যে দিন ‘পুরুষ’ ধর্ষণ করা বন্ধ করবে, সে দিনই বন্ধ হবে ধর্ষণ

প্রকাশিত: ৭:৪৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৯, ২০১৯

সুলতাম মাহমুদ আরিফ

আমাদের রাষ্ট্রে নিরন্তর ধর্ষণ হয়েই চলছে, আর নিরন্তর মেয়েদের ওপরেই দোষারোপ চলছে– এটি কোনো সভ্য সমাজের রীতি হতে পারে না। কিন্তু মর্মান্তিক সত্য এটাই যে, এ দেশের বহু নাগরিক, মুখে উচ্চারণ না করলেও, মনে মনে এই মতই পোষণ করেন যে, মেয়েরা নিজেদের দোষেই লাঞ্ছিত হয়ে থাকে। উচ্চারণ করলে তবেই ব্যাধি ধরা পড়ে। এই ব্যাধি কিন্তু সুগভীর, পরিব্যাপ্ত, ‘প্রজন্ম হইতে প্রজন্মে বাহিত’।

কেন এমন ঘটে? কেন বহু পুরুষ এবং সম্ভবত বহু নারীও মেয়েদের লাঞ্ছনার জন্য মেয়েদেরই দায়ী করেন? কেন পুরুষতন্ত্র এমন ধারণা লালন করে? সম্ভবত তার একটি কারণ, পুরুষতন্ত্রের তান্ত্রিকদের নিজেদের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনকি নিজেকে সংযত রাখতে পারবে, এমন ভরসাটুকুও নেই। অতএব পুরুষতন্ত্র ধর্ষণের দায় চাপিয়ে দেয় মেয়েদের উপর। এভাবে সে নিজের কৃতকর্মের পাপ মোছনের চেষ্টা করে থাকে।

কথায় কথায় সামাজিক স্থিতি ও পবিত্রতার অজুহাত খাড়া করে মেয়েদের দায়ী করতে তৎপর হয়, সেই দোষারোপে তার সহায় হয় দীর্ঘকালের লালিত সামাজিক ধারণা, যে ধারণা বহুলাংশে পুরুষতন্ত্রেরই সন্তান। দায় অন্যের ঘাড়ে না চাপাতে পারলে সেই কাজের দায়িত্ব নিতে হবে এবং সর্বোপরি নিজের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। যে জবাবদিহি হয়তো পুরুষতন্ত্রের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে।

কারণ, পুরুষতন্ত্র ক্ষমতার তন্ত্র। আর ক্ষমতা নিজেকে প্রশ্ন করতে চায় না। নিজের কাছে জবাবদিহি করতে তো নয়ই। স্বাভাবিক। প্রশ্ন করলে সব কাজের কারণ দর্শাতে হয় এবং ফলের দায়িত্ব নিতে হয়। এ দুটিই অতি বিষম কাজ। অতএব পুরুষতন্ত্র আপন অন্যায়ের দায় ক্রমাগত মেয়েদের উপর চাপিয়ে দিতে প্রবৃত্ত হয়।

এই রীতি কেবল পুরুষের বা পুরুষতন্ত্রের নয়। এটা সামগ্রিকভাবেই ক্ষমতার স্বভাব। যেখানেই ক্ষমতা, সেখানেই এটা দেখা যায়। উচ্চপদস্থ কর্মচারী অধস্তন কর্মচারীর ওপর অন্যায় জুলুম করে থাকেন, চাকরিরত বড় ভাই বেকার ভাইয়ের ওপর অন্যায় রাগ দেখিয়ে থাকেন।

ঘরে বা বাইরে, ক্ষমতা কোনো অবস্থাতেই নিজের দায় স্বীকার করতে চায় না। আবার সেই কারণেই ক্রমাগত ক্ষমতাতন্ত্রকে কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলা দরকার। ‘ক্ষমতাকে সত্য বলার’ গুরুত্ব এখানেই। মেয়েদের লাঞ্ছনার জন্য মেয়েদেরই দায়ী করার যে কোনো চেষ্টাই তাই প্রবল প্রতিবাদের যোগ্য।

‘সামান্য একটু-আধটু অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ’ আমাদের দেশে আমলে নেওয়া হয় না। এই ‘সামান্য স্পর্শ’ একসময় তার নিজস্ব মাত্রা হারায়। এটা জবরদস্তি বা ধর্ষণ পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু পুরুষরা যখন নারীদের শরীরে অন্যায় ও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে স্পর্শ করে, সেটা কেউ আমলে নেয় না। অভিভাবকদের জানালে বলেন, ‘ওতে কী হয়েছে’? সোনাগাজাীর সেই ওসি নুসরাতের ব্যাপারেও ঠিক তাই বলেছেন।

এদিকে ধীরে ধীরে এই মাত্রা ছাড়িয়ে ঘর থেকে বাইরে, গ্রাম থেকে শহরে, লোক থেকে লোকান্তরে ছড়িয়ে পড়ে!

