নির্বাচন নয়, আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হচ্ছে : আসক চেয়ারম্যান পান্না নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: ৮:২৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৩ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক)। রবিবার এ উপলক্ষ্যে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সূত্র ধরে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আসক এর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে আসকের চেয়ারপারসন ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছেন, ‘যেভাবে দলীয় কাউন্সিল হয়, এবারের নির্বাচনও সেভাবেই হচ্ছে। একদল নৌকার প্রতীক পেয়েছে, আরেকদল পায়নি। যারা প্রতীক পেয়েছে আর যারা পায়নি- তাদের মধ্যে হচ্ছে ইলেকশন। উভয় গ্রুপই কিন্তু নেত্রীর প্রতি, দলের প্রতি অবিচল, আস্থাশীল। এখানে তো অপজিশন বলে কিছু থাকবে না।’ তিনি বলেন, ‘বেসিক্যালি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হলে যেটা হত, সেটা এখন এই ভোটের মাধ্যমে হচ্ছে। এক দলেরই ভোট।’ সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল। প্রতিবেদনে উঠে আসে, দেশে নিম্ন আদালত কর্তৃক সাজা দেয়ার ঘটনা আগের তুলনায় লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় গত ৫ মাসে ৯২ মামলায় সাজা হয়েছে অন্তত ১ হাজার ৫১২ জন সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা—কর্মীর। লিখিত বক্তব্যে আসকের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, নানা কারণে ২০২৩ সাল ছিলো বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। ২০২৪ এর শুরুতে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ ১৪টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করায় ইতোমধ্যে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা এবং অংশগ্রহণমূলকতা নিয়ে দেশে বিদেশে নানা প্রশ্ন ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৩ সালের বার্ষিক মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ বছরেও শান্তিপূর্ণ সভা সমাবেশে বাধা দেওয়া, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গায়েবি মামলা, রাজনৈতিক গ্রেপ্তার, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হেফাজতে নির্যাতন, আইন শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সদস্যদের আইনবহির্ভূত আচরণ, ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গুম করার অভিযোগ, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৩ নভেম্বর জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ (ইউপিআর) এর আওতায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচিত হয়েছে এবং উপরে উল্লেখিত মানবাধিকার ইস্যুগুলো নিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য দেশ বাংলাদেশকে প্রায় ৩০০ সুপারিশ করেছে। পর্যালোচনার পরপর ১৪ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে অফিস অব দ্য হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়, বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি ঘটছে। দেশের এ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা। আরও বলা হয়েছে, জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ন্যায্য মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভে দমনপীড়ন চালানো হয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে রাজনৈতিক কর্মীদের আন্দোলনেও চলছে দমনপীড়ন। এ ছাড়া সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের নেতাদের বিচারিক হয়রানি করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিক্ষোভ—আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্তি প্রয়োগ, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া, পরিবারের সদস্যদের হয়রানি, ভয় দেখানো এবং বেআইনিভাবে আটক রাখার অভিযোগ সামনে এসেছে। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে এ বছর র্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা ছিল বিদ্যমান আইন ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার একটি অন্যতম উদাহরণ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে বেআইনি আটক, নির্যাতনের অভিযোগগুলোর যথাযথ প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না বলে জনমানুষের মধ্যে সৃষ্ট ধারণা ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো সরকার ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ এসব অভিযোগকে দেশি—বিদেশি প্রচারণার অংশ হিসেবে উল্লেখ করে নানা ধরনের দুঃখজনক মন্তব্য করেছেন। