ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান: যশোর লাইফ কেয়ারে ভয়াবহ প্রতারণার চিত্র

প্রকাশিত: ১০:১৪ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৯, ২০১৯

বিল্লাল হোসেন,যশোর প্রতিনিধি: যশোর শহরের দড়াটানার লাইফ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভয়াবহ প্রতারণার চিত্র ধরা পড়েছে। যেন সকল প্রকার অনিয়ম ও প্রতারণাকে পিছনে ফেলে বাণিজ্য চালাচ্ছেন লাইফ কেয়ারের সাথে সংশ্লিষ্টরা।

সোমবার দুপুরে যশোর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমান আদালত সেখানে অভিযানে গেলে এই চিত্র ধরা পড়ে। নাম সবস্ব এই প্রতিষ্ঠানকে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের বহিঃবিভাগ পরিচয়ে ভাগিয়ে আনা রোগীদের সাথে কথা বলে নিজেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন নির্বাহী ম্যাজিস্টেট। পরে ভ্রাম্যমান আদালত লাইফ কেয়ারকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।

চিকিৎসাসেবার নামে ২০ জন রোগীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া টাকা তাদের টাকা ফেরত দেয়া। ক্যাশ ড্রয়ারে থাকা নগদ ৮ হাজার টাকা জব্দ করে ভ্রাম্যমান আদালত। অভিযানের সময় লাইফ কেয়ার থেকে বিক্রয়ের জন্য প্রযোজ্য না যৌন কাজে ব্যবহৃত ১০টি জি লুব্রিকেটিং জেল, ওষুধ ছাড়াই পরীক্ষা নিরীক্ষা লেখা একাধিক ব্যবস্থাপত্র উদ্ধার হয়। এর আগে ভ্রম্যমান আদালত যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল চত্বরে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের ৪ দালালকে আটক করে ২০ দিনের বিনাশ্রম কারাদন্ড দিয়েছেন।

তারা হলেন যশোর শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোডের শরিফুজ্জামানের ছেলে রকিবুজ্জামান ওরফে সাচ্চু, যশোর রেলগেট এলাকার ইস্রাফিল শেখের ছেলে রুবেল শেখ,সদর উপজেলার পুলেরহাট গ্রামের হায়দার আলীর ছেলে মনিরুজ্জামান মনির ও শেখহাটি পূর্ব পাড়ার জোবায়ের হোসেনের ছেলে জাফর হোসেন। এছাড়া বখশিষ বাণিজ্যের সময় হাসপাতালের জনগোষ্টি সহায়তার কর্মচারী আখতারকে টাকাসহ আটকের পর কর্তৃপক্ষের কাছ সোপর্দ করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভ্রাম্যমান আদালতের পেশকার জালাল উদ্দিন।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নুরুল ইসলাম জানান, যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের প্রথম গেটের গা ঘেষেই অবস্থিত লাইফ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটির মালিক লাইলী ইয়াসমিন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি করেন ডা. মনির হাসান। এখানে প্রতারণার ফাঁদ পেতে পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ নানা অজুহাতে রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। জেনারেল হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারের সামনে থেকে শুরু করে লাইফ কেয়ারের গেট পর্যন্ত পোষ্য দালালের বিচরণ থাকে।

দালাল একজন আরেকজনের হাতে রোগীদের তুলে দেয়। দালালরা রোগী ও স্বজনদের বলে থাকে সেটি জেনারেল হাসপাতালের বহিঃবিভাগের একটি অংশ। হাসপাতালের ২, ৪, ৬ ও ৭ নম্বর কক্ষ ওই ভবনে। সেখানে ডাক্তার রোগী দেখছেন। আর রোগীরা বিশ্বাস করে সেখানে চলে যাচ্ছে। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে লাইফ কেয়ারে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানের সময় ভয়াবহ এই প্রতারণার সত্যতা মিলেছে।

এসময় দেখা যায় সরকারি টিকিট হাতে একাধিক রোগী সেখানে অপেক্ষা করছেন। রোগীদের কাছ থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বলে জানতে পারে আদালত। তখন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ৮ হাজার টাকা ফেরত নিয়ে প্রতারিত রোগীদের বুঝে দেয়া।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরো জানান, এটি ডায়াগনস্টিক সেনটার হলেও চিকিৎসকের প্যাডে হাসপাতাল লিখে প্রতারিত করা হচ্ছিলো।

