যুদ্ধ করেছেন দেশের জন্য, তাই দেশ স্বাধীন হয়েছে এতেই খুশি ছিলেন মাছরুরা পারভীন নিউজ ডেস্ক নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ১২:২২ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১২, ২০১৯ উজ্জ্বল রায়, মাগুরার শ্রীপুর থেকে ফিরে: ‘বাবার নির্দেশে তার বড় দুই ভাই আলি মোর্তজা ও দৌলত মিয়া মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। একই সঙ্গে ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে করতে তিনিও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর নিজেও অংশ নেই স্ব-শরীরে’। বলছিলেন মাছরুরা পারভিন। একাত্তরে মাগুরার শ্রীপুরের খামার পাড়ায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। বাবা শাহাদত আলী মিয়া ছিলেন আইনজীবী ও মহকুমা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। যু্দ্ধ করেছিলেন দেশের জন্য। যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন এতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। ‘নিজের জন্য কখনো কিছু চাননি। ব্যক্তিস্বার্থের কথা চিন্তাও করেননি। এজন্য যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নিজের নাম উঠাতেও কোনো চেষ্টা বা যোগাযোগ করেননি কারো সাথে। শেষ বয়সে মনে হলো অন্তত নিজের সন্তানদের জন্য এই কাজটা করা উচিত’। মাছরুরা পারভিন মুক্তিযুদ্ধের সেই বীরত্বগাঁথা কাহিনী শোনালেন নিজ মুখে। যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন এই বীর নারী। আমরা তার মুখ থেকেই শুনবো সেই সফলতার গল্প। মাছরুরা পারভিন বলেন, যুদ্ধে গিয়ে যোগ দেই শ্রীপুরের আকবর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের দলে। বাবা ও মায়ের এ ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন থাকায় কাজটি আমার জন্য সহজ হয়ে যায়। সে সময় আমার সঙ্গে যোগ দেয় সদর উপজেলার রাউতড়া গ্রামের হাসিবা ও মাহফুজা নামে দুই বোন, শ্রীপুরের খামার পাড়ার আখিরন, টুপি পাড়ার লাইলি, আবালপুরের হাবিবা, শাইলি নামে অপর দু’বোন, দায়ের পোলের রাহেলাসহ আরো ৮টি মেয়ে। এদের মধ্যে কেউ কেউ মারা গেছে। আর কে কোথায় কী অবস্থায় আছে জানি না। তিনি আরো বলেন, আমরা নয়জন প্রথম অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিই। সে সময়কার স্থানীয় গেরিলা কমান্ডার গৌরি চরণপুরের মোকাদ্দেস হোসেনের কাছে। তিনি আমাদেরকে হাতে কলমে অস্ত্র চালানো শেখান। ট্রিগার টিপতে লেগেছিলো কয়েক সেকেন্ড। তবু অস্ত্র চালনায় দক্ষতা বাড়াতে টানা দু’মাস ধরে চলেছে আমাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। এ জন্য আমাদের বাড়ির পাশে একটি বাগানে টিন দিয়ে তৈরি করে দেয়া হয়েছিলো নিশানা। প্রথম দিন প্রত্যেকে ৪ রাউন্ড করে রাইফেলের গুলি ছুড়েছিলাম। তারপরে বুকের সাহস আরো বেড়ে গিয়েছিলো। প্রশিক্ষণ শেষ হলে আমাদের প্রত্যেককে পাক আর্মি ও রাজাকারদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য রেকি করার দায়িত্ব দেয়া হয়। আমরা ছেড়া কাপড় পরে পাগলের বেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি। এ সময় আমার কাছে আত্মরক্ষার জন্য সবসময় কোমরে একটি পিস্তল থাকতো। পিস্তল নিয়েই আমি রেকি করতাম। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পৌঁছে দিতাম পাক আর্মিদের গতিবিধির খবর। আমাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প বসার কারণে একদিন সকালে স্থানীয় রাজাকার ছালাম মুন্সি, কারী মিয়ার সহযোগিতায় পাক আর্মিরা আমাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। কিন্তু জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধারা এই বাড়িতেই তাদের ক্যাম্প চালিয়ে গেছে। ‘যুদ্ধের শুরুতে একদিন পাক বাহিনীর হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম। দিন তারিখ সুনির্দিষ্ট করে মনে নেই। তবে এটুকু স্মরণ আছে সময়টা ছিলো ভোরবেলা। আমি অজস্র তালি দেয়া একটা কাপড় পরে খামারপাড়ার একটি পুকুরে কাপড় ধোয়ার ছলে পাক বাহিনীর গতিবিধি নজর রাখছিলাম। শতাধিক পাক সেনার একটি গ্রুপ রাজাকারদের সহযোগিতায় হঠাৎ করেই ওই অঞ্চলে ঢুকে পড়ে। তারা আমাদের বাহিনী প্রধান মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন মিয়ার বাড়ি আক্রমণ করতে সেদিক দিয়ে যাচ্ছিলো। আমি হঠাৎ করেই তাদের সামনে পড়ে গেলে পাক সেনারা হাতে থাকা অস্ত্র আমার দিকে তাক করে। গুলি করার আগ মুহূর্তে তাদের সঙ্গে থাকা শ্রীপুর থানার ওসি উর্দূতে ‘ভুখা মুসলিম হায়’ বললে তারা অস্ত্র নামিয়ে আকবর হোসেন মিয়ার বাড়ির দিকে চলে যায়। আমি অন্য পথ দিয়ে দৌড়ে এলাকায় গিয়ে পাক সেনাদের আসার খবর দিই। যুদ্ধের সময় এরকম অসংখ্য ঝুঁকি নিতে হয়েছে আমাকে। শ্রীপুরের গয়েশপুর, টুপিপাড়া, খামারপাড়া, গাংনালিয়া, বরিশাট, দরিবিলা, দাইরপোল, মিনগ্রাম বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন বেশে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। আমার সঙ্গে কখনো একত্রে কথনোবা বিচ্ছিন্নভাবে অন্য মেয়েরা একইভাবে কাজ করে গেছে। আমরা সব সময় রেকি করার পাশাপাশি যেকোন মুহূর্তে রেকি করার পাশাপাশি সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে থাকতাম। আমাদের অধিনায়ক আকবর হোসেন মিয়ার নির্দেশে আমরা যুদ্ধের মাঝামাঝিতে সশস্ত্র অবস্থায় আলফাপুর মিনগ্রামের যুদ্ধে অংশ নিতে যাই। এ সময় আমাদের প্রত্যেকের কাছে বোল্ড একশন রাইফেল ছিলো। আমাদের বলা হয়েছিলো প্রথমে সেখানে গিয়ে সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। সেই সঙ্গে প্রয়োজনে যুদ্ধে অংশ নেয়া। ওই যুদ্ধে আমাদের অবস্থান ছিলো মিনগ্রামে। অন্যদিকে পাক আর্মিরা অবস্থান করছিলো আলফাপুরে। এই যুদ্ধে পাক সেনাদের ১৫ জন মত সদস্য মারা গিয়েছিলো। যার মধ্যে তিনটি লাশ সেখানে ছিলো। আক্রমনের মুখে অন্য লাশগুলো সাথে নিয়ে তারা দ্রুত পালিয়ে গিয়েছিলো। এ যুদ্ধ থেকে পাক সেনাদের ব্যবহৃত ২০টির মত অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। এটি আমাদের শক্তি ও সাহস আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলো। মাছরুরা পারভিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম দেশের জন্যেই। এ কারণে বিজয়ের পর ব্যক্তিস্বার্থে কারো কাছে হাত পাতিনি। এমনকি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠানোর জন্যে কোন প্রকার যোগাযোগ করিনি। তবে সন্তানদের কারণে কিছুদিন হলো তালিকাভূক্তির চেষ্টা করছি। যা এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বাহিনী প্রধান আকবর হোসেন মিয়া ও বর্তমান জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোল্যা নবুয়ত আলী এ ব্যাপারে আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছেন। পৃথকভাবে প্রত্যয়ন সনদ দিয়েছেন। /আরএ Comments SHARES বিশেষ প্রতিবেদন বিষয়: