অবশেষে মিন্নিকে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট

প্রকাশিত: ২:৩৬ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৯, ২০১৯

বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে জারি করা রুল মঞ্জুর করে রায় দেন।

বুধবার (২৮ আগস্ট) তার জামিন প্রশ্নে রুলের ওপর শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার রায়ের জন্য এদিন ধার্য করা হয়।

বুধবার আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসাইন বাপ্পী।

এ সময় আদালত কক্ষে থাকা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনসরুল হক চৌধুরী জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন।

শুনানিতে আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, কিছু দিন আগে (মিন্নির) বিয়ে হয়। তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। সে একজন নারী। পুলিশ বলছে, তদন্ত শেষ পর্যায়ে। তাই জামিন চাইছি। জামিন দিলে তদন্ত বাধাগ্রস্ত করা কোনো সুযোগ নেই।

নয়ন বন্ডের সঙ্গে টেলিফোনে মিন্নির কথোপকথনের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগে বিষয়ে এ আইনজীবী বলেন,পত্রিকায় এসেছে, নয়ন বন্ডের সঙ্গে পুলিশের ৭৭ বার কথা হয়েছে। একজন এসআই আসাদের সঙ্গে ১০১ মিনিট ২৪ সেকেন্ড কথা হয়েছে নয়ন বন্ডের। নয়ন বন্ড তো পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের সৃষ্টি। অথচ এখন সেই দোষ আমাদের ওপর চাপানো হচ্ছে।

তিনি বলেন, মামলার এজাহারভুক্ত সব আসামিকে এখনো গ্রেফতার করেনি পুলিশ। অথচ মিন্নিকে নিয়ে তাদের যত তোড়জোড়।

এ আইনজীবী শুনানিকালে রিফাতকে কোপানোর ভিডিও ফুটেজ আদালতে দাখিল করে বলেন, এই ভিডিও ফুটেজ পুলিশ ১১টি খণ্ডে ভাগ করেছে। সিসিটিভি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। সেই ফুটেজ কীভাবে ভাইরাল ও প্রচার হলো? এটা একটা অপরাধ। এজন্যতো তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, এটা স্পর্শকাতর মামলা। তার স্বামীকে কুপিয়ে আহত করার পর সে (মিন্নি) নয়ন বন্ডের সঙ্গে মোবাইলে পাঁচ বার কথা বলেছে। ঘটনার আগে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নয়ন বন্ডের সঙ্গে ৮ বার কথা বলেছে। এটা কি প্রমাণ করে না যে সে জড়িত? তিনি বলেন, সেই ষড়যন্ত্রকারী।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনসুরুল হক চৌধুরীর বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা বললেন, তদন্ত শেষ পর্যায়ে। টিভিতে দেখেছি, মিন্নির বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত করার অভিযোগ নেই।

তিনি বলেন, মেয়েটির বয়স কম। বলা হচ্ছে ১৯ বছর। ভালোভাবে পরীক্ষা করলে হয়তো দেখা যাবে ১৮ বছরের কম। তাছাড়া মেয়েটি তার স্বামীকে হারিয়েছে। তাই এ পর্যায়ে তাকে জামিন দিলে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করি না।

শুনানিতে আদালত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক হুমায়ুন কবিরের বক্তব্য জানতে চান। জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত শেষ পর্যায়ে। আজ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু হাইকোর্টে আসার কারণে তা দেওয়া যায়নি।

আদালত তার কাছে জানতে চান, নয়ন বন্ড নামের আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে কি-না? জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তাকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান পরিচালনা করা হয়। সন্ত্রাসীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। তাই তাকে গ্রেফতার করা যায়নি।

এ সময় আদালতের দুই বিচারপতি মামলার সিডি (কেস ডকেট) দেখেন। এরপর তা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে দেখতে বলেন।

মামলার সিডি দেখার পর আদালত বলেন, এটা কি দেখে মনে হয় যে মিন্নি দোষ স্বীকার করেছে? আমরা তো দেখছি যে সব এড়িয়ে গেছে। জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, প্রাথমিকভাবে দোষ স্বীকার করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়।

আদালত বলেন, আপনার দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন। মিন্নি ঘটনায় দোষ স্বীকার করেছে কি-না? এসপি সাহেব বলছেন, করেছে। মিন্নি স্বীকার করেছে বলে তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন।

আদালত বলেন, যত বড় জায়গা, যত বড় দায়িত্ব, তাকে ততটা সচেতন থাকতে হয়।

এর আগে ২০ আগস্ট এক সপ্তাহের রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট।

একইসঙ্গে ২৮ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে সিডি (কেস ডকেট) নিয়ে হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়। এছাড়া মিন্নির সংশ্লিষ্টতার বিষয় জানিয়ে করা সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে পুলিশ সুপারকে (এসপি) লিখিত ব্যাখ্যা দিতেও বলা হয়।

সে অনুসারে তদন্ত কর্মকর্তা কেস ডকেট নিয়ে হাজির হন।

গত ৮ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে ঘণ্টাব্যাপী শুনানি শেষে জামিন প্রশ্নে রুল জারি করতে গেলে আইনজীবীরা আবেদন ফেরত নেন।

এরপর ১৮ আগস্ট (রোববার) উক্ত বেঞ্চে জামিন আবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। পরদিন সোমবার এ বিষয়ে আংশিক শুনানি হয়।

তার আগে গত ৫ আগস্ট (সোমবার) মিন্নির জামিন আবেদনের কথা জানিয়েছিলেন জেড আই খান পান্না।

২৬ জুন প্রকাশ্য দিবালোকে বরগুনা সরকারি কলেজ রোডে স্ত্রী মিন্নির সামনে কুপিয়ে জখম করা হয় রিফাত শরীফকে। পরে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত নয়ন বন্ড ২ জুলাই ভোরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। এর মধ্যে মামলার অন্য আসামিদেরও গ্রেফতার করা হয়।

১৬ জুলাই সকালে বরগুনার মাইঠা এলাকায় বাবার বাসা থেকে মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বরগুনার পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রিফাত হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় ওই দিন রাত ৯টার দিকে মিন্নিকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ।

পরদিন ১৭ জুলাই বিকেলে মিন্নিকে আদালতে হাজির করে সাত দিন রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। বিকেল সোয়া ৩টার দিকে শুনানি শেষে বরগুনার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সিরাজুল ইসলাম গাজী পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ওইদিন মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।

রিমান্ডের দ্বিতীয় দিন ১৯ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে বরগুনা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সিরাজুল ইসলাম গাজীর আদালতে মিন্নি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।

২২ জুলাই বরগুনার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রথমবার মিন্নির জামিনের আবেদন করেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. মাহবুবুল বারী আসলাম। ওই দিনই শুনানি শেষে আদালতের বিচারক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম গাজী তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন।

এরপর ২৩ জুলাই মিস কেস দাখিল করে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আসাদুজ্জামানের আদালতে ফের জামিনের আবেদন করেন মিন্নির আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. মাহবুবুল বারী আসলাম। পরে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নথি তলব করে ৩০ জুলাই এ জামিন শুনানির দিন ধার্য করেন আদালত। শুনানির পর আদালত জামিন আবেদন নাকচ করেন।

আরএম/

Comments