ইতিহাসের দালাইলামা

প্রকাশিত: ৬:১৯ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৮, ২০১৯

ফাইজা হুমাইরা: ৬০ বছর আগে এই মার্চেই রাতের জমাট অন্ধকারে লাল ফৌজের লাল চক্ষু এড়িয়ে পথে নেমে পড়েছিলেন তিনি। অচেনা, অজানা পথে। কপালে কী লেখা রয়েছে, তা না জেনেই। সঙ্গে ছিলেন বৃদ্ধা মা, বোন, ছোট ভাই আর তাঁর কয়েক জন অফিসার।

তিব্বতে তার প্রাসাদ ছেড়ে পথে নেমে পড়া ছাড়া আর কোনও পথই সে দিন খোলা ছিল না ধর্মগুরু দলাই লামার সামনে। ৮ বছর আগেই বৌদ্ধ ধর্মাবলাম্বী স্বাধীন তিব্বতে লাল ফৌজ ঢুকিয়ে দেয় চিন। শুরু হয় অত্যাচার। নির্যাতন। তিব্বতের দখল নেওয়ার জন্য। লাল ফৌজকে রুখতে সে দিন গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দলাই লামা। তাই তিনি টার্গেট হয়ে উঠেছিলেন চিনের।

‘দালাইলামা’ পৃথিবীর ছাদে থাকা এককালের নিষিদ্ধ রাজ্য তিব্বতের ধর্মগুরুর পদবী। তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ‘গেলুগ’ নামের যে শাখাটি প্রচলিত আছে, তার প্রধান ধর্মগুরুকে দালাইলামা নামে অভিহিত করা হয়।

মোঙ্গলীয় ভাষায় ‘দালাই’ শব্দের অর্থ সমুদ্র আর সংস্কৃত ‘লামা’ শব্দের অর্থ গুরু বা আধ্যাত্মিক শিক্ষক। অর্থাৎ দালাইলামা শব্দটির পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় এমন এক শিক্ষক যার জ্ঞান বা আধ্যাত্মিকতা সমুদ্রের মতোই গভীর।

অন্যদিকে দালাইলামাদের নামের সাথে গিয়াৎসু শব্দটি যুক্ত থাকে। যেমন বর্তমান দালাইলামার নাম তেনজিন গিয়াৎসু। তিব্বতীয় ভাষায় এই ‘গিয়াৎসু’ শব্দের অর্থও সমুদ্র। যে শব্দটি আসলে দালাইলামার সাথে অনেকটাই সমার্থক। কিন্তু তাহলে দালাইলামা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিলো কীভাবে?

চলুন জেনে নিই কে এই দালাইলামা?

৬০ বছর আগে মার্চের সেই রাতেই পথে নেমে না পড়লে লাল ফৌজের হাতেই প্রাণ হারাতে হত তাকে। হয়তো তার পরিবারের সদস্যরাও রেহাই পেতেন না।

সেই রাতে লাল সেনার পোশাক পরে পথে নেমেছিলেন দলাই লামা। তার পর মা, ভাই, বোন আর জনাকয়েক অনুগামী নিয়ে তার দু’দিন, দু’রাত কেটেছিল অচেনা, অজানা পথে।

কখনো পায়ে হেঁটে। কখনো বা ঘোড়ার পিঠে। আর ছিল ক’টা খচ্চর। যাদের পিঠে চাপানো ছিল এক মাসের মতো জল, খাবারদাবার, আনুষঙ্গিক আরও কিছু।

যাচ্ছেন কোথায়, জানা ছিলো। ভারত। কিন্তু কোন পথে যাবেন, কোন পথে গেলে এড়াতে পারবেন লাল ফৌজের কড়া নজর, জানা ছিল না। তাই খানিকটা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে হয়েছিল তাদের। হাঁটতে হাঁটতে পথে পড়ল ব্রহ্মপুত্র নদ।

এ-পার থেকে ও-পারের দূরত্ব যার দেড় হাজার ফুট। সেই ব্রহ্মপুত্র তারা সেই রাতের অন্ধকারে পেরিয়েছিলেন তিব্বতি গরুর চামড়া দিয়ে বানানো ছোট্ট একটি নৌকায়। ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে আবার অনেকটা দুর্গম পাহাড়ি পথ। হিমালয়। হাঁটা ছাড়া যা পেরনো সম্ভব নয়।

সেই পথে কখনও হেঁটে, কখনও পাহাড় ধরে উঠে-নেমে তাঁর মা, ভাই, বোন আর অনুগামীদের নিয়ে দলাই লামা শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন ভারত ভূখণ্ডে। পালিয়ে আসার দু’দিন পর জানতে পেরেছিল লাল ফৌজ। তার পরেই তিব্বতে দলাই লামার খোঁজে বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয়েছিলো তল্লাশি, অত্যাচার।

তারপর বন্দুকের মুখে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে তিব্বতকে গায়ের জোরে তার দখলে নিয়ে এসেছিল চিন। সেটা ছিল ১৯৫৯ সালের ২১ মার্চ। তত দিনে দলাই লামা ঢুকে পড়েছেন ভারত ভূখণ্ডে।

ভারত তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিল এপ্রিলের ৩ তারিখে। তার নির্বাসিত সরকারকে জায়গা দিল হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায়। তার পর সেখান থেকেই তিব্বতে মুক্ত করার দাবিতে চিনবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করেছেন দলাই। যার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৯ সালে দলাই পান নোবেল শান্তি পুরস্কার।

তথ্যসূত্র-আনন্দবাজার

বিআইজে/এসএস

Comments