তালগাছের নয়নাভিরাম সারি; নিধনযজ্ঞে হারিয়ে যাচ্ছে নড়াইলের গ্রামীণ ঐতিহ্য!

প্রকাশিত: ১:১৮ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৮, ২০১৯

নড়াইল জেলা প্রতিনিধি: নড়াইলে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নয়নাভিরাম তাল গাছ। তাল একটি সুপরিচিত হারিয়ে যাচ্ছে ফল। তালগাছ দীর্ঘজীবী বৃক্ষ। তালের আদি নিবাস মধ্য আফ্রিকা হলেও নড়াইলের কিছু কিছু স্থানে ছোট-বড় তালগাছ চোখে পড়ে।

গুচ্ছমূলী বৃহৎ অশাখ বৃক্ষ তাল, গাছের গোড়ার দিক মোটা, ওপরের অংশ তুলনামূলক চিকন, কান্ডো মাথায় বোঁটা ও পাতা গুচ্ছভাবে সাজানো থাকে ও বোঁটার দুই ধারে করাতের মতো দাঁত আছে। বোঁটা শক্ত ও পুরু। গাছ উচ্চতায় ২০ থেকে ২৫ মিটার হয়ে থাকে এবং দীর্ঘজীবী উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম তাল। ১৪০ থেকে ১৫০ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকে এই গাছ। তুলনামূলকভাবে রোগ-বালাই কম।

তাল পুরুষ বা স্ত্রী যে কোনো এক ধরনের হয়। গাছ উভয় লিঙ্গ নয়, একই গাছে দুই রকম ফুল ফোটে না। গাছ প্রতি ৪০০ থেকে ৫০০টি পর্যন্ত ফল ধরে। তবে এর পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে। গাছে কাঁদিতে ফল ধরে। একটি গাছে অনেক কাঁদি ফল ধরে। ফলের আকার গোলাকার চ্যাপ্টা, প্রতি ফলের গড় ওজন ১ থেকে ৫ কেজি পর্যন্ত হয়।

ফলের রং প্রথমে হলদে সবুজ। পরিপক্ব ফলের রং হলুদ এবং খয়েরি কালো রঙের হয়। তাল ফলে এক থেকে দুটি বা তিনটি আঁটি দেখা যায়। ফল পাকে ভাদ্র মাসে। তবে কোনো কোনো গাছে বছরের অন্যসময় ফল ধরতে দেখা যায়। পাকা ফলের ঘ্রাণ তীব্র সুগন্ধযুক্ত। স্বাদে মিষ্টি থেকে পানসে মিষ্টি হয়। গাছে পাকা তাল আপনা-আপনি ঝরে পড়ে।

পাকা তালের কাঁদি

সাধারণত গ্রীষ্মের মৌসুমে ফলে তাল। তালফল ও তালগাছের বহুবিধ ব্যবহার ও পুষ্টি গুণাগুণ বিবেচনায় দেশীয় ফলের মধ্যে তালের অবদান শীর্ষে। তালের পাতা দিয়ে হাতপাখা, মাদুর, টুপি, ঘরের ছাউনি, চাটাই, ছাতা তৈরি হয়। এচাড়া লাকড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয় পাতা ও কাণ্ড। এমনকি তালগাছের কাঠ দিয়ে ঘরের রোয়া দেওয়া হয়।

পুরুষ গাছের ফুল বা জটা থেকে রস সংগ্রহ করে তা দিয়ে গুড়, পাটালি, ভিনেগার, পিঠা, বড়া, লুচি, সডিনগাছ তৈরি করা হয়। পাকা তালের রস দিয়ে পিঠা, বড়া, ক্ষীর, পায়েস তৈরি করা হয়। কচি ও কাঁচা তালের নরম শাঁস মুখরোচক পুষ্টিকর ও ছোট-বড় সবার প্রিয়। গ্রীষ্মের তৃষ্ণা নিবারণে কাজ করে।

তাল ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার, তালের রস শ্লেস্মানাশক, মূত্র বর্ধক, প্রদাহ ও কোষ্ঠ-কাঠিন্য নিবারণ করে। রস থেকে তৈরি তালমিছরি সর্দি-কাশিতে মহৌষধ হিসেবে কাজ করে। অজ্ঞতা ও দৈনন্দিন বিভিন্ন চাহিদার কারণে দিন দিন যেভাবে তালগাছ নিধন করা হচ্ছে এতে প্রকৃতি পরিবেশ হারাচ্ছে তার রূপ সৌন্দর্য।

নয়নাভিরাম সারি সারি তালগাছ, গাছে গাছে তালফল ও তালগাছে পাখিরা বাসা বেঁধেছে এমন দৃশ্য এখন তেমন দেখা যায় না। গ্রামীণ ঐতিহ্য থেকে মুছতে চলেছে তালগাছ ও তার সৌন্দর্য। নড়াইলের পথে-ঘাটে এখন আগের মতো তালগাছের সারি দেখা যায় না।

নির্বিচারে গাছ নিধনের ফলে অনেক দূর পর পর হয়তো দু’একটা তালগাছ দেখা যায়। কিন্তু এ অবস্থা পরিবেশ ও গ্রামীণ ঐতিহ্যের জন্য হুমকি। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের আগামী প্রজন্মকে হয়তো তালগাছ চিনার জন্য যাদুঘরে যেতে হবে।

প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ মৌসুমে অন্যান্য বৃক্ষ চারার সঙ্গে আমরা যদি তালগাছের বীজ/চারা বেশি বেশি রোপণ করি এবং নির্বিচারে তালগাছ নিধন না করি তবে আমাদের এ দেশে আবারো উপকারী ফল তাল ফিরে পাবে তার হারানো ঐতিহ্য।

/আরএ

Comments