১৩৩ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর

প্রকাশিত: ১১:১৯ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৪, ২০১৯

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: আড়াই হাজার বছরের পুরনো চট্টগ্রাম বন্দর। সেই থেকে আজ পর্যন্ত দেশের উন্নয়নে অন্যতম প্রধান সোপান হিসেবে ভূমিকা রাখছে ইবনে বতুতার স্মৃতিধন্য এই বন্দর। জাতির গৌরব ও অহংকার, অর্থনীতির স্বর্ণদ্বার এই বন্দরের ১৩২তম বর্ষপূর্তি এবং বন্দর দিবস আগামীকাল ২৫ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার।

একগুচ্ছ উন্নয়ন পরিকল্পনায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে চট্টগ্রাম বন্দরের কাজ। নতুন নতুন যন্ত্রপাতি ক্রয়ের মাধ্যমে বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের চিত্র পাল্টে গেছে। কমে গেছে জাহাজের গড় অবস্থানকাল। কন্টোইনার পরিবহনে গতিশীলতা বেড়েছে ৩০ ভাগ। আরো বেশ কিছু উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে উঠবে দক্ষিন এশিয়ার রিজিওনাল হাব।

বন্দর দিবস উপলক্ষে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল জুলফিকার আজিজ। বুধবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দরের শহীদ আবদুর রহমান মুন্সী অডিটোরিয়ামে ১৩২তম বন্দর দিবস উপলক্ষে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।

মতবিনিময় সভায় বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ২০১৭ সালে যেখানে জাহাজের সর্বোচ্চ গড় অবস্থানকাল সাড়ে সাত থেকে আটদিন পর্যন্ত ছিল, সেখানে নতুন গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি আসার করনে জাহাজের গড় অবস্থানকাল কমে গেছে। আমদানিকারকদের এখন সপ্তাহজুড়ে পণ্য হাতে পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে না। কন্টেইনার উঠানামায় নতুন রেকর্ড গড়েছে বন্দর। এই খাতে প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ। আর সাধারণ কার্গো উঠানামায় প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১৩ শতাংশ। কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের এই পরিসংখ্যান চট্টগ্রাম বন্দরের ৩০ বছর মেয়াদী প্রক্ষাপনকে ছাড়িয়ে গেছে।

রিয়ার এডমিরাল জুলফিকার আজিজ বলেন, বর্তমানে বন্দরের ইয়ার্ডে ৫০ হাজারের বেশি কন্টেইনার রাখা সম্ভব। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বে-টার্মিনাল, পতেঙ্গায় কনটেইনার টার্মিনাল, লালদিয়া টার্মিনাল ও কর্ণফুলী কন্টেইনার টার্মিনাল নামে চারটি টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বে- টার্মিনাল, পতেঙ্গায় কন্টেইনার টার্মিনাল প্রকল্প নির্মাণের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নতুনভাবে সাজিয়ে তোলার জন্য যুক্ত হয়েছে অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন। এছাড়া নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং। এই ড্রেজিং নিশ্চিত করবে অধিক ড্রাফটের জাহাজ ভেড়া। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ৪২ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিংয়ের টার্গেট নিয়ে এই প্রকল্পের কাজ করছে। এতে খরচ হচ্ছে ২৪২ কোটি টাকা।

সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, গ্রিন পোর্ট কনসেপ্ট এখন যুগের চাহিদা। নতুন করে চারটি জেটি হবে। এর মধ্যে তিনটি কন্টেইনার বাকি একটি তেলের জন্য।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, বে-টার্মিনালে কন্টেইনার ইয়ার্ড এবং ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। ট্রাক টার্মিনালে ৬ হাজার ট্রাক রাখা যাবে। বন্দর থেকে টার্মিনালে যাওয়ার জন্য ফ্লাইওভার নির্মাণ পরিকল্পনায় রয়েছে।

বে টার্মিনাল প্রকল্পের ভূমি জটিলতা কেটে গেছে। মূল টার্মিনাল নির্মাণের জন্য এখনো আন্তর্জাতিক ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়নি। তবে ৩ মাসের মধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ চুড়ান্ত হয়ে যাবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, বন্দরের জলসীমা ৭ নটিক্যাল মাইল থেকে বেড়ে এখন ৫৪ নটিক্যাল মাইল। সমুদ্রসীমা বাড়ার কারণে বন্দর ডিউজ পাবে। এর মধ্যে এই খাতে বন্দরের আয় বাড়তে শুরু করেছে।

উল্লেখ্য: ইতিহাসবিদদের মতে ইংরেজ শাসনের প্রথমদিকে বছরে একটাকা সেলামির বিনিময়ে নিজব্যয়ে কর্ণফুলী নদীতে কাঠের জেটি নির্মাণ করেন। পরে, ১৮৬০ সালে প্রথম দু’টি স্থায়ী জেটি নির্মিত হয়। ১৮৮৭ সালের ২৫ এপ্রিল তৎকালীন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া সরকারের পোর্ট কমিশনারস এ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় আধুনিক চট্টগ্রাম বন্দরের। প্রথমদিকে ক্যাপাসিটি ছিল ৫০ হাজার টন হ্যান্ডল করার মত। ১৮৯৮ সাল হতে পালের জাহাজের পরিবর্তে বড় বড় বাষ্পচালিত জাহাজের জন্য বন্দরের কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বন্দরের ভিতরে রেল যোগাযোগ না থাকায় ১৯১০ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ও পোর্ট কমিশন যৌথভাবে ৪টি জেটি নির্মাণ করে। পরে, পোর্টের একাংশের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের হাতে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব বেড়ে যায়। কারণ পূর্বাঞ্চলের একমাত্র বন্দর ছিল চট্টগ্রামে। ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনারকে পোর্ট ট্রাস্টে পরিণত করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টকে রহিত করে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে পোর্ট অথরিটিতে পরিণত করা হয়। সময়ের পরিক্রমায় দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরে পরিণত হয়েছে। সময়ের সাথে বেড়েছে বন্দরের পরিধি।
দেশের মোট জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার (জিডিপি) যেখানে ৭ থেকে ৮ শতাংশ সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের প্রবৃদ্ধির হার ২১ শতাংশ। দেশের আমদানি-রপ্তানির ৯২ শতাংশ পরিবাহিত হয় এ বন্দরের মাধ্যমে।

বন্দর দিবস উপলক্ষে গৃহিত কর্মসূচি:

আগামীকাল সকাল ৯টায় বন্দর ভবন ও চত্বরে জাতীয় পতাকা এবং বন্দর পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সূচনা হবে বন্দর দিবস পালন উৎসবের। শুক্রবার বাদ জুমা বন্দর এলাকার সব মসজিদে দোয়া মাহফিল করা হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ আগামী শনিবার সকালে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাবেদ)।

ওইদিন আয়োজন করা হয়েছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ‘মেজবান।’ প্রায় ১৩ হাজার মানুষকে খাওয়ানোর প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। একই দিনে বার্থ অপারেটরস, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরস এন্ড টার্মিনাল অপারেটরস ওনার্স এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ শিপহ্যান্ডলিং এন্ড বার্থ অপারেটরস এসোসিয়েশন এবং টার্মিনাল অপারেটর সাইফপাওয়ারটেক লিমিটেডও মেজবানের আয়োজন করেছে। মেজবানে আপ্যায়ন করা হবে বন্দর ব্যবহারকারী সংস্থাগুলোতে কর্মরত কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের।

/আরএ

Comments