ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন

যুদ্ধকালীন উন্নয়নশীল দেশগুলোর রিজার্ভ কমেছে ৩৭৯ বিলিয়ন ডলার

প্রকাশিত: ৯:০৭ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২৪, ২০২২

চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশ ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পরাশক্তি রাশিয়া। এই যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার উপর বহু সংখ্যক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো।

রাশিয়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাল্টা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর প্রভাব পড়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে। বলা যায়, এই যুদ্ধের প্রভাবে বর্তমানে চরম টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। অর্থনৈতিক সংকটের এই ধাক্কা উন্নত দেশগুলো নানাভাবে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও এটি যেন ‘মরার উপর খরার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য।

বিষয়টি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ‘ব্লুমবার্গ’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে উঠে এসেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থায়ন সক্ষমতায় কতটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে সে চিত্র। শুধু তাই নয়, শক্তিশালী ডলারের কষাঘাত কেবল উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জন্যই দুর্ভাগ্য হয়নি– জাপান ও ইউরোপের মতো উন্নত দেশগুলোও এর ভুক্তভোগী।

ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন ডলারের মান ক্রমে বাড়তে থাকায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থায়ন সক্ষমতায় বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান ধরে রাখার প্রচেষ্টায়– এসব দেশের আর্থিক নীতিনির্ধারকদের প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০০ কোটি ডলার মুদ্রাবাজারে সরবরাহ করতে হচ্ছে। অথচ সংকটকালেই সবচেয়ে বেশি দরকার ‘ফরেক্স মজুদ’ নিশ্চিত করা।  কিন্তু, গুরুতর অর্থনৈতিক সংকট থামানোর চেষ্টায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর ‘ফরেক্স মজুদ’ তথা রিজার্ভ চলতি বছরে কমেছে ৩৭৯ বিলিয়ন ডলার।

এসব প্রচেষ্টা ডলারের মানকে উপরের দিকে চালিত করা অনুঘটকগুলো কতটা শক্তিশালী এবং উন্নয়নশীল দেশের জন্য বর্তমান সময় কতটা দুর্দশার–তারই চিহ্ন নির্দেশ করে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল এসব দেশের আর্থিক খাতের দুর্বলতাও তাতে প্রকাশ পেয়েছে। আর্থিক কর্তৃপক্ষের আলোচিত চেষ্টাগুলোও তাদের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে পারছে না।

এই অবস্থা, আফ্রিকার ঘানা থেকে শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকার চিলি অথবা এশিয়ার পাকিস্তান সর্বত্রই বিরাজ করছে। উন্নয়শীল দেশগুলোর মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে রেকর্ড নিম্ন অবস্থানে নামছে মুদ্রাবাজারে। এতে হু হু করে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি।

এমনিতেই করোনা মহামারীর কারণে উন্নয়নশীল এসব দেশের নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ দুর্ভোগের শিকার হয়েছিল; তারা সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই– ডলার সংকট নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে তাদের টুঁটি চেপে ধরেছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা একের পর এক বিপর্যয়ে দিশেহারা সাধারণ মানুষ– এসব দেশে দেখা যাচ্ছে জনরোষ ও বিক্ষোভ।

চলতি বছর বিশ্বের ৩৬টি দেশের মুদ্রা অন্তত ১০ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে মুদ্রাবাজারে। শ্রীলঙ্কান রুপি ও আর্জেন্টিনার পেসো-সহ ১০টি মুদ্রার ক্ষেত্রে তা হয়েছে ২০ শতাংশের বেশি।

গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে উদীয়মান বাজারের মহাসংকটের সাথে সব ধরনের মিল দেখা যাচ্ছে বর্তমান সংকটের। ওই সময়ে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতা– তাদের মুদ্রার মানে ব্যাপক দরপতন ঘটায়। এক দশক পরে যা দেখা যায় এশিয়ার দেশগুলোতে।

আপাতত, মুদ্রার মানে এত বড় ধসের অনুমান করছেন না বেশিরভাগ বিশ্লেষক। যদিও তারা উল্লেখ করেছেন, ডলারের মান বৃদ্ধির প্রধান চালক– আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ। মৌলিক নীতিনির্ধারণী সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে স্থানীয় মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় ফেড। এখনও কর্তৃপক্ষটি এই লক্ষ্যপূরণে বড় সাফল্য পায়নি। তাই আরও কিছুকাল ফেড ডলারের উচ্চ মান ধরে রাখবে।