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে তদন্তের কথা বলা হলেও এর শেষ দেখা যায় না। দায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেটা জনগণের সামনে উন্মোচণ হয় না। প্রকৃতপক্ষে নিজ বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিজ বাহিনী কতৃর্ক তদন্ত করলে আসল সত্য কিংবা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে না। কাজেই প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা আবশ্যক। অন্যদিকে এ সময়কালে হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় বাবা মায়ের জানাজায় অংশ নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে শরীয়তপুর ও গাজীপুর জেলায়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে স্পষ্টত বলা আছে, বিচার বা দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রনা দেওয়া যাবে না, কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশনারও ব্যত্যয় ঘটেছে। উল্লেখ্য রাজনৈতিক কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে কিংবা সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার কারণে যারা আটক বা গ্রেফতার হচ্ছেন, তাদের প্রতি এ ধরনের আচরণ শিষ্টাচার বহিভূর্ত; একই সাথে মানবাধিকারের মূল চেতনার পরিপন্থী। ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদে প্রার্থীদের হলফনামায় উল্লেখিত সম্পদের বিবরণি বিষয়ে তদন্ত বা কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়’ এমন মন্তব্যে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) মনে করে নির্বাচন কমিশনের এ মন্তব্য দায় এড়ানোর অজুহাত মাত্র। লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, সকলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকারের কথা বলা থাকলেও দলীয় প্রার্থীরা পাচ্ছে বিশেষ সুবিধা। সংশোধিত নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী, নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হলে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার মোট ভোটারের এক শতাংশের নাম—স্বক্ষর এবং ভোটারের মুঠোফোন নম্বরের তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়। অন্যদিকে, নির্দিষ্ট দল মনোনীত প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এই বাধ্যবাধকতা নেই। নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণ মূলত তাদেরকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিরুৎসাহিত করার একটি পন্থা। এটা সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং সংবিধান ও গণতন্ত্রের পরিপন্থি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারকে কেন্দ্র করে সংঘাত থামছে না। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারশিবির ও মিছিলে হামলা, কর্মীদের মারধর ও হুমকি দেওয়া চলছেই। মাদারীপুরে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, যাকে ওই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজের কর্মী বলে দাবি করেছেন। মুন্সিগঞ্জে এক কর্মীর বাড়িতে গুলির ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো ছাড়াই এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং নিজ দলীয় প্রার্থীদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বীতা হলেও নিজেদের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ লক্ষণীয়। অন্যদিকে ২৯ ডিসেম্বর ড. আবদুল মঈন খান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র আট দিন বাকি থাকলেও বিদ্যমান সংকট উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) মনে করে সুযোগ থাকলে ড. মঈন খানের সমঝোতার প্রস্তাব বিবেচনায় নিতে পারে সরকার। বার্ষিক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে ২০২৩ সালে মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ভিত্তিক রিপোর্ট তুলে ধরেছে সংস্থাটি। সেই সঙ্গে বেশ কিছু সুপারিশও করেছে। বিষয়ভিত্তিক রিপোর্ট ও সুপারিশে বলা হয়, শান্তিপূর্ণ সভা—সমাবেশের অধিকার এ বছরও বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, গায়েবি মামলা, হামলা, গণগ্রেপ্তার, পরিবহন ধর্মঘট ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বাড়িতে গিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটেছে। