প্রসঙ্গ এরশাদ; জাতীয় পার্টি দ্যা জাতীয় রহস্য

প্রকাশিত: ২:৫৯ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৬, ২০১৮

শাহনূর শাহীন
কবি, সাংবাদিকও কলামিস্ট

জাতীয় নির্বাচন এলেই জাতীয় পার্টি নিয়ে কেমন যেন মধুর রহস্য জন্ম নেয়। এর কারণ দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।

প্রতিবারই নির্বাচনের আগে কোন জোটে যাবেন কিংবা একভাবে নির্বাচনে যাবেন কিনা এ নিয়ে স্ববিরোধী বক্তব্য দেন এরশাদ।

২০০৮ সালে দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপিকে ছেড়ে আওয়ামী লীগের সাথে জোট করে নির্বাচনে অংশ নেয় এরশাদের জাতীয় পার্টি। কিন্তু ১৪ সালের নির্বাচনে বেকে বসেন এরশাদ।

অন্যান্য সব দলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একতরফা নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয় এরশাদ। তখনই শুরু হয় রহস্যের পর রহস্য।

মূলত রহস্যের শুরুটা আরো আগে থেকেই। নির্বাচনের পূর্ব মুহুর্তে ১৩’ সালের শেষের দিকে নির্বাচনী জোটে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে রহস্য তৈরি হয়।

কখনো গুঞ্জণ হয় এরশাদ ফের বিএনপির সাথে জোট বাঁধবে। পরক্ষণেই খবর আসে আওয়ামী লীগের সাথে থেকেই নির্বাচনে যাবে এরশাদ।

বিভিন্ন সময় এরশাদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য নানান রহস্যের জন্ম দেয়। কখনো বলেন, আওয়ামী লীগের সাথেই আছি পরক্ষণেই বলেন, বিএনপিতে।

একটু পরেই আবার বলেন, এককভাবে নির্বাচনে যাবে জাতীয় পার্টি। এভাবেই নির্বাচন পূর্ব সময়টাতে রহস্যের জন্ম দিয়েছে জাতীয় পার্টি এবং এরশাদ।

নির্বাচন যখন কাছাকাছি চলে এলো দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপির দাবির সাথে একমত তখন দেশের প্রায় অধিকাংশ রাজনৈতিক দল।

দলীয় সরকারের অধিনে নির্বাচনে যেতে অস্বীকার করে সরকারের অংশীদার ছাড়া সব দল। এরশাদের জাতীয় পার্টি সরকারের অংশ হওয়া সত্ত্বেও নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে একমত পোষণ করে।

সম্পর্কের নানান টানাপোড়েন শেষে আওয়ামী লীগের সাথে থেকে নির্বাচনে যাওয়ার কথা জানান এরশাদ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি সহ অন্যরা নির্বাচন বর্জন করলে ৩ ডিসেম্বর এরশাদও নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়।

এরশাদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় বিপাকে পড়ে যায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একেবারে বিরোধী দল বিহীন নির্বাচন আয়োজন বহির্বিশ্বে নিজেদের ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কায় পড়ে আওয়ামী লীগ।

খালি মাঠে গোল দেওয়াটা নিজেদের কাছেও লজ্জজনক মনে হয় আওয়মী লীগের কাছে। চেষ্টা করতে থাকে যে কোনোভাবে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনার।

ঠিক তখনই শুরু হয় নতুন রহস্য। পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও গুঞ্জণ ওঠে এরশাদ পত্নী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে পার্টির একাংশ নির্বাচনে যাবে।

এরইমধ্যে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে খবর বেরোয় এরশাদকে আটক করেছে র্যাব। আটকের খবর অস্বীকার করে র্যাব জানায় এরশাদকে চিকিৎসার জন্য সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।

দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা তখন এরশাদের অসুস্থতার কথা অস্বীকার করে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে থাকলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে গলফ খেলার ছবি প্রকাশ হয়ে রহস্য আরো ঘনিভুত করে।

শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেয়। হাসপাতালে থেকেও অনেকটা অনিচ্ছাকৃতভাবে ১৪’ সালের সাথে নির্বাচনে অংশ নিতে হয় এরশাদকেও।

এরশাদের নিষ্কৃয়তায় জাতীয় পার্টির প্রকাশ্য নেতৃত্বে চলে আসে রওশন এরশাদ। নির্বাচন শেষে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

মন্ত্রীসভায় অংশ নেয় রওশন পন্থী পার্টির নেতারাও। এ নিয়ে দলীয় বিভেদ বিশেষ করে এরশাদ ও রওশন এরশাদের মধ্যকার দ্বন্ধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত বিরোধী দল হয়েও মন্ত্রীসভায় অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। এরশাদকে করেন প্রধানমন্ত্রী তার বিশেষ দূত।

এরপর নানান সময় মন্ত্রীসভা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা শোনা যায়। পরবর্তী তথা এই নির্বাচনে একভাবে অংশ নেয়ার কথা জানান এরশাদ বিভিন্ন সময়ে। তবে শেষ দিকে এসে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার শর্ত জুড়ে দেন এরশাদ।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে নানান নাটকীয়তায় ভঙ্গুর বিএনপি যখন ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে কোমর সোজা করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয় তখন এরশাদকে নিয়েও কানাঘুষা শুরু হয়।

১৮’ সালের এই নির্বাচনে এরশাদ ঐক্যফ্রন্টে যাবেন কিনা কিংবা ঐক্যফ্রন্টে না গেলেও মহাজোটে থাকবেন নাকি আলাদা হয়ে যাবেন এ নিয়ে টেনশনে পড়ে খোদ আওয়ামী লীগ।

তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই আসন ভাগাভাগি নিয়ে দেন-দরবার চলতে থাকে। ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর এবারও আকস্মিকভাবে ১৭ নভেম্বর খবর আসে চিকিৎসার জন্য সামরিক হাসপাতালে গেছেন এরশাদ।

এ নিয়ে গুঞ্জণ শুরু হলে ওইদিন বিবিসি বাংলার সাথে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদের জানান, নিয়মিত রুটিন চেকআপের জন্য এরশাদ হাসপাতালে গেছেন। দু’একদিনের মধ্যেই বাসায় ফিরবেন।

বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে এটি গায়েবি অসুস্থতা কিনা প্রশ্ন করা হলে জিএম কাদের বলেন, না অসুস্থ না। উনি একটু গেছেন, দু’একদিন থাকার পর আবার আসবেন।

আপনি যদি দু’একদিন পর আমার সঙ্গে কথা বলেন, এটা লাউড এন্ড ক্লিয়ার হবে। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদকের সঙ্গে এভাবেই বলেন জিএম কাদের।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এরশাদ এখনো হাসপাতালেই ঘুরপাক খাচ্ছেন। কখনো বাসায় ফিরলেও থাকছেন আড়ালে।

হাসপাতাল টু বাসা। বাসা টু হাসপাতাল। কথা বলছেন না কোনো গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে। বলা হচ্ছে সিঙ্গাপুরেও যেতে পারেন।

এদিকে এরশাদের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সাথে আসন ভাগাভাগিতে নেতৃত্ব দেন মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার।

এই নিয়ে দলীয় নেতাদের সাথে তৈরি হয় নতুন আরেক দ্বন্ধ। এরইমধ্যে ৩ ডিসেম্বর মনোনয়ন বানিজ্যের অভিযোগে রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে মহাসচিব করা হয় দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মশিউর রহমান রাঙ্গাকে।

মশিউর রহমান রাঙ্গা ছিলেন রওশন পন্থী। বর্তমান সরকারের মন্ত্রীসভায়ও ছিলেন জাতীয় পার্টির এ নেতা। যেখানে আপত্তি ছিলো দলীয় প্রধান এরশাদ ও সদ্য সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার।

অনুমিতভাবেই প্রশ্ন ওঠে জাতীয় পার্টিতে আসলে হচ্ছেটা কী? দল চালাচ্ছে কে? এরশাদ নাকি অন্য কেউ। পর্দার আড়ালে ভিন্ন কিছু হচ্ছে না তো!

যদিও বলা হচ্ছে এরশাদ নিজেই জিএম কাদেরকে সরিয়ে রাঙ্গাক বসিয়েছেন আদৌ এরশাদের এই নির্দেশ কী স্বতস্ফুর্ততার সাথে ছিলো নাকি চাপ ছিলো সেটাই এখন প্রশ্ন।

এদিকে মহাসচিব হয়ে রাঙ্গা বলছেন অসুস্থ হলে এরশাদ বাসায় থাকতে ভয় পান। সেজন্যই তিনি মাঝে মাঝে অসুস্থ হলে হাসপাতালে থাকেন।

অন্যদিকে শুরুতে রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে দেয়ার কথা জানা গেলেও বুধবার রাঙ্গা দাবি করেন, রুহুল আমিন হাওলাদার নিজেই ‘শারীরিক অসুস্থতা’ এবং দল পরিচালনায় ‘অক্ষমতার’ কথা জানিয়ে জাপা চেয়ারম্যানের হাতে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।

সব মিলিয়ে দলটির সাম্প্রতিক কার্যক্রম বেশ রহস্যের জন্ম দিচ্ছে। বিশেষ করে এরশাদের অনুপস্থিতি এবং কাদেরকে সরিয়ে সরকার পন্থী হিসেবে পরিচিত অংশের নেতার হাতে দলের নেতৃত্ব নিয়ে তৃণমূল জাতীয় পার্টি এবং জনমনে নানান প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

রওশন এরশাদ দলের একটা অংশ নিয়ে প্রকাশ্যে সরকারের অংশীদার হলেও এক পাশ থেকে দলীয় প্রধান এরশাদ ও মহাসচিব হাওলাদার সবসময় ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে গেছেন।

নির্বাচনের পূর্ব মুহুর্তে এটাই মহাজেটাকে নতুন কোনো ভাবনায় ফেলে দিলো কিনা সেদিকেই এখন সন্দেহের তীর। সেজন্যই প্রশ্ন ওঠছে পেছন থেকে আসলে জাতীয় পার্টির কলকাঠি নাড়ছেন কে?।

এসব প্রশ্ন ওঠার কারণও নিশ্চয়ই আছে। সম্প্রতি দলের এক অনুষ্ঠানে কর্মীদের উদ্দেশ্যে এরশাদ বলেছিলেন, কোন জোটে যেতে হবে আমার ওপর ছেড়ে দাও।

এরশাদ বলেন, মনে রেখো আমার নামে এখনো মামলা আছে। একটা দিনের জন্যও আমি মুক্ত ছিলাম না, এখনো নেই। একটা দিনের জন্যও সুখে ও শান্তিত ছিলাম না।

এখনো মামলা ঝুলছে আমার, একটাও নিষ্পত্তি হয়নি। আমার মতো দুঃখী রাজনীতিবিদ আর কেউ নেই। আমার চেয়ে কেউ কষ্টে করেনি, অসহ্য কষ্ট সহ্য করেছি।

যাই হোক, এইসব প্রশ্নের উত্তর আপাতত রহস্য হয়েই থাক। কেননা জাতীয় পার্টি মানেই জাতীয় রহস্য। আপতত এটা হোক রহস্যময় বিনোদনের নতুন কোনো উপাদান।

/আরএ

Comments