শাসনতান্ত্রিক সীমা লঙ্ঘন প্রতিরোধ করা বিচার বিভাগের দায়িত্ব

প্রকাশিত: ১:১৭ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২, ২০২৩

এম এম খালেকুজ্জামান, আইনজীবি

একজন প্রধান বিচারপতি জুডিশিয়াল স্টেটসম্যানশিপ দিয়ে শুধু যে টালমাটাল পরিস্থিতিতেই দেশকে গন্তব্যে নিয়ে যান, এমন নয়। মনে রাখা দরকার, তেমন অস্থির পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়, তা নিশ্চিত করতে ‘অনুঘটক’–এর ভূমিকা রাখাও তাঁর কাজ। আর এই কাজে প্রধান পুরোহিত হচ্ছেন প্রধান বিচারপতি।

প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতা যেন বাংলাদেশের ভবিতব্য। এর আগেও নির্বাচনপূর্ব সংকটে বিচার বিভাগকে কখনো নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, কখনো ত্রাতার ভূমিকা নিতে হয়েছে।

কালপরিক্রমায় আরও একটি নির্বাচন সামনে এবং এই সময়ে প্রধান বিচারপতি কে হচ্ছেন, তার আগ্রহ ছিল, কিন্তু অনুমিত সম্ভাব্যতার ব্যত্যয় না ঘটিয়ে জ্যেষ্ঠতা বিবেচনায় নিয়েই এবার নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে। দেশের ২৪ তম প্রধান বিচারপতি হিসেব শপথ নিয়েছেন ওবায়দুল হাসান।

একজন বিচারপতির দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিত্ব গড়ে দেয়। আমাদের এই বিচার বিভাগেরই একজন বদরুদ্দীন আহমেদ সিদ্দিকী, যিনি প্রধান বিচারপতি থাকাকালে টিক্কা খানকে শপথ না পড়ানোর সাহস দেখান। এরও আগে (পাকিস্তান পর্বে) সাবেক প্রধান বিচারপতি আমিন আহমেদ লেখেন, ‘সরকারে যে যখনই থেকেছে, তার বাছবিচার না করে পাকিস্তানের বিচার বিভাগ সর্বদা আইনের শাসনের শ্রেষ্ঠত্বের ঝান্ডা তুলে ধরেছে।’ আমিন আহমেদ আইয়ুবের আটান্নর সামরিক শাসনকালেও প্রধান বিচারপতি ছিলেন।

ওই সময় জেলায় জেলায় আইয়ুবের সেনা প্রশাসকেরা হঠাৎ ‘জনস্বার্থে’ হুকুম জারি করেছিলেন যে অধস্তন আদালতের বিচারাধীন মামলা এক সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। তখন আমিন আহমেদ তৎকালীন জিওসিকে ফোন করে বলেছিলেন, এই আদেশ বহাল থাকার অর্থ হলো, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অপমৃত্যু। জিওসি দ্রুত ওই আদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। চারিত্রিক দৃঢ়তা আর নৈতিক শুদ্ধতার এমন উজ্জ্বল উত্তরাধিকার আমাদের বিচার বিভাগ। জাতির চরম সংকটের সময়েও নতজানু হয়নি বিচার বিভাগ, যে কারণে ‘কোর্টিং কারেজ ইন হার্ড টাইমস’ অভিধার জন্ম।

সরকারের ভয়ে শাসনতন্ত্রসম্মত সুশাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যদি বিচার বিভাগ পালন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জনগণের আস্থার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার পরিণাম বিচার বিভাগকেই বহন করতে হবে। এই দায়িত্বে অবহেলা বিচারিক পাপ। মার্কিন বিখ্যাত চিন্তক হেনরি ওয়ার্ড বিচার বলেছিলেন, ‘দুনিয়ায় সব কালপর্বের সব ন্যায় বিচারকের গাউন (রোব) জোড়া দিলেও সেটা এতটা দীর্ঘ হবে না যে তা দিয়ে একজন বিচারকের পাপ ঢাকা যায়।’

বাংলাদেশে ব্যবস্থার স্থিতাবস্থা যেন শাশ্বত সত্য। রাষ্ট্র ও সমাজে ঘটে যাওয়া নানা অনাচার ও অন্যায় প্রতিবিধানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হচ্ছে বিচার বিভাগ। কিন্তু বিচার বিভাগের দুর্নীতির অভিযোগের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে যখন আলোচনা করতে হয়, তার চেয়ে অস্বস্তিকর কিছু হয় না। বিচারব্যবস্থা–সংক্রান্ত গলদ দূর করতে একজন প্রধান বিচারপতি প্রায়ই যথেষ্ট সময় পান না। স্বল্প সময়ের দায়িত্ব নিয়ে আগাপাছতলা পাল্টে দেওয়ার বৈপ্লবিক আশা না করাই শ্রেয়।