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি জনদুর্ভোগ তীব্রতর হয়েছে। গণপরিবহনের অপ্রতুলতা, যাতায়াত ব্যবস্থার বেহাল দশা সাধারণ মানুষের ভোগান্তিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। শান্তি সমাবেশের নামে ক্ষমতাসীন দলের ধারাবাহিক রাজনৈতিক কর্মসূচী, পাশাপাশি, বিরোধী দলগুলোর অবরোধ—ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে সহিংস রুপ পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করেছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, গত ২৮ অক্টোবর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ২৪১টি যানবাহন ভাঙচুর করা হয়েছে। একই সময়ে ৩৭৬টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে আরও জানা যায়, শুধু রাজধানীতে ১২৩টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তিনটি ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ট্রেন লাইন কেটে যাত্রীবাহী ট্রেনকে দুর্ঘটনায় ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। এ ঘটনায় ১ জন নিহত এবং কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের সময় রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ চলাকালে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা এবং পেশাগত দায়িত্বপালনরত সাংবাদিকদের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছে, নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে একজন পুলিশ সদস্যকে যা কোন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে কাম্য নয়। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গত ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সারা দেশে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৫৩৪টি মামলা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব মামলায় দলটির প্রায় ২০ হাজারের মতো নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ সংখ্যাকে ১১ হাজার বলে দাবি করেছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘাতে নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৪৫ জন এবং আহত হয়েছে কমপক্ষে ৬৯৭৮ জন। রাজনীতি বা সংগঠন করার অধিকার এবং শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ বা সভা—সমাবেশ আয়োজন একটি সংবিধানসম্মত অধিকার। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এ অধিকারচর্চার ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। সংবিধানস্বীকৃত এ অধিকার নির্বিঘ্নে চর্চা নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হচ্ছেন আইন—শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অথচ তাদের দ্বারাই সভা—সমাবেশ ও র্যালিতে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ হচ্ছে। অন্যদিকে জনগনকে জিম্মি করে বাসে—ট্রেনে অগ্নি সংযোগের মত ঘটনা এবং রেল লাইন কেটে নাশকতা সৃষ্টি কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হতে পারে না। সাধারন মানুষকে পুড়িয়ে, তাদের জান—মালের ক্ষতি করে, বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করার যে প্রবণতা তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সারা বছরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের েত্রে দেখা যায়, আগের বছরগুলোর মত এ বছরও নাগরিকের মত প্রকাশ এবং শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হবার ও প্রতিবাদ করার অধিকার বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার অব্যাহত ছিল। ২৯ মার্চ প্রথম আলোর স¤পাদকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের পদক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করে, সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরী করে। এখানে উল্লেখ্য যে, এর পূর্বে বাংলাদেশ সরকারের আইনমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিরা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা গ্রহণের পূর্বে বিশেষ সতর্কতা বজায় রাখার যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তার প্রতিফলন এ ঘটনাসমূহের ক্ষেত্রে দেখা যায় নাই। বরং উচ্চ পদস্থ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের প্রথম আলোর প্রতিবেদক এবং সম্পাদক সম্পর্কে নানা মন্তব্য এ ধরনের মামলা দায়ের করতে অতি উৎসাহীদের অনুপ্রাণিত করছে বলে মনে হয়েছে। বছরের শেষ প্রান্তিকে এসে আইনটি রহিত করা হলেও এ আইনে বিগত বছরগুলোতে গৃহীত মামলাগুলোও ভবিষ্যতে চলমান থাকছে। ২০২৩ সালে ১৮ সেপ্টেম্বর আইনটি রহিত করে সাইবার সিকিউরিটি আইন নামে যে আইনটি সংসদে পাশ হয়েছে সেখানেও নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের সুপারিশসমূহ প্রতিফলিত হয়নি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন—২০২৩ এও জামিন অযোগ্য ধারা বহাল রাখা হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে তি করবে। সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটিতে শাস্তি কমানো হলেও প্রকৃতপে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পূর্ববৎ বিধান ও অপরাধের সংজ্ঞার অ¯পষ্টতা বিদ্যমান। আইনের ৪৩ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেফতারের মতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানি বছরজুড়ে ২৯০ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। যাদের মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ৭৮ জন সংবাদকর্মী। সংবাদ প্রকাশের জের ধরে বাংলা নিউজ২৪.