এরদোগানের সঙ্গে ওজিলের বন্ধুত্বের রহস্য কী?

প্রকাশিত: ৩:৩৯ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৫, ২০১৯

মোয়াজ্জেম হোসেন মানিক


এটা স্বাভাবিক যে ফুটবলের মতো তুমুল জনপ্রিয় খেলা রাজনীতিতেও বড় ভূমিকা রাখতে পারে। খেলাটির মহাতারকাদেরও প্রায়ই রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ঘনিষ্টতা দেখা যায়। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে প্রয়াত কিউবান প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রো কিংবা ভেনেজুয়েলার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজের সম্পর্কের কথা তো সুবিদিত।

আর্সেনালের জার্মান ফুটবলার মেসুত ওজিলের সঙ্গে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের মধ্যে বন্ধুত্ব কিছুটা অবাক করার মতো। একে তো তুর্কি প্রেসিডেন্ট একজন বিতর্কিত রাজনীতিবিদ, তার ওপর আবার ওজিল তুর্কি বংশোদ্ভুত হলেও বিশ্বকাপজয়ী মিডফিল্ডারের জাতীয়তা কিন্তু জার্মান। এমনকি এই সম্পর্ক আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে ২০১৮ সালেই তার অবসর নিয়ে নেওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। রাশিয়া বিশ্বকাপে জার্মানির দলীয় ব্যর্থতার দায় ওজিলের কাঁধে চাপানোর পেছনেও ওই সম্পর্ক দায়ী বলেই অনেকে মনে করেন।

.কে এই এরদোগান?
রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান তুরস্কের ১২তম প্রেসিডেন্ট। ২০১৪ সালের আগস্টে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি ২০০৩ সালের মে থেকে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এবং তারও আগে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ইস্তানবুলের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তুরস্কের বৃহৎ রাজনৈতিক দল ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি) এর নেতা এরদোগানের খেলার সঙ্গে যোগসূত্র অনেক পুরনো। তিনি একসময় তার স্থানীয় দল কাসিমপাসা’র হয়ে পেশাদার ফুটবল খেলেছেন। বর্তমানে ওই ক্লাবের নিজস্ব স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে এরদোগানের নামে।

কীভাবে এরদোগানের সঙ্গে পরিচয় হলো ওজিলের?
২০১০ সালে প্রথমবারের মতো এরদোগানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ওজিলের। ওই সময় বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে তুরস্ক এবং জার্মানি মুখোমুখি হয়েছিল। বার্লিনে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচটি জার্মানির চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মেরকেলের সঙ্গে গ্যালারিতে বসে উপভোগ করেন তৎকালীন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী এরদোগান। ম্যাচটি ৩-০ গোলে জিতে যায় জার্মানি।

.মজার ব্যাপার হলো, ম্যাচের দ্বিতীয় গোলটি করেন ওজিল আর গ্যালারিতে উপস্থিত তুর্কি সমর্থকরা তাকে দুয়ো দিতে থাকেন। তবে গোল উদযাপনের সময় তার শান্ত থাকা অনেকের নজরে পড়ে। পরে তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, পূর্বপুরুষদের জন্মভূমিকে সম্মান জানাতেই তিনি অমনটা করেছিলেন। সেই ঘটনার পর বিশ্বজুড়ে অনেক উপলক্ষে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছেন এরদোগান ও ওজিল।

কিন্তু ২০১৮ বিশ্বকাপের ঠিক আগে এক সাক্ষাৎকারের ঘটনায় তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন ওজিল। এমনকি তার দিকে তোপ দাগায় জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ডিএফবি)। লন্ডন সফররত এরদোগানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন ওজিল, ম্যানচেস্টার সিটির মিডফিল্ডার ইকাই গুন্দোগান এবং এভারটনের স্ট্রাইকার সেঙ্ক টসান। এরপর তাদের ওই সাক্ষাৎকারের ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়লে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়।

তবে সমালোচনার তুমুল ঢেউ এরদোগান-ওজিলের বন্ধুত্বে এতটুকু ফাটল ধরাতে পারেনি। বরং সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। কিছুদিন আগে ওজিলের বিয়েতেও সস্ত্রীক উপস্থিত হয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট।

.এরদোগানের সঙ্গে ওজিলের বন্ধুত্ব এত বিতর্কিত কেন?
সব খেলারই তারকাদের প্রায়ই নিজ নিজ রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেখা যায়। কিন্তু এরদোগানের সঙ্গে ওজিলের সম্পর্ক এক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে আলাভাবে নজর কেড়েছে। মূলত এরদোগানের বিতর্কিত রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের কারণেই এমনটা হয়েছে। তার মেয়াদে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্কে ফাটল ধরাও বড় কারণ। এছাড়া, এরদোগান সরকারের বিরুদ্ধে তুরস্কে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী এবং বিরোধী মত দমনের অভিযোগও তুলেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।