এরমধ্য নিজ লক্ষ্যপূরণে ফেড যদি সুদহার আরও বাড়ায়– তাহলে পুরোদমে মুদ্রা সংকটে পড়বে উন্নয়নশীল দেশগুলো। অধিকাংশ বাহ্যিক ঋণ বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকায়–এর ফলে দেনা সংকটও তৈরি হবে। একের পর এক দেশের সরকার হতে পারে ঋণখেলাপি ও দেউলিয়াত্বের শিকার।

সিডনি-ভিত্তিক স্যাক্সো ক্যাপিটাল মার্কেটস সংস্থার কৌশলবিদ জ্যাসিকা আমির বলেন, “নিঃসন্দেহে উদীয়মান বাজারে আমরা একটি বড় সংকট দেখতে পাব। এরমধ্যেই দেশগুলো (মুদ্রা সংকটে) ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে । এই বাস্তবতায়, শক্তিশালী ডলার সব ধরনের অনিশ্চয়তার উৎস– পারতপক্ষে তা বেশি সত্য দুর্বল উদীয়মান বাজার অর্থনীতিগুলোর ক্ষেত্রে।”

শক্তিশালী ডলারের কষাঘাত শুধু উদীয়মান দেশগুলোর জন্যই দুর্ভাগ্য হয়নি– জাপান ও ইউরোপও এর ভুক্তভোগী। গত মাসে ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ডলারের বিপরীতে মান কমে ইউরোর। ১৯৯৮ সালের পর সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে চলে যায় ইয়েন। এতে এসব অঞ্চলের কোম্পানি ও ভোক্তারা যারা বিদেশ থেকে আসা পণ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল–তাদের বাড়তি দাম দিতে হয়েছে। কিন্তু, এই পরিবর্তনে অস্তিত্ব হুমকিতে পড়ার মতো বিপদগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলো–যাদের ডলার-ভিত্তিক বৈদেশিক অর্থায়নের ওপর নির্ভর করতে হয়।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর রিজার্ভে এ বছর শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা তাদের মোট রিজার্ভের ৬ শতাংশের কম বলে জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর তথ্য। ৬৫টি উন্নয়নশীল দেশের রিজার্ভের তথ্য এতে রয়েছে। কিন্তু, সমস্যাটা অন্যত্র। এই পরিস্থিতিকে নিবিড়ভাবে নজরে রাখছেন বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা। ২০১৫ সালে চীন আকস্মিকভাবে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করার পর মুদ্রার মানে যে বড় অবনমন ঘটে, তারপর বর্তমানেই এটি সবচেয়ে দ্রুতগতিতে ঘটছে।

এবার রিজার্ভে সবচেয়ে বেশি শূন্যতা তৈরি হয়েছে– ঘানা, পাকিস্তান, মিশর, তুরস্ক ও বুলগেরিয়ায়। স্থানীয় মুদ্রার মান ধরে রাখতে এসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও সবচেয়ে বেশি ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে মুদ্রাবাজারে।

ক্রমবর্ধমান বন্ডের সুদহার এবং ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ ২১৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা দুর্দশাকে আরও গভীরতর করবে। এই বাস্তবতায়, কোন মুদ্রা কতদূর মান হারাবে– তা নিয়েই কেবল মতভেদ রয়েছে বিশ্লেষকদের। কিন্তু, তা যে কমবেই- তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই কারো মনে। কিছু কিছু দেশের মুদ্রার ক্ষেত্রে তা খাড়া পতনের শিকার হবে বলে অনুমান করছে রেনেসাঁস ক্যাপিটাল ও এইচএসবিসি হোল্ডিংসের মতো বৃহৎ সংস্থা।

ফিডেল্টি ইন্টারন্যাশনাল সংস্থার মুদ্রা ব্যবস্থাপক পল গ্রিয়ার বলেছেন, “বৈশ্বিক তারল্য প্রবাহ কমার এই পরিবেশে, অর্থনৈতিক বিকাশের গতিও কমছে। তার সাথে চলছে মূল্যস্ফীতি ও শক্তিশালী ডলারের আঘাত। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর সামষ্টিক অর্থনীতির জটিলতা এতে আরও বেশি মুদ্রা সংক্রান্ত দুর্দশার দিকে এগিয়ে যাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তাই আমরা সতর্ক থাকছি।” সূত্র: ব্লুমবার্গ

Comments