কম জামালপুর প্রতিনিধি ও ৭১ টিভির বকশীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়াও সরকারী কর্মকর্তা—কর্মচারী কতৃর্ক লাঞ্ছিত ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় বাধা প্রদানের শিকার হয়েছেন ২২ জন সাংবাদিক। বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর—রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার তারিখ আবারও পিছিয়েছে। এ নিয়ে মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ১০৪ বারের মতো পেছালো। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা হামলা মামলার শিকার হচ্ছেন। বিশেষত প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জামানকে সিআইডি পরিচয়ে ভোর রাতে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং দিনভর তাকে আটকের ঘটনা সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায়োগিক আচরণ যে অসঙ্গত ও বেআইনি তা প্রতীয়মান হয়েছে। এ ধরনের অমানবিক আচরণের অভিযোগ সাতক্ষীরা জেলায় কর্মরত সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁকে আটকের সময়ও পুলিশের বিরুদ্ধে উঠেছিল। রঘুনাথ খাঁকে আটকের পর পুলিশ দিনভর অস্বীকার করে প্রায় নয় ঘন্টা পরে একটি মামলায় গ্রেফতার দেখায়। জীবনের অধিকার, বিচারবহিভূর্ত হত্যা ও নির্যাতন ২০২২ সাল থেকে বিচারবহিভূর্ত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যাগত দিক কমে আসলেও বিচারবহিভূর্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি কিংবা এক্ষেেত্রে অভিযোগসমূহের নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা যায়নি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৩ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২০ জন। এসব ঘটনার মধ্যে পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে কক্সবাজার জেলায় সাজেদুল ইসলাম মান্না এবং নারায়ণগঞ্জে র্যাবের গুলিতে আবুল কাশেম নিহত হয়। এছাড়া, পুলিশের হেফাজতে ১৩ জন, র্যাবের হেফাজতে ২ জন ও ডিবি (গোয়েন্দা) পুলিশের হেফাজতে ৩ জন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। উল্লেখ্য ২০২২ সালে ১৯ জন নাগরিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। কারা হেফাজতে মৃত্যু এ বছর দেশের বিভিন্ন কারাগারে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন ১০৫ জন। এর মধ্যে কয়েদি ৪২ এবং হাজতি ৬৩ জন। উল্লেখ্য যে, ২০২২ সালে কারা হেফাজতে মারা যান ৬৫ জন। এর মধ্যে কয়েদি ২৮ এবং হাজতি ৩৭ জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুম গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত আইন ও সালিশ (আসক) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হয়েছেন ৯ জন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৬ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে, পরবর্তীতে ফিরে এসেছেন ৩ জন, যা গণমাধ্যমসূত্রে জানা যাচ্ছে। এছাড়াও সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, আইন—শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে আটকের ঘটনা ঘটছে এবং পরিবার ও স্বজনদের দাবির প্রেক্ষিতে আইন—শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার বা আটকের কোন তথ্য না দিয়ে সরাসরি নাকোচ করে দেওয়ার ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা যথেষ্ট উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এরপর বিভিন্ন অভিযোগে উল্লিখিত আটক ব্যক্তিদের আইন—শৃঙ্খলা বাহিনী পরবর্তীতে গ্রেফতার দেখিয়েছে। আটক এবং গ্রেফতার দেখানোর সময়কালের মধ্যে যে যথেষ্ট ফারাক তার কোনো ব্যাখ্যা আমরা লক্ষ্য করছি না। এ ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট ব্যত্যয় লক্ষ্য করা গেছে। সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতন প্রায় প্রতি বছরই ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ সীমান্ত হত্যা বন্ধে নানা প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে আসছেন। কিন্তু তাঁদের প্রতিশ্রম্নতির কোনো বাস্তবায়ন ঘটেনি। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাব মতে, ২০২৩ সালে ভারতের সীমান্তরী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক ৩০ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে লালমনিরহাটে ৩, সুনামগঞ্জে ১, ঝিনাইদহে ১, দিনাজপুরে ২, চাপাইনবাবগঞ্জে ৩, চুয়াডাঙ্গায় ৫, পঞ্চগড়ে ৫, কুড়িগ্রামে ১, ঠাকুরগাঁয়ে ৪, সিলেটে ১, মৌলভীবাজারে ১ ও রাজশাহীতে ৩ জন নিহত হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কতৃর্ক ৩১ জন নাগরিক মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। উল্লেখ্য ২০২২ সালে বিএসএফ কর্তৃক নিহত হয় ২৩ জন বাংলাদেশী নাগরিক। গণপিটুনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৩ সালে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫১ জন। উল্লেখ্য যে, ২০২২ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিলেন ৩৬ জন। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার: ধর্মীয় সংখ্যালঘু ২০২৩ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি—ঘর, মন্দির ও ব্যবসা— প্রতিষ্ঠান ভাংচুরের ২১টি ঘটনা ঘটেছে। পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আলোচনা সভায় হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার মত ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে কমপে ১০৩টি বাড়ীর ২৫৯ টি ঘরে হামলায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়,পঞ্চগড় সদর ও বোদা উপজেলার আহমদিয়া জামাতের আহমদনগর ‘সালানা জলসা’ বন্ধের দাবিতে বিোভকারী ও পুলিশের মধ্যে ২ মার্চ ২০২৩ থেকে ৪ মার্চ ২০২৩ রাত ১১ টা পর্যন্ত ব্যাপক সংঘর্ষে আরিফুর রহমান (২৮) ও জাহিদ হাসান (২৩) নামের দুই তরুণ নিহত হয়। হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় ৯ জন পুলিশ, ২জন সাংবাদিকসহ আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী সদস্যসহ কমপে ৬২ জন আহত হয় । আদিবাসীর অধিকার বিগত বছরগুলোর মতো ২০২৩ সালেও সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় মুকুল সরেন (৩৫) নামের এক সাঁওতাল কৃষক কীটনাশক পানে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় মুকুল সরেন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপ (বিএমডিএ) সেচ কর্মসূচির চুক্তিতে নেওয়া প্রায় সাড়ে ৩ বিঘা আয়তনের দুটি জমিতে বোরো ধান চাষ করেন। অপারেটরকে অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও, জমিতে পানি না পাওয়ায় তিনি আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে কীটনাশক পান করেন। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপ (বিএমডিএ) এর কর্মকর্তাদের তদারকির গাফিলতি এবং গভীর নলকূপ অপারেটর হাসেম আলীর দায়িত্বে অবহেলার কারনেই মুকুল সরেন আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে কীটনাশক পান করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬ বছর হতে চলেছে কিন্তু এ চুক্তির বাস্তবায়নে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি ঘটেনি। বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের নিকট যে প্রত্যাশা, কমিশন সে অনুযায়ী ভূমিকা রাখতে পারছে না। নারী অধিকার নারীর প্রতি সহিংসতা ২০২৩ সালের আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয়। বিশেষ করে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতনের নানা ঘটনাসহ শিশু হত্যা ও নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। বিগত বছরের ন্যায় এ বছরও ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতন, সালিশ ও ফতোয়াসহ নারীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণ আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য সংরণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৩ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৫৭৩ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৫ জন। ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছে ১২৯ জন। এরমধ্যে ধর্ষণের চেষ্টার পর হত্যা করা হয় ৩ জনকে, ধর্ষণের চেষ্টার কারণে আত্নহত্যা করে ৩ জন। নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানি: গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য সংরণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১৪২ জন নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ১২২ জন পুরুষ। এ বছর উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ ও উত্তক্তে্যর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৪ জন নারী ও ৪ জন পুরুষ খুন হয়েছেন। এমনকি, অনলাইনেও নারীরা নিরাপদ নন, এই মাধ্যমেও বাড়ছে নারীর প্রতি বৈষম্য, অবমাননা ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা। পারিবারিক নির্যাতন ও যৌতুক এ বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৫০৭ জন নারী। যার মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ২৯২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৪২ জন। উল্লেখ্য, ২০২২ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৪৭৯ জন নারী। অন্যদিকে ২০২৩ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ১৪২ নারী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হন ৬৪ জন নারী এবং আত্মহত্যা করেন ৬ নারী। গৃহকর্মী নির্যাতন ও অ্যাসিড নিক্ষেপ ২০২৩ সালে ৩২ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মারা