বাজেট উচ্চবিত্তের, নিম্নবিত্তের নয় : সিপিডি

প্রকাশিত: ৮:৪০ অপরাহ্ণ, জুন ৮, ২০১৮

আলফাজ উমর,নিজস্ব প্রতিবেদক : ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে উচ্চবিত্ত সুবিধা পেলেও নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়বে বলে মনে করছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, ‘নবীন বাংলাদেশের জন্য একটি প্রবীণ বাজেট তৈরি করা হয়েছে।’

শুক্রবার রাজধানীর গুলশানের লেক শোর হোটেলে বাজেট পরবর্তী পর্যালোচনায় নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সিডিপি। সেখানে বেসরকারি এ গবেষণা সংস্থার সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সামগ্রিক বিবেচনায় মনে হয়েছে। যার পুঁজি ও সম্পদ আছে তার আয় বাড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু শ্রম ও উদ্যোগের মূল্য নেই। ধনী-গরিবের বৈষম্যও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আগের চেয়ে বেড়েছে।’

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেছেন, তাতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘করমুক্ত টাকা বাড়ানো হয়নি। কিন্তু যেটা বাড়ানো হয়েছে, সেটা হলো আনুতোষিক ব্যয়, যেটা ৭৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। এটা উচ্চবিত্ত মানুষেরা পাবেন। এটা আমার কাছে বৈপরীত্য মনে হয়েছে। কেননা যখন আপনি মধ্যবিত্তের জন্য কোনো সুযোগ দিচ্ছেন না, সেখানে আপনি উচ্চবিত্তের জন্য আনুতোষিক ব্যয় সুবিধা দেবেন। এটা অর্থনীতির সাম্যনীতিতে পড়ে না।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরো বলেন, ‘বৈষম্য বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ যেন পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ভাগ হয়ে গেছে। পূর্ব দিকে আছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটের মতো ধনী অঞ্চল। আর পশ্চিম দিকে আছে বরিশাল, খুলনা ও রাজশাহীর মতো দরিদ্র অঞ্চল।’

ফলে আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে এই ঘাটতি পূরণের পরিকল্পনা করেছেন মুহিত।

মুহিত আশা করছেন, এ বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে আসন্ন নতুন অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে।

বাজেটের এই লক্ষ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে দেবপ্রিয় বলেন, ‘৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য বাজেটে বিনিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা পূরণ করতে হলে ১১৭ হাজার কোটি টাকা বাড়তি লাগবে, যা ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ করতে হবে। আর তাতে করে পুঁজির উৎপাদনশীলতা কমে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘ধরা হয়েছে যে মূল্যস্ফিতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ থাকবে, আমরা অবশ্যই এটার ব্যাপারে গভীর সংশয় প্রকাশ করছি। কারণ বিশ্ব অর্থনীতির যে পরিস্থিতি এবং দেশের ভেতরে যে প্রবণতা সেটা এটাই বলছে।’

প্রবৃদ্ধির অংকের বদলে সেই প্রবৃদ্ধি মানুষের জীবন মানে কতটা পরিবর্তন আনতে পারছে- সে দিকে নজর বাড়ানোর তাগিদ দেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা বার বার বলেছি যে, বিড়াল বড় হতে পারে, বিড়াল ছোট হতে পারে কিন্তু তাকে ইঁদুর ধরতে হবে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির হার উঁচু হতে পারে, প্রবৃদ্ধির হার নিচু হতে পারে, কিন্তু প্রবৃদ্ধিতে গরীব মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন হতে হবে, তাদের বেশি পেতে হবে।’

অর্থনীতির এই গবেষক বলেন, ‘যারা সবচেয়ে গরীব, গত পাঁচ বছরে তাদের ৬০ শতাংশ আয় কমেছে। অন্যদিকে সবচেয়ে ধনী পাঁচ শতাংশ মানুষের ৫৭ দশমিক ৪ শতাংশ আয় বৃদ্ধি ঘটেছে।’

