১২৭ কোটি টাকা নিয়ে দুই ব্যবসায়ী উধাও, খাতুনগঞ্জে স্থবিরতা

প্রকাশিত: ৩:৪৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৪, ২০১৯
খাতুনগঞ্জ বাজার, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: দেশে ভোগ্য পণ্যের সবচেয়ে বড় আড়ৎ হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ এবং ঢাকার মৌলভী বাজারের ব্যবসায়ীদের ১২৭ কোটি মেরে লাপাত্তা হয়ে গেছেন দুই ব্যবসায়ী।

জানা যায়, খাতুনগঞ্জের মেসার্স সফি ট্রেডার্সের মালিক শাহ জামাল ৫৭ কোটি টাকা ও ঢাকার মৌলভী বাজরের দেলোয়ার হোসেন ৭০ কোটি টাকা পাওনা রেখে লাপাত্তা হন। দুইজনই চিনি ব্যবসায়ী। রমজানের বাজারে এর প্রভাব পড়বে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। এই প্রতারণার ঘটনায় খাতুনগঞ্জে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিশ্বাসে চিড় ধরায় বাকি লেনদেন বন্ধ হয়ে পড়েছে।

খাতুনগঞ্জের জেনারেল মার্চেন্ট কমিশন এজেন্ট ও চিনির বড় ব্যবসায়ী মেসার্স সফি ট্রেডার্সের মালিক শাহ জামাল গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে উধাও হয়ে যান। উধাও হয়ে যাওয়ার পর পাওনাদাররা দোকান ও খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ড্রাস্টিজ এসোসিয়েশন কার্যালয় ভিড় করেন। সমিতির নেতৃবৃন্দ এবিষয়ে সমঝোতার চেষ্টা করেছিল। দুই মাস ভারতে আত্মগোপনে থাকার পর দেশে ফিরে আসেন।

গত ২০ মার্চ খাতুনগঞ্জ ট্রেড এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ পাওনাদার ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে সমঝোতা বৈঠক করেন। শাহ জামালও কিছু টাকা পরিশোধ করার সম্মতি দেন। বাকি টাকা পরিশোধের জন্য ৩-৪ বছর সময় চান। কিন্তু পরদিন দোকান বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে যান। এরপর থেকে ব্যবসায়ী মহলে ফের তোলপাড় শুরু হয়। বাকিতে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগীর আহমদ বলেন, ‘সমিতির কার্যালয়ে সমঝোতা বৈঠক করেছিলাম। কিন্তু তিনি এখন অস্ট্রেলিয়া পালিয়ে গেছেন। এখন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে’।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এবিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিছু টাকা জমাও দিয়েছেন। কিন্তু পাওনাদার মধ্যে এখনো পরিশোধ করা হয়নি। বাজারে এর প্রভাব পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, টাকা মেরে লাপাত্তা হওয়ার ঘটনায় খাতুনগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব নেমে আসছে।

গতকাল বুধবার খাতুনগঞ্জ ঘুরে দেখা যায়, ২১৩ খাতুনগঞ্জ মেসার্স সফি ট্রেডার্স বন্ধ রয়েছে। দোকানে তিনটি তালা ঝুলছে। একটি তালা লাল কস টেপ দিয়ে মোড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ব্যবসায়ী, আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী সমিতির অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয়। তবে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি হননি তারা। একটি মহল ঘটনাটি চেপে রাখার চেষ্টা করেছিল বলে অভিযোগ অনেক ব্যবসায়ীরা। এখন লাপাত্তা হওয়ার তোলপাড় শুরু হয়েছে।

