ভালো লোকেরা একটি জায়গায় পিছিয়ে যায়…

প্রকাশিত: ১২:২৮ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ৬, ২০১৯

ইফতেখায়রুল ইসলাম
অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (প্রশাসন), ওয়ারী

আসেন একটু গল্প করি…। আমি কথক বলে যাই, আপনি সময় পেলে বুঝে নেবেন!

কারো কারো খুব শখ হল মানুষের জন্য কাজ করার। সময়ে, অসময়ে মানুষকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তারা দেখল কাজটি আসলে সহজ নয়। একই সাথে একটা বিষয় আসলে পরিস্কার হওয়া দরকার শুরুতেই, আমরা কেহই শতভাগ পরিস্কার নই, আমাদের প্রত্যেকের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কাজেই প্রকৃত সৎ ও সততা বলতে যেটি বোঝায় সেটি বিদ্যমান হয়তো রয়েছে কিন্তু তা পরিপূর্ণভাবে নয়।

আমরা খুব কাছ থেকে দেখা, জানা সৎ ব্যক্তিদের সততা নিয়ে আশাবাদী হই, সাধুবাদ জানাই। সংকট দেখা যায় অন্য ক্ষেত্রে! এই সমাজে বসবাসরত মন্দ লোকেরা আবার খুব সংগঠিত, ভাল লোকেরা পিছিয়ে যায় এই একটি জায়গায়। গুটিকয়েক মন্দের ভিড়ে চাপা পড়ে যায় অসংগঠিত ও দায় না নিতে চাওয়া ভাল মানুষেরা। সমাজটা চলছে অনেকটা এভাবেই।

আমরা এবং আমাদের সমাজ চাই রুপকথার গল্পের মত দুর্দান্ত কর্মকর্তারা এসে সবকিছু এক লহমায় ঠিক করে দেবেন; কিন্তু তাদের সহযোগী শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে আমাদের অনেকেরই আবার কষ্ট হয়!

যাই হোক বলছিলাম মন্দ লোকদের গল্প…। আসেন একটু পরিচিত হই তাদের সাথে…। এলাকাভেদে তাদের প্রকাশ, বিস্তার ভিন্ন হলেও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মানুষের ক্ষতি সাধণে তারা আবার একই রকম।

নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই আসি একটি ক্রাইম জোনে পুলিশের সিনিয়র এএসপি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে প্রায় ২.৫ বছর দায়িত্ব পালন করেছি, অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছি অনেকটাই…।

তাতে আমার উপলব্ধি হল, আপনি যদি পূর্ণ পেশাগত সততা নিয়ে কাজ শুরু করতে চান, তবে মন্দ লোকেরা শুরু থেকেই আপনাকে বিভ্রান্ত করা শুরু করবেন।

আসেন জেনে নেই কিভাবে..?

১) প্রথমেই তারা নিজেরা তথ্য দিয়ে খুব সহায়তা করতে চাইবে, দুয়েকটা বিষয়ের সত্যতাও পাওয়া যাবে পরবর্তী সময়ে আপনার সাথে যদি একটু সখ্যতা গড়ে উঠে তার ফায়দা নেয়া শুরু করবেন সেই ভদ্রবেশী মন্দ মানুষ!

২) মন্দদের মাঝে আবার ঘরানা আছে, এক ঘরানা আরেক ঘরানার বিপরীতে কাজ করে। কিন্তু যদি দুই ঘরানা আবার আপনি কঠিন কর্মকর্তার কারণে চাপে পড়ে যায়, তবে তারা আবার আপনার পেছনে উঠে পড়ে লাগবে।

৩) মন্দ লোকগুলো নিজ এলাকায় বিভিন্ন অপকর্ম সাধণের জন্য আপনাকে ব্যবহার করতে চাইবে! প্রথমেই কর্মকর্তার কাছে বিভিন্ন লোভনীয় প্রস্তাব আসতে থাকবে সেটি ব্যর্থ হয়ে গেলে তারা তাদের সাথে কাজ করা কিছু আপুকে ঘন ঘন ভিকটিম সাজিয়ে আপনার অফিসে পাঠাতে থাকবেন! এবং সেই আপুগণ আবার অযথাই আপনার সরকারি মুঠোফোনে ফোন করে বলবেন, ভাইয়া এটা আমার নম্বর! এখন ধরেন পুলিশ কর্মকর্তা যদি কৌশলী হোন তাহলে উদ্দেশ্যপ্রবণ আপুরা আসলে তিনি অফিসের দরজা পুরোটা উন্মুক্ত রাখবেন সাথে নিজের বডিগার্ডকে দাঁড় করিয়েও রাখতে পারেন! অনেকে নিজের পুরো কক্ষকে সিসিটিভি’র আওতায় নিয়ে আসেন। প্রয়োজন না থাকলে আপুদের সসম্মানে চলে যেতে বলতে পারেন।

৪) অর্থ, অযাচিত মানুষ ও অন্য কোন কিছুই যখন অফিসারকে বিভ্রান্ত করতে পারেনা, ঠিক তখনি আন্ডারগ্রাউন্ডে বসবাসরত কিছু মানুষ যাদের অধিকাংশের পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্তও নয়, নিজেকে সাংবাদিক বলে পরিচয় দিতে দিতে মুখে ফেনা তুলে ফেলবেন! এক অথবা তিন সদস্য বিশিষ্ট এসব আন্ডারগ্রাউন্ড সাংবাদিকগণ নিজেরাই নিজেদের অজানা, অচেনা, মিডিয়াভুক্তহীন পত্রিকার সম্পাদক এবং সিনিয়র রিপোর্টার হয়ে বসে থাকেন। এরা ওইসব তথাকথিত পত্রিকা ও সাংবাদিকতার মত মহান পেশার আড়ালে খেলে যান এক নোংরা খেলা। নিজেদের পছন্দমত কাউকে দিয়ে বিজ্ঞ আদালতে করিয়ে দেয়া হয় একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা! অনেক সময় এসকল ভিকটিম তার নিজে দায়ের করা মামলার আসামিদের চেনেনও না। এদের কাছে মামলা করাটা একটা ফ্যাশন।

