন কমিশন। সো, মাননীয় মন্ত্রী যা বলেছেন, উনারটা উনাকেই জিজ্ঞাস করেন, আমাকে না। মন্ত্রীর কথায় কোনো প্রভাব দুদকে পড়বে না। এটা আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি। যথাযথ এভিডেন্স ছাড়া কারো বিরুদ্ধে অনুসন্ধান বা তদন্ত হবে না।

এস কে সিনহার বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান পাল্টা প্রশ্ন করে সাংবাদিকদের বলেন, কই, আপনাদের কাছে ১১টি অভিযোগ আছে না কি? থাকলে দেন। ফার্মাস ব্যাংক থেকে দুই ব্যক্তির অবৈধভাবে চার কোটি টাকা ঋণ উত্তোলন তারপর সেই টাকা অন্য আরেক ব্যবসায়ী হয়ে এস কে সিনহার বাড়ি বিক্রি বাবদ তার ব্যাংক হিসাবে ঢুকা সংক্রান্ত অভিযোগের ব্যাপারেও দুদক চেয়ারম্যান বিব্রতবোধ করেন।

সাবেক ওই প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুদকে কোনো অনুসন্ধান চলছে কি না- জানতে চাইলে ইকবাল মাহমুদ বলেন, সেই প্রশ্নের জবাব এখন আমি দেব না। আপনাদেরকে ওয়েট করতে হবে। আপনারা এভাবে একটা প্রশ্ন করলে আমার জন্য অসুবিধা হয়। কারণ আমাকে দেখতে হবে, বুঝতে হবে, জানতে হবে। আপনারা এমন একজন ব্যক্তির ব্যাপারে বলছেন, অনেক বড় ও বৃহৎ। আমাকে বিব্রত না করাটাই সবার জন্য ভালো।

প্রশ্ন হলো এসকে সিনহা কি সত্যিই সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত নাকি সরকার তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে। যদি তিনি অভিযুক্তই হয়ে থাকেন তবে কেন তাকে বিদেশ যেতে বাধ্য করা হলো কিংবা ছুটি শেষে দেশে ফিরতে দেয়া হয়নি। দেশে ফিরার ব্যাপারে যদি সরকারের তরফ থেকে কোনো প্রকার আপত্তি না-ই থাকতো তাহলে তার ফেরার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলের কোনো আগ্রহ নেই কেন। প্রশ্ন এটাও ওঠে, বিদেশ থেকে পাঠানো পদত্যাগপত্র কেন গ্রহণ করা হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে রাষ্ট্রপতি চাইলে তার পদত্যাগ পত্র গ্রহণ না করে দেশে ফেরার নির্দেশ দিতে পারতেন কিন্তু সেটা করা হয়নি।

দ্বিতীয় সংস্করণে আরো অনেক তথ্য সংযুক্ত হবে: বিচারপতি সিনহা

একটি নয় দুটি নয় অর্থ আত্মসাৎসহ ১১টি গুরুতর অভিযোগ! যে অভিযোগের কারণে অন্যান্য বিচারপতিগণ তার সাথে এজলাসে বসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সরকারের তরফ থেকে দেয়া তথ্যানুযায়ী নারী কেলেঙ্কারী জনিত অভিযোগও নাকি ছিলো। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে এতোগুলো অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দেশ ছাড়তে দেয়া হলো কেন।

এসকে সিনহা যখন দেশ ছাড়েন সে সময় জনমনে বিষয়টা স্পষ্টই ধরা দিয়েছে যে, ষোড়ষ সংশোধনী রায় নিয়ে সরকার অসন্তুষ্ট। রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিলও করেছে। কিন্তু সেটাও সময় ক্ষেপন করে, সিনহা আর এজলাসে বসতে পারবে না এটা নিশ্চিত হওয়ার পর। সরকার ওই রায়ের পরিবর্তন চায় কিন্তু এসকে সিনহার ঘাড়ের ওপর নল রেখেও সেটা পরিবর্তন করা যাবে না জেনে সরকার স্বয়ং তাকেই সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে।

প্রথমত অসুস্থতার কথা বলে গৃহবন্দি করা হয়। তারপর দেশ ছাড়তে এবং বিদেশ থেকেই পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এমন অভিযোগই করছেন এখন বিচারপতি সিনহা। সে সময়ের গুঞ্জন আর এই সময়ে এসে সিনহার আত্মকথা এটাই জানান দেয় যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এখন তালুবন্দি। প্রশ্ন ওঠে স্বাধীন বিচার বিভাগ কি সত্যিই স্বাধীন?

লেখক: কবি ও কলামিস্ট

/এমএম

Comments