কারাগার থেকে জবি ছাত্রের খোলা চিঠি

প্রকাশিত: ৯:৫০ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৯

বিশেষ প্রতিবেদক: ‘আমি চিন্তা করেছি এখান থেকে বের হয়ে বাড়ি ফিরে যাব মায়ের কাছে। আর তারপর আম্মু,আমি আর আমার প্রতিবন্ধী ছোট বোন এই ৩ জন মিলে সুইসাইড করবো’।

মিথ্যে মামলায় জেল খাটছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এহসান হাবীব সুমন (ফিন্যান্স বিভাগ-১১ তম আবর্তন)। একজন নিরপরাধ এবং পুরোপুরি নির্দোষ এই কৃতি ছাত্রের তিন কূলে কেউ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে অনেক বার বলা সত্ত্বেও তারা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে সে কারাগার থেকে চিঠি লিখেছে এবং সেটা জানাতে অনুরোধ করেছে সবাইকে।

কারাগার থেকে পাঠানো মিথ্যে মামলায় ফেসে যাওয়া একজন নিরপরাধ জবি ছাত্রের খোলা চিঠি হুবহু তুলে ধরা হলো:

আমি এহসান হাবিব সুমন । জগন্নাথের ১১ তম আবর্তন ফিন্যান্স বিভাবে পড়ি। একজন নির্দোষ মানুষের জীবনে এরকম একটা ঝড় আসতে পারে এটা এখনও পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছি না। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে মানুষের জীবন কতখানি বদলে যেতে পারে তার বড় স্বাক্ষী এখন আমি নিজেই। যে বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ভবিষ্যত নিয়ে এত স্বপ্ন দেখিয়েছে আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয় আমার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে।

প্রথমেই বলে রাখি আমি কখনো কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলামনা। বাবা মারা যাওয়ার পর নিজের পরিবারটাকে চালাতেই আমার যায় যায় দিন অবস্থা। অথচ গত ১৯-০২-২০১৯ তারিখে আমি সন্ধ্যাবেলায় (আনুমানিক ৭:৩০-৮:৩০ এর মধ্যে) ক্যাম্পাসের সামনে থেকে রাজনৈতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। এখন কারাগারে বসে কাগজে কলমে সেদিনের ঘটনাটা একটু বর্ণনা করতে চাই।

আমার একটি বাইক আছে। আমার বাসার নিচে কোনো গ্যারেজ না থাকার কারণে বিগত ৪ মাস ধরে আমি আমার বাইক ক্যাম্পাসের বিবিএ ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে রেখে আসছি। গত ১৯ তারিখেও রাতে ৭:৩০ এর দিকে আমি বাইক রাখতে ক্যাম্পাসে গিয়েছি। ২-৩ মিনিটের মধ্যে বাইকটা রেখে লক করে হেলমেটটা হাতে নিয়ে বাইরে চলে আসি। আন্ডারগ্রাউন্ডের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ তার প্রমাণ। বের হয়ে গেটে আসতেই দেখি আমার রুমমেট জিএম শোভন শিশির ক্যাম্পাসের গেটে একটি বেঞ্চে বসা। আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম, ‘বন্ধু বাসায় যাবি না?’ ও বললো, হ্যাঁ, চল একটা চা খেয়ে যাই। ভার্সিটি গেটের সিসিটিভি ফুটেজ দেখলে এটারও প্রমাণ মিলবে।

এর মধ্যে খুব সম্ভবত আমাদের সহকারি প্রক্টর স্যার ক্যাম্পাস থেকে বের হচ্ছিলেন। উনি আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন ‘আপনার কারা? এখানে কি করছেন? জবাব দেবার আগেই ২০-৩০ জন পুলিশ হঠাৎ করে গেটের সামনে চলে আসে। পুলিশের এক কর্মকর্তা আমাদের ধরে নেবার আদেশ দেন। মাত্র ২-৩ মিনিটেই সবকিছু ছুরির মত কেটে গেলো। কিছুই বুঝতে পারলাম না কী হচ্ছে। কেন তুলে নিচ্ছেন জিজ্ঞাসা করলে কোনো জবাবও পেলাম না। থানায় নিয়ে হাজতে ঢোকানোর পর জানতে পারলাম গত ১৮ তারিখের মারামারিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের কমিটি বাতিল করে দিয়েছে।