এছাড়া পর্যাপ্ত চিকিৎসক , সেবিকা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, প্যাথলজি পরীক্ষায় অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগে ভোক্তাধিকার আইন ২০০৯ এর ৫৩ ধারায় লাইফ কেয়ারকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। অভিযানে যশোর কোতয়ালি মডেল থানার ওসি (অপারেশন) সামসুজজোহা, শহরের পুরাতন কসবা ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর শিহাবুর রহমানসহ পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

কথা প্রসঙ্গে প্রতারিত রোগী যশোর সদর উপজেলার ওসমাপুর গ্রামের নওশের আলীর ছেলে মনিরুল ইসলাম জানান, তিনি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসলেও এক যুবক তকে এখানে ডেকে আনেন। তাকে বলা হয় এটা হাসপাতালের আকেটি কক্ষ । পরে চিকিৎসা ফিস বাবদ ২শ ও পরীক্ষা নিরীক্ষা বাবদ ১৫শ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। একই গ্রামের ইদ্রিস আলীর স্ত্রী রেশমা একই কথা জানিয়ে ১৪শ টাকা হাতিয়ে নেন লাইফ কেয়ার কর্তৃপক্ষ। যশোরের চৌগাছা উপজেলার শাহাজাদপুর গ্রামের আমির আলীর স্ত্রী ফরিদা জানান, সদর হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারের সামনে থেকে তাকে ধোকা নিয়ে এখানে আনা হয়েছে।

তিনি সরল মনে এখানে আসার পর নানা অজুহাতে ১১শ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এই প্রতারকদের ফাঁদে পা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলাম। হাতিয়ে নেয়া টাকা ফেরত পেয়ে তারা খুঁশি। এদিকে এরআগেও যশোরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত লাইফ কেয়ারে অভিযান চালায়।

এসময় ভ্রাম্যমান আদালত দেখতে পান, বিভিন্ন মেডিকেল টেস্টের জন্য নির্ধারিত ফিস/মূল্যের প্রদর্শিত তালিকা নেই। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ মূল্য/ফিস আদায় করা হয়। এই অভিযানে পাওয়া যায় একজন ডাক্তারের স্বাক্ষরিত মেডিকেল টেস্ট রিপোর্টের প্রায় ২শ’ খালি পাতা। যা পরবর্তীতে রোগীদের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়ন ছাড়াই হসপিটাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের ইচ্ছামতো রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেন। আর্থিক জরিমানার পরও লাইফ কেয়ারের প্রতারণা থামেনি। সচেতন মহলের দাবি এই অবিযানের পরও প্রতারণা চললে লাইফ কেয়ার সিলগালা করা হোক।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার হিসেবে লাইফ কেয়ারের অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৮৩৮৩। বর্তমানে সেখানকার সাইনবোর্ড ও ব্যবস্থাপত্রে ডায়াগনস্টিকের আগে হসপিটাল লিখে কার্যক্রম প্রতারণা জোরদার করা হয়েছে।

বাস্তবে হসপিটালের কোন কার্যক্রম নেই। হসপিটালের কার্যক্রম চালুর বিষয়ে অনুমোদনও নেয়া হয়নি। বরং ডায়াগনস্টিকের লাইসেন্স মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাও নবায়ন করা হয়নি। এটি একটি নাম সর্বস্ব স্বাস্থ্য প্রতষ্ঠান।

এখানে নেই বিশেষ চিকিৎসক, ডিগ্রিধারী সেবিকা, মেশিনারীজ, প্যাথলজিস্ট, ল্যাব, টেকনিশিয়ান, শয্যা ও কেবিন। যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে আসা রোগীর উপর ভর করে লাইফ কেয়ার খুলে প্রতারণা করা হচ্ছিলো। এই বিষয়ে ৪ জুলাই বিভিন্ন পত্রিকায় অনুসন্ধানী সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই দিন যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় প্রতিবেদনটি নিয়ে জোরালো আলোচনা হয়েছিলো।

Comments