ডেঙ্গু

ডেঙ্গুতে মৃত্যু : অন্তর্নিহিত কারণ জানতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

প্রকাশিত: ৫:৫১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৮, ২০২৩

এ বছর জানুয়ারি মাস থেকেই ডেঙ্গুতে মৃত্যু হচ্ছে। আগস্টের মাঝামাঝি মৃত্যু সাড়ে চার শর কাছাকাছি পৌঁছেছে। এখনো ডেঙ্গুতে মৃত্যুর অন্তর্নিহিত প্রধান কারণগুলো জানতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মৃত্যু পর্যালোচনা (ডেথ রিভিউ) কমিটি কাজ শুরু করেছে মাত্র।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, পর্যালোচনা করলে কিছু মৃত্যু কমানো সম্ভব হয়। চিকিৎসকেরা নতুন বিষয় জানতে পারেন এবং তার ভিত্তিতে চিকিৎসা নির্দেশনায় পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু এবার মৃত্যুর বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে। অধিদপ্তর মৃত্যুও কমাতে পারছে না।

গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম ডেঙ্গুতে আরও ৯ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু হলো ৪৪৪ জনের। ডেঙ্গুতে এক বছরে এত মৃত্যু আগে কখনো হয়নি। এবার মৃতদের মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু ৮৪ জন। অন্যদিকে ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত সারা দেশের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯৪ হাজার ৩১২ জন।

এখন ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এ পর্যন্ত ঢাকা শহরের চেয়ে ঢাকার বাইরে বেশি রোগী। ঢাকার বাইরেও মৃত্যু হয়েছে ১০৮ জনের। কিন্তু এত মৃত্যুর ঘটনা জেনেও তা কমাতে সময়মতো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে জানানো হয়েছে, গত বছরও ডেঙ্গুতে মৃত্যু পর্যালোচনায় কমিটি করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত বছর ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছিলেন ২৮১ জন। এর মধ্যে ২০০টির বেশি মৃত্যুর পর্যালোচনা করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সেই পর্যালোচনার তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে এক লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে মৃত্যু ছিল তুলনামূলকভাবে কম। ওই বছর মারা গিয়েছিলেন ১৬৪ জন। তবে ওই বছর সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ডেঙ্গুতে মৃত্যু পর্যালোচনা করেছিল এবং ফলাফল জানিয়েছিল।

এ বছরের ২৩ জুলাই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর পর্যালোচনা কমিটি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ১৩ সদস্যের কমিটির প্রধান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক আহমেদুল কবির। গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। কমিটির সদস্যসচিব আবুল কালাম আজাদ শুধু বলেছেন, এ পর্যন্ত কমিটি দুটি সভা করেছে। সর্বশেষ সভাটি হয়েছে গত সোমবার।

প্রতিটি হাসপাতালে মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটি করলে কাজটি সহজ হতে পারে এবং দ্রুত ফল পাওয়া যেতে পারে। হাসপাতালে কমিটি হলে তারা মৃত্যুর কারণ তাৎক্ষণিকভাবে পর্যালোচনা করতে পারবে। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের নিজস্ব কোনো সমস্যা থাকলে তা–ও তারা চিহ্নিত করতে পারবে। অধিদপ্তরের কমিটি বিভিন্ন হাসপাতালের কাজের সমন্বয় করবে, দিকনির্দেশনা দেবে।
আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা

ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী মারা যাওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি নির্ধারিত ফরমে অন্যান্য তথ্যের পাশাপাশি মৃত্যুর কারণও উল্লেখ করে। মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়: ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (রক্তে অণুচক্রিকা কমে যায়, রক্তক্ষরণ হয়) বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (রক্তে অণুচক্রিকা কমে যায়, রক্তক্ষরণ হয়, রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়) বা এক্সপ্যানডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম (একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়)। একই সঙ্গে দুটি কারণের উল্লেখও থাকতে পারে।

এ বছর এ পর্যন্ত ৪৪৪টি মৃত্যুর মধ্যে কোন কারণে বেশি মৃত্যু হচ্ছে, এই তথ্য কারও কাছে নেই। শুধু মাসখানেক আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিন দিনের মধ্যে ৮০ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। এ ছাড়া প্রায় দেড় মাস আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেছিলেন, এ বছর রোগীদের মধ্যে শক সিনড্রোম বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে তাঁর বক্তব্যে কোনো সংখ্যাগত তথ্য ছিল না।

একাধিক বিশেষজ্ঞ ও বর্তমান মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটির তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ধরনের পর্যালোচনা থেকে রোগী ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার কত পরে হাসপাতালে এসেছেন, হাসপাতালে আসার কত সময় পর মৃত্যু হয়েছে, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিবার, না ডেঙ্গু শক সিনড্রোম, না এক্সপ্যানডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমে মারা গেছেন, ওষুধ ঠিক ছিল কি না, ব্যবস্থাপনা ঠিক ছিল কি না, রোগীর অন্য কোনো অসুখ ছিল কি না, ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে কোনটিতে রোগী আক্রান্ত ছিলেন, কোন বয়সীরা বেশি মারা যাচ্ছেন—এসব জানা যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, কয়েক বছর আগেও ‘এক্সপ্যানডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম’ বিষয়টি সম্পর্কে এ দেশের চিকিৎসকদের বিশেষ কিছু জানা ছিল না। পরে মৃত্যু পর্যালোচনা ও অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বিষয়টি জানা গেছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মৃত্যু পর্যালোচনার তথ্য থেকে দুভাবে লাভবান হওয়া যেতে পারে। যদি দেখা যায়, বিলম্বে হাসপাতালে আসা মৃত্যুর একটি কারণ, তা হলে এ ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক ও সচেতন করতে হবে। সরকার মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রচার–প্রচারণা চালাবে, যেন ঝুঁকি না নিয়ে তাঁরা দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হন। যদি চিকিৎসার কোনো সমস্যা পর্যালোচনায় উঠে আসে, তা হলে সে কথা চিকিৎসকদের যথাযথভাবে অবগত করতে হবে এবং সেই অনুসারে চিকিৎসা নির্দেশিকা হালনাগাদ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, এই দুটো কাজ করলে কিছু মৃত্যু কমে আসত। কিন্তু তারা তাতে গুরুত্ব দেয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, হাসপাতাল থেকে মৃত ব্যক্তির তথ্যসংবলিত নথি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আসতে বিলম্ব হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত ৯৫ জন মৃত ব্যক্তির কাগজপত্র স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা হয়েছে। আরও ১০০ বা এর কিছু বেশি নথি পর্যালোচনা করা হবে। কিছু কিছু নথিতে পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। নথির তথ্য পর্যালোচনার পাশাপাশি রোগীর আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলবেন পর্যালোচনাকারীরা। এতে সময় লাগবে। এসব কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে, তা জানা যাচ্ছে না।

পর্যালোচনা কমিটির সদস্য ও আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি হাসপাতালে মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটি করলে কাজটি সহজ হতে পারে এবং দ্রুত ফল পাওয়া যেতে পারে। হাসপাতালে কমিটি হলে তারা মৃত্যুর কারণ তাৎক্ষণিকভাবে পর্যালোচনা করতে পারবে। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের নিজস্ব কোনো সমস্যা থাকলে তা–ও তারা চিহ্নিত করতে পারবে। অধিদপ্তরের কমিটি বিভিন্ন হাসপাতালের কাজের সমন্বয় করবে, দিকনির্দেশনা দেবে।

বছরের শুরুর দিকে কীটতত্ত্ববিদেরা পূর্বাভাসে বলেছিলেন, এ বছর ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। এটা জানার পরও ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করার কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এখন ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এ পর্যন্ত ঢাকা শহরের চেয়ে ঢাকার বাইরে বেশি রোগী। ঢাকার বাইরেও মৃত্যু হয়েছে ১০৮ জনের। কিন্তু এত মৃত্যুর ঘটনা জেনেও তা কমাতে সময়মতো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এ ব্যাপারে চিকিৎসক নেতা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয় অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। গুরুত্ব দিলে এমন হতো না।’

প্রতিবেদন, প্রথম আলোর সৌজন্যে

Comments