অগ্নিকাণ্ড

ঢাকায় যত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

প্রকাশিত: ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৫, ২০২৩

সম্প্রতি রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেটে ভয়াভহ অগ্নিকাণ্ডের অপূরণীয় ক্ষাত না মুছতেই আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়েছে রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেট। মার্কেটের তৃতীয় তলায় আগুন ধরার পর তা দ্বিতীয় তলায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে মূল মার্কেটের কয়েকশ’ দোকান পুড়ে ছাই হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস সদস্য ও ব্যসায়ীরা।

রাজধানীতে এমন আগুনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। কিছুদিন পরপরই এমন অগ্নিকাণ্ড ঘটে। কিছু কিছু অগ্নিকাণ্ড সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আবার কোনো কোনো অগ্নিকাণ্ড ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। ক্ষতিও হয় অসামান্য। গত ১৫ বছরে ঢাকায় বেশ কিছু ভয়াভহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। একনজরে দেখে নেই সেসব দুর্ঘটনার খতিয়ান :

চলতি বছরের ২৭ মার্চ রাজধানী ঢাকার দুটি স্থানে আগুন লাগে। প্রথমত, মহাখালীতে সাততলা বস্তিতে আগুন লেগে বেশ কয়েকটি ঘর পুড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, কাপ্তানবাজারের জয়কালী মন্দির সংলগ্ন সুইপার কলোনিতে আগুন লাগে। এতে দগ্ধ হন চারজন।

এর আগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। তার আগে ১৯ ফেব্রুয়ারি গুলশানের একটি ১২তলা আবাসিক ভবনে আগুনের ঘটনায় দুজন নিহত হন।

২০২২ সালের ১৯ নভেম্বর উত্তরার ৮ নম্বর সেক্টরের একটি বস্তিতে আগুন লাগে। এর আগে ৪ সেপ্টেম্বর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার একটি মসজিদে। মসজিদের ভেতর জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়।

একই বছরের ২৭ মে গুলশান-২-এর ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আগুনের ঘটনায় পাঁচজন মারা যান। তার আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি নিউ ইস্কাটনের দিলু রোডের একটি পাঁচতলা ভবনের গ্যারেজে অগ্নিকাণ্ডে শিশুসহ নিহত হন তিনজন। এর আগে ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনানীর টিঅ্যান্ডটি কলোনি বস্তিতে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ২২টি ইউনিট কাজ করে ওই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বস্তির সব ঘর পুড়ে যায়।

২০২১ সালের ১৭ মার্চ ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে অগ্নিকাণ্ডে রোগী সরানোর সময় তিনজন নিহত হন।

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। রাত পৌনে ১১টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে একাধিক বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। জানা যায়, সেখানে কেমিক্যালের গোডাউন থাকায় আগুন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এ ঘটনায় ৭০ জন নিহত হন। আহত হন অনেকে।

একই বছরের ৩০ মার্চ ভোরে আবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ভোর ৫টা ৪৮ মিনিটে মার্কেটের কাঁচাবাজারের পূর্ব পাশে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট প্রায় আড়াই ঘণ্টা চেষ্টার পর সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

ওই বছরের ২৮ মার্চ রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটের দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে ২৫ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন প্রায় ৭০ জন। ফায়ার সার্ভিস, সেনা, নৌ, বিমান এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ছয় ঘণ্টা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর হাজারীবাগের বউবাজার বস্তিতে লাগা আগুনে প্রাণ হারান ১১ জন। এর আগে ১২ মার্চ রাজধানীর পল্লবীর ইলিয়াস আলী মোল্লা বস্তিতে আগুন লাগে। এতে বস্তির প্রায় ৫ হাজার ঘরের সব পুড়ে যায়। এ ছাড়া মাঝে মাঝেই বস্তিগুলোতে অগ্নিকাণ্ড ঘটতে থাকে।

২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি ভোরবেলা গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে মার্কেটটির বহু দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এরপর অস্থায়ীভাবে দোকান তৈরি করে মার্কেটটি চালু করা হয়।

একই বছরের ১৫ মার্চ দিবাগত রাত ২টা ৫০ মিনিটে মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে বহু ঘর পুড়ে যায়। নিঃস্ব হয়ে যান হাজার হাজার বস্তিবাসী।

২০১৬ সালের ৫ অক্টোবর হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ সংলগ্ন শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে বউবাজার বস্তিতে আগুনে পুড়ে যায় ৫০টি ঘর।

২০১৩ সালের ২৮ জুন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে স্মার্ট এক্সপোর্ট গার্মেন্টস লিমিটেডে আগুনে পুড়ে সাত নারী পোশাকশ্রমিক নিহত হন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্টসগুলোতে আগুন লাগার খবর পাওয়া যায়।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান তাজরীন ফ্যাশনে আগুনের ঘটনায় ১১১ জন নিহত হন। ঢাকা মহানগরীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় ভয়ানক এ দুর্ঘটনায় ৯ তলা ভবনের ছয়তলা ভস্মীভূত হয়ে যায়। এতে সরাসরি আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান ১০১ জন পোশাকশ্রমিক। আগুন থেকে রেহাই পেতে ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যু হয় আরও ১০ জনের।

একই বছর গরীব অ্যান্ড গরীব গার্মেন্টসে লাগা আগুনে নিহত হন ২১ জন। এ ছাড়া হামীম গ্রুপের একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ২৯ জনের প্রাণহানি ঘটে।

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর নবাব কাটরায় রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত হন নারী ও শিশুসহ ১২৪ জন। নিমতলীর ৪৩ নম্বর বাড়িতে রাত ৯টায় ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ঘটনার সময় ছয়তলা বাড়ির নিচতলায় দুই বোন রুনা আর রত্না এবং পাশের বাড়িতে আসমা নামে এক মেয়ের বিয়ের আয়োজন চলছিল। কনেরা পার্লারে সাজছিলেন। আর বাড়ির নিচতলায় রান্না চলছিল। রান্নার জায়গার পাশেই ছিল কেমিক্যালের গুদাম। প্রচণ্ড তাপে গুদামে থাকা কেমিক্যালের প্লাস্টিক ড্রাম গলে যায়। এরপর মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে দরজা-জানালা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

২০০৯ সালের ১৩ মার্চ বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লাগে। এতে প্রাণহানি না ঘটলেও পুরো ঢাকা শহরকে নাড়িয়ে দিয়েছিল তীব্রভাবে।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে রাজধানী ঢাকা শহরেই দুই হাজার ৮৮টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া পৃথিবীতে অগ্নিদুর্ঘটনায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহর ঘোষণা করা হয়েছে ঢাকাকে।

সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিল ভোরে রাজধানীর বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে আশপাশের চার-পাঁচটি মার্কেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী আগুনে পুড়েছে প্রায় পাঁচ হাজার দোকান। ক্ষতি হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার। পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয় সিগারেট বা কয়েলের আগুনে পুড়েছে বঙ্গবাজার মার্কেট।

এরপর গত ১৪ এপ্রিল রাজধানীর নবাবপুরে টিনশেড গোডাউনে লাগা আগুন দুই ঘণ্টায় নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। আগুনে প্রায় ২০টি গুদাম পুড়ে ছাই হয়। ওইখানে কর্মচারীদের মেস থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে ধারণা করেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।

আজ শনিবার ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। এরপর একে একে ১৮টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ শুরু করে। পরে পাঁচটি ইউনিট যোগ দেয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় আরো ৫টি ইউনিট যোগ দেয়। সর্বশেষ ২৮টি ইউনিট কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

/এসএস/মনেরখবর/

Comments