আবার কেউ কেউ বলতে লাগলো আমরা বিজয় মিছিল করেছি, পোস্টার ছিঁড়েছি কমিটি বাতিল হবার পর, তাই আমাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এই সমস্ত ঘটনা শুনে আমি প্রচন্ড অবাক হলাম,যেহেতু আমি জীবনে কখনো পলিটিক্সও করিনি তাই কখনো পলিটিকাল খোঁজখবর নিয়ে মাথাও ঘামাইনি।আমি সবাইকে বললাম, ভাই আমি তো এসবের কিছুই জানি না। আমি তো কোনোদিন পলিটিক্সও করিনি, আপনার ভুল করে আমাকে ধরেছেন, আমাকে ছেড়ে দিন। পুলিশ আশ্বাস দিলো আপনি নির্দোষ হলে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, কোনো অসুবিধা নেই। রাতে ওসি মওদুদ ভাইয়ের রুমে ডেকে নিয়ে উনি নাম, ঠিকানা সবকিছু জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম। উনি জিজ্ঞাসা করলেন ক্যাম্পাসে কেন এসেছিলাম? আমি হেসে হেসেই জবাব দিলাম ‘বাইক রাখতে এসেছিলাম’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই আজ কি আমার এখানে থাকা লাগবে?’ উনি বললেন ‘বলা যাচ্ছে না’। তোমাদের ভেরিফাই করা হবে। তারপর একটু সময় তো লাগবেই। যেহেতু নির্দোষ ছিলাম সেহেতু ভেরিফাই এর কথা শুনে সাহস পেলাম, কারণ আবারও বলছি আমার কোনোদিনও কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। আর এসব ঘটনার কিছুই আমি জানি না।

জড়িত থাকার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। ক্যাম্পাসের গেট থেকে আমি সহ মোট ৫ জন গ্রেফতার হয়েছিলাম। রাতে আরো ২ আসলো। মোট ৭ জন। ভার্সিটি গেট থেকে ধরে আনা ২ জন বাদে বাকি ৩ জন এবং রাতে ধরে আনা ২ জনকে কেস দিয়ে কোর্টে চালান দেওয়া হলো দুপুর ১ টার দিকে। আমি বললাম,ভাই একটু তাড়াতাড়ি করেন। কাল রাত থেকে এখানে আটকে রাখা হয়েছে অথচ আমি সম্পুর্ণ নির্দোষ। ১ টার দিকে যখন একজন পুলিশ এসে আমি সহ আরো ৫ জনের নাম ধরে ডেকে বললো যে আপনাদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। আপনাদের কোর্টে চালান দেওয়া হবে এক্ষুণি…শুনেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।ঐ সময় একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম, একজন দোষী সবসময় বলে সে নির্দোষ কিন্তু একজন নির্দোষের আসলে কিছুই বলার থাকে না।

যতদূর জানি আমাদের প্রক্টর স্যারকে তো জানানোর কথা মামলা দেবার আগে। উনি তো একজন নিরপরাধ স্টুডেন্টের লাইফ ধ্বংস করে দিতে পারেন না। আমি রাজনকে বললাম প্রক্টর স্যারকে ফোন দিতে। স্যার ফোন ধরলেন না। রাজন প্রক্টর স্যারকে ফোন দিচ্ছে আর অন্যদিকে আমি চিল্লাচ্ছি এই বলে যে আমি তো কিছু করিনি, আমাকে কেন মামলা দিবে? আমাদের ৫ জনকে হাতকড়া পরানো হলো। জীবনের সব স্বপ্ন মনে হলো এক মুহূর্তেই কেউ ভীষণ জোরে আছাড় মেরে ভেঙে দিলো।

গাড়িতে উঠিয়ে ভার্সিটির সামনে দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে আমাদের কোর্টে নিয়ে যাচ্ছে এমন সময় শিশির পুলিশের কাছে মামলার কাগজ দেখতে চাইলো, আমিও দেখলাম। দেখে আমি এতটাই অবাক হলাম যেন বোবা থাকা অবস্থায় আরো বোবা হয়ে গেলাম। মামলায় লেখা ১৮ ফেব্রুয়ারি মারামারিকে কেন্দ্র করে মামলা দিয়েছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি আমি গিয়েছিলাম মিরপুর BRTA তে, আমার বাইকের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার আনতে। ঐদিন শামীম আহম্মেদ সুমন ভাইও আমার সাথে সন্ধ্যা পর্যন্ত BRTA তে ছিলেন। বাইকের রেজিস্ট্রেশন পেপার ও নাম্বার পাবার পরপরই গ্লোবাল ইন্সুরেন্স থেকে বাইকের ইন্সুরেন্স করাই। এই সমস্ত পেপার তখনও আমার পকেটে ছিলো এবং দুই এবং দুইটি পেপারেই ১৮ তারিখের কথা উল্লেখ আছে।

যাই হোক, বাকি ঘটনা আর বলতে চাই না। অবাক হতে হতে আর কাঁদতে কাঁদতে আমি ক্লান্ত। একজন নিরপরাধ এবং নিরীহ মানুষ হয়েও আমি জেলে বসে আছি। জেলখানায় এসে মায়ের কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। প্রথম ২ দিন মা মা করে অনেক কেঁদেছি। এখন একটু শক্ত হয়েছি। আমি জানি আমার মা এখনো কাঁদছে। এখন রাত ৩:১৫ বাজে,আমার মা ঘুমোতে পারেনি, মায়ের সাথে সন্তানের টেলিপ্যাথির জোরটা অনেক বেশি। মা,তুমি প্লিজ কান্নাকাটি করো না। আমি ভালো আছি মা। অনেক ভালোবাসি মা তোমায়।

এখানে এসে একটা কথা বুঝেছি। জেলের ভেতরে মানুষ জেল খাঁটে না, জেল খাঁটে বাইরের মানুষ। ছোটবেলায় কাজী মারুফ অভিনীত ‘ইতিহাস’ ছবিটি দেখেছিলাম। জেলে এসে প্রতিটা মুহূর্ত ছবিটার কথা মনে পড়ে। আমি চিন্তা করেছি এখান থেকে বের হয়ে বাড়ি ফিরে যাব মায়ের কাছে। তারপর আম্মু,আমি আর আমার প্রতিবন্ধী ছোট বোন এই ৩ জন মিলে সুইসাইড করবো।

অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম, মা কে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম। তার কোনোটাই এখন আর অবশিষ্ট নাই। স্বপ্ন না থাকলে,আশা না থাকলে ভাবলেশহীন জীবন কাটায়। আর স্বপ্ন ভেঙে গেলে মানুষ সুইসাইড করে। এটা যে আমার সুইসাইড নোট এমন কিছুও না। হয়তো বেঁচেই থাকবো। আত্মহত্যা করার মত অতটা সাহসও হয়তো আমার হবে না।

আমার এই কথাগুলো সংশ্লিষ্ট মহলে পৌছাবে কিনা জানিনা। কেউ কোনোদিন জানবে কিনা তাও জানিনা, তবুও বলে যেতে চাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানিত প্রক্টর স্যার, মাননীয় ভিসি স্যার আমাদের অভিভাবক। আমরা তাদের সন্তান। আপনাদের এমন এক সন্তান আজ জেলে আটকা আছে যে কিনা কিছু জানতো পর্যন্ত না।

আপনাদের এমন এক নিরপরাধ সন্তান জেলে আছে যে কিনা কোনোদিন রাজনীতটাও করেনি। সংসার আর নিজের জীবনের ঘানি টানতে টানতে সময় পার করেছি জীবনটা।

হ্যাঁ, মানছি আপনার কিছু সন্তান অপরাধ করেছে, কিন্তু তার জন্য একটা নিরপরাধ নিরীহ মানুষ ফেঁসে গেলো। যার অপরাধ শুধু একটাই ক্যাম্পাসে বাইক রাখতে এসেছিলো। আসল অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে অথচ পরিস্থিতি শান্ত করার নামে এমন একটা মানুষের বলিদান দিলেন যার কিনা দুইকূলে কেউ নেই।

আপনাদের কাছে একটা অনুরোধ রইলো স্যার, ভবিষ্যৎে আপনার কোনো নিরপরাধ সন্তানের জীবনটা যেন এভাবে নষ্ট না হয়ে যায়। মামলা দেবার আগে একটাবার হলেও একটু দেখে নিবেন বৃহত্তর স্বার্থে কোনো নিরীহ ছাত্র যেন কখনো বলির পাঠা না হয়ে যায়।
_________
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার(কেরাণিগঞ্জ) থেকে
এহসান হাবিব সুমন
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
১১ তম ব্যাচ
ফিন্যান্স বিভাগ।
গ্রামঃ নওয়াগ্রাম
থানাঃ কালিয়া
জেলাঃ নড়াইল

Comments