কুসংস্কার প্রতিরোধে শতাধিক স্কুল ছাত্রীকে বাইসাইকেল প্রদান

প্রকাশিত: ১২:৫৯ অপরাহ্ণ, মার্চ ১০, ২০১৯

উজ্জ্বল রায়: নড়াইল সদর উপজেলার গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শতাধিক ছাত্রী এখন ছেলেদের মতোই সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে। তাদের ভ্যানের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। ক্লাসও মিসও হয় না এখন। তাই পূর্বের তুলনায় ফলাফলও অনেক ভালো।

আগে বাবা মায়ের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিতে হতো। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে বখাটেরা বিরক্ত করতো। কিন্তু বাইসাইকেল তাদের অনেক সমস্যারই সমাধান করে দিয়েছে। সকলের সহযোগিতার মাধ্যমে এলাকার বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, নারী নির্যাতনসহ সমাজ থেকে সব ধরণের কুসংস্কার দূর করার প্রত্যায় নিয়ে এগিয়ে চলেছে ওরা।

নড়াইল শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে নড়াইল সদর উপজেলার শেখহাটি ইউনিয়নের গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিদ্যালয়টিতে নড়াইল সদর ও যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত।

দুটি উপজেলার মালিয়াট, বাকলি, হাতিয়াড়া, গুয়াখোলা, হাতিয়াড়া, বেনাহাটি, কমলাপুরসহ এগারোটি গ্রামের ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করে এখানে। বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় তিনশ। দুই জেলার সীমান্তবর্তী হওয়ায় এই এলাকাটি অনেকটা অবহেলিত এবং অধিকাংশ রাস্তাঘাট কাঁচা। ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার দূর থেকেও শিক্ষার্থীরা এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে আসে।

চার পাঁচ বছর আগে ছেলেরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করলেও মেয়েদের ভ্যানে ও পায়ে হেটে স্কুলে আসা যাওয়া করতে হত। দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকদের যৌথ প্রয়াসে মেয়েদের সাইকেল কিনে দেয়া হয়। বছর চারেক আগে হাতে গোনা কিছু ছাত্রী বাইসাইকেলে করে স্কুলে যাতায়াত শুরু করে। দিন দিন বাড়তে থাকে তাদের সংখ্যা।

বর্তমানে শতাধিক ছাত্রী নিয়মিত সাইকেলে নিয়ে যাতায়াত করে। এসব ছাত্রীরা তাদের বান্ধবীদেরকেও বাইসাইকেলের পেছনে বসিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করে।

ওই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী শান্তনা গুপ্ত বলেন, আমার বাড়ি বাকলি গ্রামে। স্কুল থেকে দুরত্ব ৫ কিলোমিটার। এক সময়ে ভ্যানে ও পায়ে হেটে স্কুলে চলাচল করতাম। তখন ঠিকমতো ক্লাস ধরতে পারতাম না। বাবা মা অতিরিক্ত টাকা দিতেও অসুবিধা হত।

তখন আমরা কয়েকজন ছাত্রীরা মনে করলাম ছেলেরা যদি বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসতে পারে তাহলে আমরা পারবো না কেন?
তখন থেকে স্যার ও আমাদের বাবা মায়ের সাথে কথা বলে সাইকেল কেনার সিদ্ধান্ত নেই। বাড়িতে ও গ্রামের ফাঁকা জায়গায় সাইকেল চালানো শিখে আমরা কয়েকজন স্কুলে আসা যাওয়া শুরু করলাম।

নবম শ্রেণীর ছাত্রী দীপ্তি বলেন, আগে ভ্যানে করে স্কুলে আসতে হত। তখন বাবা মায়ের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিতে হত। ভ্যান না পাওয়ায় অনেক সময় নষ্ট হত। কিন্তু এখন আর কোন সমস্যা হয় না। নিয়মিত ক্লাস করতে পারি এবং পড়াশোনাও ভাল হচ্ছে। তবে বাইসাইকেলে চালিয়ে যাতায়াতের সময় রাস্তার অন্যান্য যানবাহন সাইড দিতে চায় না। অনেকে ব্যঙ্গ করে।

