গত তিন মাসে ১৭৪ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন: অধিকার

প্রকাশিত: ১:৫২ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৯, ২০১৯

ডেস্ক: চলতি বছরে প্রথম তিন মাসেই ১৭৪ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ৫১ জন নারী, ১২২জন মেয়ে শিশু এবং ১ জনের বয়স জানা যায়নি। ঐ ৫১ জন নারীর মধ্যে ২৬ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ১ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।

১২২ জন মেয়ে শিশুর মধ্যে ৩০ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ১০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এই সময়কালে ১৪ জন নারী ও শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার বছরের প্রথম তিন মাসের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানায়।

এছাড়াও গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মোট ১৭ জন নারী ও মেয়ে শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ২ জন আত্মহত্যা করেন। এছাড়া ২ জন আহত, ৫ জন লাঞ্ছিত এবং ৮ জন বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৮ জন এসিডদগ্ধ হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ৫জন মহিলা ও ৩ জন মেয়ে শিশু।

গত তিন মাসে মোট ১৫ জন নারী যৌতুক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ৯ জন নারীকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ও ৬ জন বিভিন্নভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।

অধিকার এর এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে ২০১৯ সালের প্রথম তিন মাসের (জানুয়ারি-মার্চ)মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতা হরণ এবং জীবনের অধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করার মত বিষয়গুলো।

অধিকার জানায়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় আছে, তাই ২০১৯ সালের মানবাধিকার লঙ্ঘন গত দশ বছরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি ধারাবাহিক রূপ। ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতায় আসে।

২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রধান বিরোধীদল বিএনপি, নাগরিক সমাজ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আপত্তি উপেক্ষা করে এবং গণভোট ছাড়াই একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সর্বসম্মত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি করে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের প্রতিবাদে বিএনপিসহ প্রায় সকলবিরোধী রাজনৈতিক দল (আওয়ামী লীগের জোটভুক্ত রাজনৈতিক দল ব্যতীত) ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি’র দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করলে ভোটারবিহীন ও প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসে।

গত ১০ বছরে সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি এবং স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণের মাধ্যমে তাদের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছে।ফলে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার তাররাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যবহার করার সুযোগ পায়।

এরমধ্যে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সরকার নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করেবাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রহসনমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে।

এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ভরে রাখা, জাল ভোট দেয়া, ভোটারদের প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীনদলের প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য করা, কেন্দ্র দখল ও বিরোধীদল মনোনীত প্রার্থীর এজেন্টদের আটক ও বের করে দেয়া এবং ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ অন্যান্য অনিয়মের ঘটনা ঘটেযা ছিল নজিরবিহীন এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটে।

একাদশতম জাতীয় নির্বাচনের পর ১০ মার্চ থেকে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে পাঁচ ধাপে উপজেলা নির্বাচন শুরু হয়। একাদশতম জাতীয় নির্বাচন প্রহসনমূলক হওয়ায় এরএবংকোন প্রতিকার না পাওয়ায় প্রধান বিরোধীদল বিএনপি এবং বাম রাজনৈতিক দলগুলো উপজেলা নির্বাচন ২০১৯ বয়কট করে এবং ক্ষমতাসীনদল আওয়ামী লীগ ও তার শরীক রাজনৈতিক দলগুলো এই নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রার্থী দিয়ে অংশ নেয়। অধিকাংশ উপজেলায় প্রতিদ্বদ্বীতা না থাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরাই নির্বাচিত হন।

৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির কারণেভোট দিতে না পারায় ভোটাররা উপজেলা আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে থাকাকালীন ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তাদের নেতৃত্বাধীন জোট ও জনগণের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারবস্থা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংযোজিত হয়।

অথচ ২০১১ সালে কোন রকম গণভোট ছাড়াই এবং সচেতন জনগোষ্ঠীর সমস্ত প্রতিবাদ উপেক্ষা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার মধ্যে দিয়ে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত বা বিধান বলবৎ করে। এর ফলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি’র দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলের বর্জন সত্ত্বেও একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এই সংসদ নির্বাচনটি শুধুমাত্র প্রহসন মূলকই ছিলো না (১৫৩ জন সংসদ সদস্য ভোটগ্রহণের আগেই বিনাপ্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হন)।

গত নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে আর আগ্রহ দেখাননি। ফলে অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রই দেখা গেছে ভোটার শূন্য। একই রকম পরিস্থিতি দেখা যায় ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও। জনগণের ভোট ছাড়া ক্ষমতায় আসার কারণে সরকারের দায়মুক্তির সংস্কৃতি আরো প্রবল হয়েছে।

গত তিনমাসে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক। এই সময়ে নাগরিকরা গুম, বিচারবহিভূত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনসহ বিভিন্নধরনের মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের মামলা করতে গিয়ে প্রায় অর্ধেক নারী ও শিশু থানায় হেনস্তার শিকার হন।তাঁদের মামলা রেকর্ড করা হয় যেনতেনভাবে। টাকা খরচ করতে হয় এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ আসামী ধরতে পারে না।

আসামী ধরতে না পারার পেছনে পুলিশ রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় দুবৃর্ত্ত ও উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়ী করেছেন। পুলিশের তদন্তে দেখা গেছে ধর্ষণের শিকার নারীদের দুই-তৃতীয়াংশ শিশু।

দলীয় নেতাকর্মীদের ব্যবহার করে প্রহসনমূলক নির্বাচনের‌ মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের কারণে দায়বদ্ধতাহীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় দেশে আইনের শাসন নেই। ফলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা দায়মুক্তি ভোগ করছে এবং ধর্ষণসহ নারীদের ওপর তারা বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা চালাচ্ছে। সূত্র: দৈনিক অধিকার

/আরএ

Comments