যায় ৬ জন, এছাড়া রহস্যজনক মৃত্যু হয় ১ জনের। অন্যদিকে এ বছরে অ্যাসিড নিেপের শিকার হয়েছেন ১০ জন নারী। শিশু অধিকার হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, বলাৎকার, অনলাইনে যৌন হয়রানিসহ শিশুর প্রতি নানা সহিংসতার ঘটনা অব্যাহত থেকেছে ২০২৩ জুড়ে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য সংরণ ইউনিটের হিসাবমতে, ২০২৩ সালে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখেঁাজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয় কমপে ৪৮৪ জন শিশু। এছাড়া ২০২৩ সালে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয় কমপে ১০১২ জন শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩১৪ জন শিশু, ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ১১৮ জন শিশু এবং বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৭৫ ছেলে শিশু। শ্রমিক অধিকার চলতি বছরের নভেম্বরের শুরুতে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিকদের চলমান আন্দোলনের মধ্যে মিরপুর, আশুলিয়া, চন্দ্রা, গাজীপুর ও অন্যান্য এলাকার অন্তত ৩০০টি পোশাক কারখানা তাদের কার্যক্রম বন্ধ করেছে। এরই মধ্যে শ্রমিক আন্দোলন জোরদার হলে আইনশৃঙ্খলারাকারী বাহিনী ও আন্দোলনরত শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ হলে আইশৃঙ্খলারাকারী বাহিনীর গুলিতে আঞ্জুয়ারা বেগম নামে একজন নারী শ্রমিক, এবং রাসেল হাওলাদার ও জালালউদ্দিনসহ মোট ৩ জন শ্রমিক নিহত হয়। মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন করার ন্যায্য অধিকার রয়েছে, কিন্তু সেই আন্দোলনে গুলিবর্ষণ করে শ্রমিক মেরে ফেলা সম্পূর্ণভাবেই শ্রমিক অধিকারের লঙ্ঘন। অভিবাসী শ্রমিক বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম ১১ মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২০ দশমিক ৪১ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪১ কোটি ডলার। বাংলাদেশ জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে চলতি বছরের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ লাখ ৪৬ হাজার কর্মী বিদেশে পাঠানো হয়েছে যা গত বছরের ১১ লাখ ৩৫ হাজারকে ছাড়িয়ে গেছে। শুধু অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, তাঁদের সুরা এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। অভিবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য সেইসব দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দুতাবাসগুলোকে উপযুক্ত ও সন্তোষজনক পদপে গ্রহন করতে হবে। স্বাস্থ্যের অধিকার বাংলাদেশে ২০২৩ সালে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। এই বছরে আক্রান্তের হার যেমন বেড়েছে, তেমনি মৃত্যুর সংখ্যা সর্বোচ্চ ছুঁয়েছে। এ বছর ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৬৯৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, যেখানে গত ২৩ বছরে দেশে ডেঙ্গুতে মোট মারা গেছেন ৮৬৮ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের এই পরিণতির পেছনে গত কয়েক বছর ধরে চলমান অপরিকল্পিত নগরায়ন, মশক নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা, স্বাস্থ্যখাতের দুরবস্থাসহ বেশ কিছু কারণ রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘জাতীয় যক্ষ্মা, কুষ্ঠ ও এইডস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে নতুন করে এইডস শনাক্ত হয়েছে ১২৭৬ জনের, গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৯৪৭। আর এই সময়ে এইডসে আক্রান্তদের মধ্যে ২৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে; গত বছর ২৩২ জন মারা যান। ১৯৮৯ সালে দেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এক বছরে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর এই সংখ্যাকে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন অষ্টম। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, ক্রমবর্ধমান চিকিৎসা ব্যয় ১৪% এরও বেশি ডায়াবেটিস রোগীকে আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকিতে ফেলছে। শিক্ষার অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদ বলছে, রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক—বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করবে। দেশে গত জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। আগামী বছরগুলোতে ধাপে ধাপে সব শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হবে। আগামী বছর থেকে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার মতো আলাদা বিভাগ বিভাজন থাকবে না। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে পক্ষে—বিপক্ষে নানা রকমের মতামত পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটার ভবনের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে এক উন্মুক্ত আলোচনা সভার আয়োজন করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। কিন্তু আলোচনা সভা শুরুর আগমুহূর্তে আয়োজকদের মুঠোফোনে জানানো হয়, ওই মিলনায়তন ব্যবহারের অনুমতি বাতিল করা হয়েছে। এভাবে শিক্ষকদের আলোচনা সভা আয়োজনের অনুমতি দিয়ে তা বাতিল করা গ্রহণযোগ্য নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর সুপারিশ মানবাধিকার রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব প্রতিশ্রম্নতি দেওয়া হয়েছে, তার বাস্তবায়নও সরকারের দায়িত্ব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে সকলের জন্য মর্যাদাপূর্ণ ও সম—অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকার ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। এই প্রেক্ষিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর সুপারিশসমূহ নিম্নরূপ: ১. রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা যে কোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যেমন— বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, আইন—শৃঙ্খলা বাহিনীর এখতিয়ার বহির্ভূত আচরণ ইত্যাদির অভিযোগ উঠলে তা দ্রুততার সাথে নিরপেভাবে তদন্ত করতে হবে এবং স¤পৃক্তদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শাস্তি প্রদান করতে হবে। ২. এ পর্যন্ত সংঘটিত সকল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তে নিরপে কমিশন গঠন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ৩. দেশের যে কোন নাগরিককে আটক বা গ্রেফতারের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সম্পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট সব পকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। ৪. মিথ্যা মামলা বা গায়েবি মামলা সংক্রান্ত যে অভিযোগসমূহ উঠেছে সেগুলো আমলে নিয়ে অভিযোগের যথাযথ নিষ্পত্তি নিশ্চিত করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে পদপে গ্্রহণ করতে হবে। ৫. নাগরিকের সমবেত হওয়ার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। শান্তিপূর্ণ সভা—সমাবেশের অধিকার যথাযথভাবে চর্চা করার পরিবেশ তৈরি এবং জনদূর্ভোগ এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ভিন্নমত প্রকাশকারীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ কিংবা কোনো ধরণের ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে হবে। ৬. আইন—শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীকে পেশাদারীত্বের আওতায় রেখে তাদের কর্ম—পরিধি নিশ্চিত করতে হবে। ৭. নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আইনগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন হয়রানি রোধে কার্যকর ব্যবস্থ্যা গড়ে তোলার জন্য তদন্ত সাপেে আইন অনুযায়ী দ্রুত পদপে গ্রহন করতে হবে। ৮. ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরি করে কোনো সহিংসতার ঘটনা না ঘটে তার জন্য পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িতদের সুষ্ঠু তদন্তসাপেে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিজ বিশ্বাস ও রীতি চর্চার অধিকার এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ৯. মানবাধিকারকর্মী ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ দ্রুততার সাথে সংশোধন করতে হবে। কমিশনের প্রধান ও সদস্যদের নিয়োগের জন্য একটি উন্মুক্ত ও অংগ্রহণমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। ১০. পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে যথাযথ পদপে গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সমতলের আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার এবং সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে । ১১. কাঙ্খিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানবাধিকার সুনিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পদপে গ্রহণ করতে হবে। ১২. দেশে সুস্থ রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার ভোগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ১৩. সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্মস্থলে পরিবারসহ বাধ্যতামূলক অবস্থানের জন্য পূর্বের ন্যায় পদপে গ্রহণ করতে হবে। ১৪. অভিবাসী শ্রমিকদের সুরা ও সহযোগিতায় বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে জরুরি হেল্পলাইন নম্বর চালুসহ অন্যান্য কল্যাণমূলক ব্যবস্থা বিস্তৃত করতে হবে। ১৫. রাজনৈতিক দলগুলো যেন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিতে এবং সমঝোতার মাধ্যমে সকল সমস্যা সমাধান করে, সে ব্যাপারে সকল পকে দায়িত্বশীল হতে হবে। /একুশনিউজ/ইইএস/ Comments SHARES জাতীয় বিষয়: আইন ও সালিশ কেন্দ্রআসক