২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তিকর অপরিবর্তিত রাখার সমলোচনা করে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা আগে থেকেই বলে আসছি। বাজেটে করমুক্ত আড়াই লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে তিন লাখ করার দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু বাজেটে এর কোনো প্রতিফলন ঘটেনি, আড়াই লাখ টাকাই রাখা হয়েছে। করমুক্ত হার ৩ লাখ টাকা করলে মানুষ সাশ্রয় পায়, বেশি পরিমাণ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে।’

তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ এখনও স্থবির হয়ে রয়েছে। কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধির হার এবং গরিবের আয় বৃদ্ধির হার দুর্বল, উৎপাদনশীলতা ও মানবসম্পদের গুণগত মান দুর্বল। এ কারণ বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মূলত দুটি দিক থেকে সিপিডি এ বাজেটকে পর্যালোচনা করেছে। এগুলো হলো সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে নতুন যেসব চাপ অর্থনীতির সামনে আছে সেগুলো মোকাবিলায় বাজেটে দিকনির্দেশনা এবং সম্পদের সুষম বণ্টন ও বৈষম্য রোধ করা।

বাজেট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বেশ কিছু ভালো-মন্দ দিক চিহ্নিত করেছে সিপিডি। স্বল্পমেয়াদি ভালো দিকের মধ্যে রয়েছে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা, সরকারি বিনিয়োগের অব্যাহত বৃদ্ধি, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক নিরাপত্তাবলয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি। স্বল্পমেয়াদি সমস্যার মধ্যে আছে রাজস্ব আদায় বাড়াতে দুর্বলতা, এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি, কৃষকের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।

সিপিডি বলছে, এবারের বাজেটের ভালো দিক হলো ধনীদের সম্পদের ওপর সারচার্জ বাড়ানো, স্থানীয় শিল্পের প্রসারে নীতিসহায়তা, প্রতিবন্ধীবান্ধব হাসপাতালের সুবিধা, গরিবের রুটি-বিস্কুট ও পাদুকার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) তুলে নেওয়া ইত্যাদি। সিপিডি মনে করছে, ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো উচিত, ব্যাংকের করপোরেট কর কমানোর সুফল সুদের হার ও তারল্য সংকটের ওপর প্রভাব ফেলবে না। উবার, পাঠাওয়ের মতো রাইড সেবা ও ই-কমার্স ব্যবসার ওপর ভ্যাট আরোপের ফলে তরুণদের উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে তা শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যয় বাড়াবে।

তিনি করপোরেট ট্যাক্স কমানোর বিরোধিতা করে বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ব্যাংক, বীমা কোম্পানি এবং ব্যাংক বহির্ভূত বাণিজ্যিক যেসব অর্থায়নের প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের আড়াই শতাংশ হারে যে করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়েছে, আমরা এটার বিরোধিতা করি। আমরা মনে করি— ব্যাংক খাতে যে ধরনের নৈরাজ্য চলছে, সেই নৈরাজ্যের কোনো সমাধান না করে মালিক পক্ষকে এই ধরনের সুবিধা দেওয়া।

তামাকজাত পণ্য রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক তুলে দেওয়ার সমালোচনা করেছে সিপিডি। তারা মনে করছে, এটা করা হলে দেশে তামাক উৎপাদন বাড়বে, যা সরকারের তামাক উৎপাদন বন্ধ করা নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ব্র্যান্ডের পোশাক ও আসবাবের ওপর এবং আমদানিতে উৎসে ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে মানুষের ব্যয় বাড়বে। তবে এ সিদ্ধান্ত অর্থমন্ত্রী ভ্যাটের হার সমন্বয়ের জন্য নিয়েছেন বলে সিপিডি মনে করে।

সংবাদ সম্মেলনে এসব পর্যালোচনা তুলে ধরেন সংস্থাটির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। উপস্থিত ছিলেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।

#এএইচ

Comments