এটা হচ্ছে ঘরের ভেতরে ‘আপন’ মানুষ দ্বারা নির্যাতনের চিত্র। ঘরের বাইরে ‘পর’ মানুষ দ্বারা নির্যাতনের চিত্র এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। কী ঘরে কী বাইরে, নারীর অবস্থান যখন এরকম তখন একজন-দুজন ধর্ষকের বিচার চেয়ে খুব কী লাভ হবে? আজ নারীরা আদর্শের বাতিঘর মাদরাসাতেও পুরুষ শিক্ষকদের হাতে নিয়মিত ধর্ষণ হচ্ছে নারী সমাজ। নিজ চোখে এরকম অসংখ্য নজির আমি দেখেছি।

আমরা আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে নারীদের জন্য মোটেও সহায়ক হিসেবে তৈরি করতে পারিনি। এখানে একটি মেয়ে একবার ধর্ষণের শিকার হলে তাকে প্রতিনিয়ত বৈরিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সহানুভূতি, সহমর্মিতার পরিবর্তে সবখানে সন্দেহ, ভ্রূকুটি নিয়ে এগোতে হয়। ধর্ষণের পর পুরুষ চিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করানো, পুরুষ ইনস্পেক্টর দিয়ে তদন্ত বা ট্রাইব্যুনালে পুরুষ আইনজীবী দিয়ে মামলা সহায়তা– এগুলো মোটেও নারী-সহায়ক নয়।

এমনকি কোনো কোনো গণমাধ্যম পর্যন্ত ধর্ষককে অনুসরণ না করে মেয়েটিকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে। ধর্ষণের শিকার মেয়েটি বার বার ধর্ষিত হয় ঘরে–বাইরে–চিকিৎসালয়ে–আদালতে!

ফেনীর সোনাগাজীর ঘটনাটি আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। এসবই ইতিবাচক আলামত। সমাজে নারীর প্রতি সংবেদনশীলতার বহিঃপ্রকাশ। এসব প্রতিক্রিয়া–প্রতিবাদের দরকার আছে।

কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, দু-চারজন সিরাজ্দউদ্দৌলার শাস্তি দিলেই কিন্তু সমস্যা মিটবে না। যেখানে গোটা সমাজ ‘সাদনান-সাফাত-নাঈমে’ পরিপূর্ণ, সেখানে একটি-দুটি তনু-মিতুর জন্য আহাজারি করে সমাজে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না।

সমাজে ক্রমবর্ধমান এসব ধর্ষকদের কীভাবে মানুষ করা যায় কিংবা নির্মূল করা যায়, সেটা ভাবা অধিক জরুরি। এক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হবে পুরুষদেরই। কারণ নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের অভিযোগের আঙুলটা তাদের দিকেই তাক করা! কিন্তু পুরুষরা কি সেই দায়িত্ব নেবে? ধর্ষক পুরুষদের জব্দ করতে একযোগে এগিয়ে আসবে? কিংবা ‘মায়ের কসম’ খেয়ে (মুখে তো দেখি সব পুরুষই চরম মাতৃভক্ত!) কোনো শপথ উচ্চারণ করবে?

মনে হয় না! অনেককেই তো দেখি কেবল মজা লুটতে চায়; প্রকাশ্যে, গোপনে, সরাসরি কিংবা পরোক্ষে!

তসলিমা নাসরিন তো মিথ্যে বলেননি:

‘ধর্ষণ আর যা কিছুই হোক, যৌনসঙ্গম নয়। ধর্ষণ কেউ যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্য করে না। প্রায় সব ধর্ষকেরই স্থায়ী যৌনসঙ্গী আছে। ধর্ষণ নিতান্তই পেশির জোর, পুরুষের জোর, আর পুরুষাঙ্গের জোর’। মোদ্দা কথা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পরম পূজনীয় পুরুষাঙ্গের ন্যাড়া মাথায় মুকুট পরানো বা বিজয় নিশান ওড়ানোর আর এক নাম ধর্ষণ।

‘ধর্ষণ বন্ধ হবে কবে, অথবা কী করলে ধর্ষণ বন্ধ হবে’? এই প্রশ্নের সবচেয়ে ভালো উত্তর: ‘যে দিন পুরুষ ধর্ষণ করা বন্ধ করবে, সে দিনই বন্ধ হবে ধর্ষণ’।

‘কবে, কখন বন্ধ করবে, সে সম্পূর্ণই পুরুষের ব্যাপার। সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিক যে এই দিন থেকে বা এই সপ্তাহ থেকে বা এই মাস থেকে বা এই বছর থেকে নিজের প্রজাতির ওপর ভয়াবহ বীভৎস এইসব নির্যাতন তারা আর করবে না। তবেই বন্ধ হবে ধর্ষণ’।

আমার এই আলোকপাতে গণহারে সব পুরুষ অভিযুক্ত না। আসুন আমরা পুরুষরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি আজ থেকে ধার্ষনিক চিন্তার উদ্রেক বাদ দিয়ে নিজেরা সু-পুরুষ হওয়ার মাধ্যমে পশুত্ব স্বভাব দুরিভূত করি। তাহলেই নুসরাত আর তনুরা পাবে আমাদের মাঝে নিরাপদ আস্রয়স্থল।

লেখক: শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী

Comments