তবে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি অল্প সময় পেয়েছিলেন, কিন্তু দায়িত্ব নিয়েই সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের বেশ কিছু নির্বাহককে বদলি করেন (যা সেই সব কর্মকর্তা পছন্দ করেননি)। আপাতদৃষ্টে তেমন বড় কোনো পরিবর্তন মনে না হলেও এর পেছনে যে প্রাগম্যাটিক ফিলোসফি ছিল, সেটি বোধকরি শিরোধার্য। তিনি বলেন, কেউ দীর্ঘদিন একই পদে থাকলে ‘কোটারি স্বার্থ’ গড়ে ওঠে। নিয়মিতভাবে পরিবর্তনের কারণে এতে শেওলা জমতে পারে না। তিনি দায়িত্ব নিয়ে বেঞ্চ অফিসার (বিও) এবং সহকারী বেঞ্চ অফিসারদের (এবিও) বদলির মতো গুরুত্বপূর্ণ আদেশ দেন।

আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘ সময় আইনচর্চার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জনমুখী প্রধান বিচারপতি নিশ্চিতভাবেই জানেন, আইন সেবাদান প্রক্রিয়ার কোথায় কী অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে এবং হাইকোর্ট বিভাগে দায়িত্ব পালনকালে তাঁর পেশাদারি বেঞ্চের মামলা নিষ্পত্তির দ্রুততা এখন সর্বত্র অনুসৃত হবে ধারণা করা যায়।

যতটা তীব্র ও প্রত্যক্ষতায় আরও বেশি ঘনীভূত ও প্রয়োজনীয় প্রচণ্ডতায় বিচার বিভাগের ভূমিকা রাখার কথা, কোথায় যেন তার অভাব দেখা যায়। এই অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ কিংবা বোঝাপড়াটা জারি রাখা বাঞ্ছনীয়। নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারির পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বিচারপতি ওবায়দুল হাসান মামলাজট আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ় অবস্থানের কথা স্পষ্ট করেছেন।

আদর্শ রাষ্ট্রে তিনটি অঙ্গ হলো নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ আর বিচার বিভাগ। নির্ধারিত ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণেও রাষ্ট্রের এই তিনটি অঙ্গ সম্পূর্ণ আলাদাভাবে কাজ করতে পারে না পরস্পরের সমন্বয় ও ভারসাম্য ছাড়া। এর ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের গতিশীলতা। তিনটি বিভাগকে সম কিন্তু ভিন্ন (ইক্যুয়াল বাট ডিফ্রেন্ট) ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা সংবিধানের বিধানাবলির আওতায় কাজ করছে কি না, এটা নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রয়োজন। স্বাধীন বিচার বিভাগ সংবিধানের অভিভাবক।

কোনো দাবি যদি রায় মারফত সমর্থিত হয়, তার গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিতভাবেই বেশি। উল্লেখ করা যায়, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বিচারপতি লিখেছেন, রাষ্ট্রের নির্বাহী ও আইনসভা থেকে বিচার বিভাগের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো। তবে সেই ভালো কেমন, সেটা প্রধান বিচারপতি পরিষ্কার করেছেন। তাঁর কথায়, বিচার বিভাগ ডুবুডুবু অবস্থায় নাক উঁচু করে টিকে আছে। নতুন প্রধান বিচারপতি উচ্চতর কোনো সীমারেখা কি নির্ধারণ করবেন?

কারণ ‘আইনের শাসন পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট’ (ডব্লিইউজেপি)–এর রুল অব ল ইনডেক্স ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে সর্বশেষ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেই প্রতিবেদনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের ১৪০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১২৭তম স্থানে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ’ (সূত্র: ডেইলি স্টার, ২৭ অক্টোবর, ২০২২)।

শাসনতান্ত্রিক সীমা লঙ্ঘন সরকারের একটা মৌল প্রবণতা এবং তা করতে না দেওয়ার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। সরকারের কোনো কাজ বৈধ আর কোনটি অবৈধ, তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব বিচার বিভাগের, এই ক্ষমতা সংবিধানই দিয়েছে। আমাদের বিচার বিভাগের কাছ থেকে এই ভূমিকার অনুশীলন প্রয়োজনীয় মাত্রায় দেখতে চায় নাগরিকেরা। জুরিস্ট ডায়াসকে শরণে নিই, ন্যায়বিচার নিশ্চিতে আদালতের ওপর অনেক বেশি আস্থা স্থাপন করা উচিত। কারণ, ন্যায়বিচারের মান আইনপ্রণেতাদের গুণের তুলনায় বিচারকদের গুণের ওপরই বেশি নির্ভর করে।

সরকারের ভয়ে শাসনতন্ত্রসম্মত সুশাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যদি বিচার বিভাগ পালন করতে ব্যর্থ হয়, এর পরিণাম বিচার বিভাগকেই বহন করতে হবে। এই দায়িত্বে অবহেলা বিচারিক পাপ। মার্কিন বিখ্যাত চিন্তক হেনরি ওয়ার্ড বিচার বলেছিলেন, ‘দুনিয়ায় সব কালপর্বের সব ন্যায় বিচারকের গাউন (রোব) জোড়া দিলেও সেটা এতটা দীর্ঘ হবে না যে তা দিয়ে একজন বিচারকের পাপ ঢাকা যায়।’

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
adv.mmkzaman@gmail.com

Comments