ছাত্রী সেজুতি রায় বলেন, আমি ৫ কিলোমিটার দ‚র থেকে স্কুলে আসি। কিন্তু স্কুলে সাইকেল গ্যারেজ না থাকায় কিছুদিন আগে আমাদের বান্ধবীদের দুটি সাইকেল চুরি হয়ে যায়। স্কুলে একটি সাইকেল গ্যারেজ নির্মাণের প্রয়োজন।

ছাত্রী খুশি সিকদার বলেন, এই স্কুলে ১১টি গ্রামের ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করে। ছেলেদের মতো মেয়েরাও সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে। আমরা প্রথমদিকে সাইকেল চালাতে লজ্জ্বা পেতাম। এখন আমরা অনেক সাহসী। আমরা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাবো।

এলাকার বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, নারীনির্যাতনসহ সমাজ থেকে সকল প্রকার কুসংস্কার দ‚র করতে সকলে কাজ করে যাবো। এই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র সোহাগ গুপ্ত বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলের ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সাইকেল চালিয়ে আসে। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে বখাটেরা তাদের উত্যক্ত করার চেষ্টা করলে আমরা ছেলেরা প্রতিহত করি। অনেক সময় স্যারের সহযোগিতা এবং ওইসব বখাটেদের বাবা মায়ের সাথে আলোচনা করি।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ বলেন, গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি নড়াইল শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত। এই স্কুলে প্রায় তিনশত ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে। এর মধ্যে ১৪৩ জন ছাত্রী রয়েছে। এই স্কুলের মেয়েরা ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার দূর থেকে স্কুলে আসে।
তাদের হেটে আসতে অনেক সময় লাগে এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যার কারনে ক্লাসে পাঠদানে মনোযোগি হতে পারে না। আমরা ও অভিভাবকরা চিন্তু ভাবনা করে মেয়েদের বাইসাইকেল চালনায় অনুপ্রেরণা দিয়েছি। তাদেরকে বলেছি ছেলেরা যদি সাইকেল চালিয়ে আসতে পারে, তাহলে মেয়েরা কেন পারবে না। তখন অভিভাবকদের সম্মতিতে ছাত্রীদের সাইকের কিনে দেয় তাদের অভিভাবকরা।

এখন ওরা নিয়মিত সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে। আমরা এখন ছেলে ও মেয়েদের আলাদাভাবে দেখি না। সাইকেল নিয়ে স্কুলে আসতে এখন সময় কম লাগছে, অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে এবং নিয়মিত ও সময়মত স্কুলে উপস্থিত হতে পারছে। যার কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানও বেড়েছে।
তিনি আরো বলেন, এবছর ওই বিদ্যালয় হতে সব ছাত্রছাত্রীই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়ে শতভাগ পাশ করেছে। তবে অবকাঠামো সমস্যার জন্য সাইকেল রাখার জায়গা নেই এবং শিক্ষার্থীদের পাঠদানও ব্যাহত হচ্ছে।

নড়াইলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, (পিপিএম বার) মনে করেন, বিদ্যালয়ের মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াতের ঘটনাটি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। এভাবে যদি অন্যান্য স্কুলের মেয়েরাও স্কুলে যাতায়াতের জন্য বাইসাইকেলকে বাহন হিসেবে বেঁছে নেয় তাহলে তাদের অর্থ, সময় সব কিছুই সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি পড়াশোনায় মনোযোগি হবে।

বাইসাইকেল পরিবেশ বান্ধব। এতে পরিবেশ দ‚ষিত হয় না। সব স্কুলের মেয়েরা সময় ও অর্থ সাশ্রয় এবং স্বাধীনভাবে চলাচলের জন্য বাই সাইকেলকে বাহন হিসেবে বেঁছে নিবে এই প্রত্যাশা করি। পাশাপাশি গুয়াখোলা স্কুলের সার্বিক উন্নয়নে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।

এফএফ

Comments