মামলা করার উদ্দেশ্যটি কী? উদ্দেশ্য হলো ওই কর্মকর্তার মনোবল ভেঙে দেয়া, তাদের অসাধু কাজ হাসিলের পথে প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলা। ভাঙা মনোবল নিয়ে সবাই জেগে উঠতে চায়না এবং পারেও না। কারণ অফিসারের ভেতরটা ভেঙে যেতে থাকে! বারবার প্রশ্ন আসতে থাকে কেন আমার সাথে এমনটা হলো? উত্তর দেয়ার কেউ থাকেনা নিজে এবং পরিবার ছাড়া! মিথ্যার বেসাতি দিয়ে সাজানো এসব ভিত্তিহীন মামলা পরবর্তী সময়ে খারিজ হয়ে যায়! কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত তা পীড়াদায়ক হয়ে থাকে। অনেকে সেই ক্ষোভ থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নেন, ব্যক্তিগত জায়গা থেকে বৃহত্তর মঙ্গলের কথা ভাবতে তার মন আর সায় দিতে চায়না। তিনিও তখন ভাবতে চান কি দরকার চলছে, চলুক। কাজ না করেই তো ভাল থাকা যায়!

অনেকে সেখান থেকে আবার ঘুরে দাঁড়ায়, আরো বেশি কাজ করার চেষ্টায় থাকে, সমাজকে আরও বেশি দিতে চায়। নিজে ভুক্তভোগী বলেই বলছি, এরকম ভিত্তিহীন মামলার সময় চারিপাশের সমর্থন খুব জরুরি। এটি মনোবলকে চাঙ্গা রাখে।

প্রতিকারটি কোথায় এবং কিভাবে?

১) সমাজে বসবাসরত মানুষকে সচেতন হতে হবে। তথাকথিত অবৈধ ব্যবসা পরিচালনাকারী ও তাদের সহযোগী আন্ডারগ্রাউন্ডেড সাংবাদিক যিনি সাংবাদিকতা শব্দের অর্থই বোঝেন না তাদের প্রতিরোধ করতে হবে।

২) আমার পরিচিত অনেক বড় ভাই, সমবয়সী ও ছোট ভাইয়েরা বিভিন্ন পত্রিকা ও চ্যানেলে সাংবাদিকতা করছেন! আপনাদের অনেককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। অনেকে আছেন যাদের জন্য শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। আপনাদের বলছি দয়া করে নিজেদের মহান পেশাটিকে আরও একটু ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা করুন। নাম সর্বস্বহীন যে কেউ সাংবাদিক হয়ে বসে থাকছেন। বিভিন্ন থানা এলাকায় এ ধরণের ভুঁইফোঁড়দের অস্তিত্ব আপনারা পাবেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় আপনাদের নেতৃস্থানীয় সিনিয়রদের মাধ্যমে দয়া করে এদেরকে একটু নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করুন। আপনাদের পেশার জন্যও চরম অসম্মান বয়ে আনছে এরা।

৩) মামলা করার যৌক্তিক অধিকার সকলেরই রয়েছে। এই মামলা মামলা খেলাটা খুব পুরনো হলেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা! সিআর মামলা(কোর্টে যে মামলা হয়) মিথ্যা পরিগণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে যেন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। মিথ্যা মামলা দায়েরকারীদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা জোরেশোরে প্রচারণায় আনতে হবে এটি তাদেরকে মিথ্যা মামলা করার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে নিরুৎসাহিত করবে।

এতকিছুর অবতারণা করলাম কারণ আমার পরিচিত এক অফিসারের নামে একটি মামলা হয়েছে। দুই বছর আগে আমি নিজেও এরকম একটি মিথ্যা মামলার মুখোমুখি হয়েছিলাম সেটি যে মিথ্যা তা বিজ্ঞ আদালত থেকেই প্রমাণিত হয়েছে।
কথা হলো মামলায় সর্বশেষ আসামি করা হয়েছে সেই অফিসারকে। ভুল না করে থাকলে ১১ নম্বর আসামি তিনি। মামলার বর্ণনায়ও ধর্ষণ অপরাধের দায়ে অফিসারকে চিহ্নিত করা হয়নি, তাকে একটি মামলা সম্পর্কিত বিষয়ে অসহযোগিতার কারণে দোষারোপ করা হয়েছে। অথচ অনেক পত্রিকায় শিরোনামটি এসেছে এভাবে যে ভদ্রলোক নিজেই মূল অথবা প্রথম আসামি! এটি আমার বিনীত অনুরোধ, ঘটনা যা তার ছোঁয়াই যেন শিরোনামে আসে, সেখান থেকে সরে যেয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলে তার দায়ও নির্দিষ্টজনের উপর বর্তায় বৈকি!

অফিসার আপনাকে বলছি, সঠিক ট্র্যাকে আছেন বলেই প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি আপনাকে হতেই হবে! ক্ষণিকের এই মেঘ অবশ্যই কেটে যাবে কিন্তু আপনি এবং মানুষের জন্য আপনার কাজ যেন থেমে না যায়, সেটি সবসময় মাথায় রাখবেন। আগামীর সূর্যরশ্মির আলোয় আলোকিত হয়ে থাকুন সবসময়…।

ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
লেখক:

Comments