প্রিয়া সাহার অভিযোগে কি পদক্ষেপ নেবেন ট্রাম্প?

প্রকাশিত: ৩:৪৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ২২, ২০১৯

বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নারী প্রিয়া সাহার অভিযোগকে কতটুকু আমলে নেবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প? এ জন্য ট্রাম্প কী করতে পারেন এমনটি এখন আলোচনার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কয়েকদিন আগে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশি নারী প্রিয়া সাহার কিছু অভিযোগ নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়েছে। তবে প্রিয়া সাহার অভিযোগে মার্কিন প্রশাসন কোন পদক্ষেপই নেবে না বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করলেও কেউ কেউ মনে করছে এটা দেশের জন্য হুমকি স্বরুপ।

গত ১৬ জুলাই ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার ২৭ ব্যক্তির সাথে বৈঠক করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধির সাথে ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়ে প্রিয়া সাহা উপস্থিত হয়ে ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেন, ‘আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশে তিন কোটি ৭০ লাখ হিন্দু-বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান নিখোঁজ রয়েছেন। দয়া করে আমাদের লোকজনকে সহায়তা করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই। এখন সেখানে এক কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু রয়েছে। আমরা আমাদের বাড়ি-ঘর খুইয়েছি। তারা আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, তারা আমাদের ভূমি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বিচার পাইনি।’

এক পর্যায়ে ট্রাম্প নিজেই সহানুভূতিশীল হয়ে প্রিয়া সাহার সাথে হাত মেলান। এ সময় ট্রাম্প প্রশ্ন করেন, ‘কারা জমি দখল করেছে, কারা বাড়ি-ঘর দখল করেছে?’

ট্রাম্পের প্রশ্নের উত্তরে প্রিয়া সাহা বলেন, ‘তারা মুসলিম মৌলবাদী গ্রুপ এবং তারা সব সময় রাজনৈতিক আশ্রয় পায়।’ মার্কিন টিভি চ্যানেল এবিসি নেটওয়ার্কের চ্যানেল এবিসি ফোর ট্রাম্পের সাথে প্রিয়া সাহার সেই সাক্ষাৎকারের ভিডিও প্রকাশ করার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সেটি।

অভিযোগকারী এ নারী বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এই সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা।

এরপর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অনেক বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনকার্ড পাওয়ার আশায় এমন মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন তিনি। তবে প্রিয়া সাহা এমন অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও সত্য নয় বলে দাবি করছেন। তিনি বলেন, কোনো কিছু পাওয়ার আশায় ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেননি তিনি। আর অবশ্যই বাংলোদেশে ফিরে আসবেন।

বিষয়টি নিয়ে সরকার, রাজনীতিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। গতকাল রোববার একটি ভিডিওতে প্রিয়া সাহাকে বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা দিতে দেখা যায়। তবে তিনি ঐ ভিডিওতে কোন নির্দিষ্ট উত্তরই দিতে পারেননি।

এদিকে অনেকে বলছেন, ঐ হিন্দু নেত্রী জেনে-বুঝে বিদেশে গিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন। তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলার আবেদন করলে আদালত তা খারিজ করে দেন।

অন্যদিকে শনিবার তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দেওয়ার কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তবে রোববার প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে তিনি জানান, প্রিয়াকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হবে তারপর আইনি পদক্ষেপ।

ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করার পরপরই বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিলার বলেছেন, প্রিয়ার অভিযোগ সত্য নয় কেননা তিনি বাংলাদেশ ঘুরে দেখেছেন এখানে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রয়েছে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে প্রিয়া সাহা যে অভিযোগ তুলে ধরেছেন তাকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, হোয়াইট হাউস বা মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর কতটা গুরুত্ব দিতে পারে? যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এঅ্যান্ডএম ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সমাজ ও রাজনীতির অধ্যাপক মেহনাজ মোমেন গতকাল রোববার বিবিসিকে বলেন, ‘আমেরিকা কোন কথাকে গুরুত্ব দেবে কি দেবে না তা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। অভিযোগ যদি এমন দেশ বা অঞ্চল থেকে আসে, যেখানে আমেরিকার বিশেষ স্বার্থ আছে, তখন ওই অভিযোগের গুরুত্বও ভিন্ন রকম হয়।’

উদাহরণস্বরূপ অধ্যাপক মোমেন বলেন, ‘ইরাক যুদ্ধের আগে ইরাকের নাগরিকরা তাদের অত্যাচার-নির্যাতন নিয়ে অভিযোগ করলেই সেগুলো তখন রেডিও, টিভি, সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচার হতো। ঐ সব অভিযোগ দিয়ে তখন ইরাক যুদ্ধকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা হয়েছে।’

তারও আগে পঞ্চাশের দশকে কিউবা থেকে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে অভাব-অভিযোগ ফলাও করে প্রচার করা হতো। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এখন যে সম্পর্ক তাতে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে প্রিয়া সাহার অভাব-অভিযোগ তেমন কোনো গুরুত্ব পাবে বলে মনে করছেন না অধ্যাপক মেহনাজ মোমেন। ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক এখন আমি বলব বেশ স্থিতিশীল। সুতরাং প্রিয়া সাহার অভিযোগকে ট্রাম্প তেমন কোনো গুরুত্ব দেবেন সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।’ বলেন মেহনাজ মোমেন।

তিনি আরও বলেন, ‘হয়তো বাংলাদেশ শব্দটি তার পরিচিত বলে প্রেসিডেন্ট প্রিয়া সাহার কথা শুনেছেন… ফটো দেখে হয়তো মনে হতে পারে তিনি অন্যদের কথা মন দিয়ে শুনছেন কিন্তু আমার মনে হয় না এর কোনো ধারাবাহিকতা থাকতে পারে।’

প্রিয়া সাহা যে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, সেখানে বিশ্বের ২৭ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রতিনিধিরা ছিলেন।

অধ্যাপক মেহনাজ বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিশ্বের প্রধান শক্তিধর দেশ হয়ে উঠেছে। ফলে মানুষজন এখনও সেখানে গিয়ে অভাব-অভিযোগ করেন।

এটি অনেকটা রেওয়াজ হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও সেই রেওয়াজই পালন করেছেন মাত্র। জানিয়ে অধ্যাপক মোমেন বলেন, ‘ট্রাম্পের শাসনামলে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই যেভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর হেনস্তা বাড়ছে, যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বাড়ছে, তাতে মানবাধিকার বিষয়ে আমেরিকার অবস্থানের গুরুত্ব দিন দিন কমছে।’

তবে প্রিয়া সাহার অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, তার সমালোচনা করেছেন অধ্যাপক মোমেন।

তিনি বলেন, ‘প্রিয়া সাহা যে সংখ্যা বলেছেন, তা হয়তো অতিরঞ্জিত হতে পারে, কিন্তু এটি তো সত্যি যে বাংলাদেশেও সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আন্তর্জাতিক ফোরামে যে এটি এভাবে উঠল তা লজ্জাজনক ও দুঃখজনক। এর শুভ সমাপ্তি হবে যদি এসব ঘটনা আরও কমে আসে এবং শেষ হয়।’

এমএস/

Comments