ভিআইপি প্রটোকলে চলতেন যুবলীগ নেতা জিকে শামীম

প্রকাশিত: ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯

নাম গোলাম কিবরিয়া শামীম হলেও জিকে শামীম নামে তিনি সর্বজন পরিচিত। তিনি মন্ত্রী না হয়েও চলতেন ভিআইপি প্রটোকলে। তার দাপটে এবং নির্দয় ব্যবহারে সবুজবাগ- বাসাবো এবং গুলশান নিকেতনের মানুষ ছিলো অতিষ্ঠ।

তার আয়েশী জীবন যাপন সম্পর্কে এলাকাবাসী বলেন, যুবদল নেতা জি কে শামীম কমান্ডো স্টাইলে গাড়িবহর নিয়ে সাইরেন বাজিয়ে চলাফেরা করতেন। সরকারের মন্ত্রীরা যেভাবে যাওয়া আসা করে আগে পিছে পুলিশ নিয়ে। তিনিও কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীতে অন্তত ২০ জন গানম্যান পরিবেষ্টিত হয়ে চলাফেরা করতেন। সঙ্গীয় ওই ২০ জন ছাড়াও শটগানসহ সাতজন বিশালদেহী বডিগার্ড সার্বক্ষণিক সঙ্গে থাকত তার। রাস্তায় শামীমের গাড়িবহরের আগে-পিছে ২০-২৫টি মোটরসাইকেল থাকতো।

স্থানীয়রা জানান, বনানীর ডিওএইচএসে বিলাসবহুল বাড়িতে থাকতেন শামীম। শামীমের গাড়ির সামনে থাকত তিনটি মোটরসাইকেলে ছয় দেহরক্ষী। সামনে-পিছে আরও দুটি কালো রঙের জিপ গাড়ি। এসব গাড়িতে বাজতো সাইরেন। শুধু তাই নয়, জি কে শামীমের বিষয়ে মানুষ আতঙ্কিত । কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না। আর খুলবেনই বা কোন সাহসে, যখন দেখেন শামীম চলছেন অস্ত্রধারী ক্যাডার বাহিনী নিয়ে। যার গাড়ির আগে-পিছে থাকে ক্যাডারদের গাড়ি। তবে তার ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি নন গৃহায়ণ ও গণপূর্তের কোনো ঠিকাদার।

অপরদিকে নিকেতনের জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড ভবনের পাশের ভবনের কেয়ারটেকার বলেন, ‘ষোলআনা রাজকীয় স্টাইলে ভিআইপি আদলে চলতেন জিকে শামীম। তিনি যখন এখানে আসতেন, তার গাড়ির  ভিআইপি হর্ন ও সিকিউরিটিদের হাক-ডাকে সবাই টের পেয়ে যেত। অন্য মানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে যেত। শামীম সাহেব গাড়ি যখন এখানে আসতেন তখন ভয়ে কেউ রাস্তায় বের হতো না। অফিসের সামনে গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রসহ দেহরক্ষীরা তার চারদিকে ঘিরে রাখত। প্রতিদিনই সিনেমাকে বাস্তবে দেখতাম আমরা’।

তিনি আরও বলেন, একবার শামীমের গাড়ি আসার সময় আমাদের এক স্যারের গাড়ি গ্যারেজ থেকে বের হয়ে অর্ধেক রাস্তায় চলে গিয়েছিল। কিন্তু শামীমের দেহরক্ষীরা আমাদের সেই গাড়িকে জোরপূর্বক আবার গ্যারেজে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করে। শামীম চলে যাওয়ার পর আমাদের গাড়ি বের হয়। এ সকল বাড়তি শক্তি খাটানো এবং নির্দয় আচরণে এলাকার অন্যান্য লোকজন অসন্তুষ্ট রয়েছে।

গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কিংবা যুবলীগের পার্টি অফিস, বিয়ে বাড়ি কিংবা বন্ধুর বাড়ি, যেখানেই তিনি যান, সঙ্গে  থাকে অস্ত্রধারী বাহিনী। ভারী অস্ত্র নিয়ে ছয়জন নিরাপত্তারক্ষী আগে-পিছে পাহারা দিয়ে তাকে নিয়ে যান। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন জি কে শামীম।

বাসাবোর একাধিক বাসিন্দা জানান, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সন্মানদী ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়া গ্রামের মৃত মো.আফসার উদ্দিন মাস্টারের ছেলে শামীম। আফসার উদ্দিন মাস্টার ছিলেন হরিহরদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিন ছেলের মধ্যে জি কে শামীম মেজো। বড় ছেলে গোলাম হাবিব নাসিম ঢাকায় জাতীয় পার্টির রাজনীতি করেন। সন্মানদী ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানান, প্রাইমারি স্কুল ও হাই স্কুল পাস করার পর তাদের গ্রামে দেখা যায়নি। ঢাকার বাসাবো আর সবুজবাগ এলাকায় বড় হয়েছেন। গত জাতীয় নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচনের জন্য প্রচারণাও চালিয়েছিলেন শামীম।

বাসাবো ও এজিবি কলোনির কয়েকজন বাসিন্দা জানান, গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পর এজিবি কলোনি, হাসপাতাল জোন এবং মধ্য বাসাবোতেই পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন শামীম। ৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের মাধ্যমেই তার রজনীতি শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে মির্জা আব্বাসের ভাই মির্জা কালু ও মির্জা খোকনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় এবং তাদের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে গণপূর্ত ভবনের ঠিকাদারি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। ঢাকা মহানগর যুবদলের সহ-সম্পাদকের পদও বাগিয়ে নেন। বিএনপি আমলে গণপূর্ত ভবন ছিল তার দখলে। ওই সময়ে শামীম ছাড়া গণপূর্তে অন্য কারো কাজ পাওয়ার সুযোগ ছিল না।

বাসাবো এলাকায় পাঁচটি বাড়ি এবং একাধিক প্লট রয়েছে শামীমের। বাসাবোর কদমতলায় ১৭ নম্বরের পাঁচতলা বাড়িটি জি কে শামীমের। এই বাড়ির ম্যানেজার হিসেবে দেখাশোনা করেন স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. ইসমাইল হোসেন সর্দার। শামীম কয়েক বছর বাসাবোর ওই বাড়িতে বসবাস করলেও এখন থাকছেন বনানীর ওল্ড ডিওএইচএসে নিজের ফ্ল্যাটে। নিজের কার্যালয় বানিয়ে বসেন নিকেতন এলাকায় একটি ভবনে। বাসাবোতে আরো রয়েছে তিনটি ভবন এবং ডেমরা ও দক্ষিণগাঁও ছাড়াও সোনারগাঁ উপজেলা, বান্দরবান ও গাজীপুরে কয়েক শ বিঘা জমি কিনেছেন তিনি।

প্রসঙ্গত, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক মামলায় আলোচিত যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এর মধ্যে অস্ত্র মামলায় পাঁচদিন ও মাদক মামলায় পাঁচদিন। এছাড়া সাত দেহরক্ষীকে অস্ত্র মামলায় চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। সাত দেহরক্ষী হলেন- দেলোয়ার হোসেন, মুরাদ হোসেন, জাহিদুল ইসলাম, সহিদুল ইসলাম, কামাল হোসেন, সামসাদ হোসেন ও আমিনুল ইসলাম।

শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজধানীর গুলশানের নিকেতনের অফিসে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে র‌্যাব। অভিযানে এক কোটি ৮০ লাখ নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ১৬৫ কোটি টাকার ওপরে এফডিআর (স্থায়ী আমানত) পাওয়া যায়, যার মধ্যে তার মায়ের নামে ১৪০ কোটি ও ২৫ কোটি টাকা তার নামে। পাওয়া যায় মার্কিন ডলার, মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্র।

Comments