জানা যায়, লাপাত্তা ব্যবসায়ী শাহ জামালের গ্রামের বাড়ি পটিয়ার জিরি এলাকায়। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য করে আসছেন। বিশেষ করে প্রস্তুতকারক চিনি ও চিনির ডিও ব্যবসা করেন তিনি। চট্টগ্রাম এবং ঢাকার বড় গ্রুপের চিনি ব্যবসা করতেন তিনি।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫৭ কোটি টাকার মধ্যে ৪৫ জন পাওনাদার সমিতিতে দাবি আবেদন করেছেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য পাওনাদারের মধ্যে আলম ট্রেডিং সাড়ে নয় কোটি টাকা, মীর গ্রুপের হাজি মীর আহমদ সওদাগর সাত কোটি টাকা, হাজি মুনির আহমদ সওদাগর মধ্যম চাক্তাইয়ের এক ব্যবসায়ীর ৪ কোটি টাকা। অন্যদের তালিকা পাওয়া যায়নি।

ব্যবসায়ী জানান, খাতুনগঞ্জের ব্যবসা ও লেনদেন হচ্ছে চেইনের মতো। একজন আরেকজনের ওপর নির্ভরশীল। একটি পক্ষ মার খেলে আরও কয়েকটি পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর প্রভাব পড়ে।

জানা যায়, শাহ জামালের এক ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করেন। লাপাত্তা হওয়ার আগে ছেলেকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। তারপর নিজস্ব ভূমিতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, খাতুনগঞ্জ শেখ মার্কেট, দেওয়ান বাজার নিজস্ব ভবনসহ সহায়-সম্পত্তি স্ত্রী ও সন্তানদের নামে দানপত্র করে দেন। এরপর ছেলেকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান।

ঢাকার মৌলভী বাজারের বড় ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেনও গত সপ্তাহে উধাও হয়ে যান। তার কাছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের অনেক আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী পণ্য সরবরাহ করতেন। তিনিও চিনি ব্যবসায়ী ছিলেন। ১০ জন বড় ব্যবসায়ী তার কাছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিসমিল্লাহ গ্রুপের জামাল উদ্দিনের পাওনা প্রায় ১৯ কোটি টাকা।

লাপাত্তা হওয়া দুই ব্যবসায়ীর পাওনার টাকার পরিমাণ খাতুনগঞ্জ ট্রেড এসোসিয়েশন ও ব্যবসায়ী সূত্রে পাওয়া তথ্য। পাওনার পরিমাণ সামান্য হেরফেরও হতে পারে।

গত বছরের মার্চ মাসেও দুই ব্যবসায়ী লাপাত্তা হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হন তারা। দুইজনই ছিলেন মসলা পণ্য ব্যবসায়ী। অবশ্য পরবর্তীতে অর্জুন স্টোরের মালিক অর্জুন চন্দ্র পাল ফিরে আসেন। ব্যবসা চালু করে পাওনাদারদের মধ্যে কিছু টাকা পরিশোধ করেন। তবে এক আড়তদারের গুদামে পণ্য রাখতেন অর্জুন। সেই গুদামদার বেশির ভাগ পণ্য নিজের আয়ত্বে নিয়ে যাওয়ায় ফতুর হয়ে যান অর্জুন।

এবিষয়ে থানায় মামলা-মোকাদ্দমা পর্যন্ত হয়েছিল। আর ওরাকল ট্রেডিংয়ের মালিক রায়হান বিল্লাহ লাপাত্তা থাকায় কয়েক কোটি টাকার লোকসান গুনতে হয় পাওনাদারদের।

দেশের ভোগ্যপণ্যের বড় বাজার খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের গোড়াপত্তন থেকে মুখের বিশ্বাসে কোটি কোটি টাকার লেন-দেন হয়ে আসছে। কিন্তু ১৯৮৩ সাল থেকে টাকা মেরে প্রতারণার ঘটনা শুরু হয়। এরপর থেকে বিশ্বাসের লেনদেনের চিড় ধরে। প্রতারণা ও লাপাত্তার ঘটনায় ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসে।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পাওনাদার মধ্যে থেকে সাতজনের (ঢাকার একজন ও খাতুনগঞ্জের ছয়জন) একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা প্রায় ১২ কোটি টাকা আদায় করেছেন। এখন তিনি তো পালিয়ে গেছেন। বাকি টাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন পাওনাদাররা।

/আরএ

Comments