২০১৪ সালে একবার রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি হলে তুরস্কে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ রাখা হয় ইউটিউব, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমও। তাছাড়া ২০১৭ সাল থেকে দেশটিতে উইকিপিডিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবাসাইটও বন্ধ রাখা হয়েছে।

বিশেষ করে ওজিলের জন্মভূমি জার্মানির সঙ্গে তুরস্কের তিক্ত সম্পর্ক এতে বড় ভূমিকা রেখেছে। ২০১১ সালে মধ্য ইউরোপের দেশগুলোর অভিবাসন নীতি নিয়ে সমালোচনা করতে গিয়ে ওজিল যেসব তুর্কি অভিবাসী জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করছে তাদের জার্মান ভাষার আগে তুর্কি ভাষা শেখা উচিৎ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এই নিয়ে সেসময় জার্মানির রাজনীতিবিদরা তাকে তুলোধুনা করেছিলেন।

এরপর ২০১৮ সালে এরদোগানের সঙ্গে ওজিলের সাক্ষাৎকারের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে। ডিএফবি’ সাবেক প্রেসিডেন্ট রেইনহার্ড গ্রিন্ডেল সেসময় এই নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ডিএফবি অভিবাসী ব্যাকগ্রাউন্ড থাকা খেলোয়াড়দের বিশেষ অবস্থাকে সম্মান করে। কিন্তু ফুটবল এবং ডিএফবি যে মূল্যবোধ ধারণ করে তাকে এরদোগান সম্মান দেখান না।’

.‘এটা মোটেই ভালো কিছু নয় যে, আমাদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা কারও নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। এটা জার্মান ফুটবলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার বিপক্ষে।’

সাফাই দিতে গিয়ে অবশ্য এরদোগানের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ‘রাজনৈতিক কিংবা নির্বাচনী’ বলাতে আপত্তি প্রকাশ করেন ওজিল। এক ‍টুইটে তিনি বলেন, ‘তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সঙ্গে ছবি তোলা আমার জন্য রাজনৈতিক ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিষয় ছিল না, এটা আমার পরিবারের দেশের সর্বোচ্চ অফিসকে সম্মান করার মতো বিষয় ছিল। কিন্তু জার্মান ফুটবল ফেডারেশন ও আরও অনেকে আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছে তাতে আমার আর জার্মানির জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলার আগ্রহ শেষ করে দিয়েছে। আমি অবাঞ্চিত বোধ করছি এবং আমি মনে করি ২০০৯ সালে অভিষিক্ত হওয়ার পর যা অর্জন করেছি তা বিস্মৃত হয়ে গেছে।’

.নিজেকে অর্ধেক জার্মান, অর্ধেক তুর্কি বলে অভিহিত করে ওজিল লেখেন, ‘আমার দু’টি হৃদয়, একটি জার্মান আর একটি তুর্কি। তারা (সমালোচক) আমার পারফরম্যান্সের সমালোচনা করে না, তারা দলের পারফরম্যান্স নিয়েও সমালোচনা করে না, তারা শুধু আমার তুর্কি পরিচয় নিয়ে সমালোচনা করে।…আমি যখন জয়ী হই তখন জার্মান আর যখন হেরে যাই তখন আমি (তুরস্কের) শরণার্থী।’

ওজিলের এমন বক্তব্য ও সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তুরস্কের বিচার বিষয়ক মন্ত্রী আব্দুলহামিত গুল টুইটারে লিখেছিলেন, ‘আমি মেসুত ওজিলকে অভিনন্দন জানাই, সে জাতীয় দলে না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফ্যাসিবাদের ভাইরাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সুন্দর গোল করেছে।’

তুরস্কের ক্রীড়ামন্ত্রী মেহমেত কাসাপোগলু লিখেছিলেন, ‘আমাদের ভাই মেসুত ওজিল যে সম্মানজনক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে আমি তাকে সর্বতোভাবে সমর্থন করি।’

ওজিলের জাতীয় দল ত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে আসার আগেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের মুখপাত্র ইব্রাহীম কালিন বলেন, ‘যারা নিজেদের সহনশীল আর বহুবিচিত্র সংস্কৃতির ধারক বলে দাবি করে, তাদের জন্য কষ্টের বিষয়ই হতে পারে এরদোগানের সঙ্গে ওজিলের সাক্ষাৎ।’

.ও হ্যাঁ, ওজিলের জার্মানির পাশাপাশি তুরস্কের নাগরিকত্ব আছে। তুরস্কে তার ছবি সংবলিত হাজারো পোস্টার ও বিলবোর্ড দেখা যায়। এগুলোর কোনো কোনোটিতে আবার ওজিলের সঙ্গে এরদোগানকেও দেখা যায়। সবমিলিয়ে তাদের বন্ধুত্ব আসলে ভিন্ন এক স্বাদের, ভিন্ন এক ধাঁচের। এজন্যই অনেকের কাছে বিষয়টা ঠিকভাবে হজম হতে চায় না।

Comments