তাবলীগ জামাতের দুইপক্ষের সংঘর্ষ, বিমানবন্দর সড়কে দুর্ভোগ

প্রকাশিত: ২:১৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১, ২০১৮

একুশ ডেস্ক: টঙ্গীতে জোড় ইজতেমাকে কেন্দ্র করে তাবলীগ জামাতের দিল্লি মারকাজ এবং দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসারী দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে

এই উত্তেজনার মধ্যে শনিবার সকাল থেকে বিমানবন্দর সড়কের টঙ্গীমুখী অংশে যান চলাচল বন্ধ থাকায় সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট। ফলে দূর পাল্লার যাত্রীরা পড়েছেন ভোগান্তিতে।

তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের নেতৃত্বের কোন্দলে জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব গত মাসে স্থগিত করা হয়। দেওবন্দপন্থিদের আবেদনে নির্বাচন কমিশন শুক্রবার এক আদেশে ৩০ ডিসেম্বর ভোটের আগে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে সব ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করে একটি নির্দেশনা জারি করে।

দিল্লি মারকাজের মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভির অনুসারীরা এর মধ্যেই পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা করার ঘোষণা দিলে দেওবন্দপন্থি মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা দিন কয়েক আগে ইতজেমা মাঠ দখল করে আশপাশে পাহারা বসায়। এ অবস্থায় মাওলানা সাদের অনুসারীরা শুক্রবার ময়দানে ঢুকতে না পেরে আশোপাশের মসজিদে অবস্থান নেন।

শনিবার ভোর থেকে সাদের অনুসারী শত শত মানুষ ঢাকার দিক থেকে টঙ্গীর পথে রওনা হলে পরিস্থিতি বিস্ফোন্মুখ হয়ে ওঠে। বিমানবন্দর সড়কসহ টঙ্গীর পথের বিভিন্ন স্থানে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হলে বিমানবন্দর সড়কের এক দিকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা জোনের উপ কমিশনার নাবিদ কামাল শৈবাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিমানবন্দর সড়কে ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথের একপাশে যান চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি তাদের সরিয়ে দিতে।”

মহানগর পুলিশের বিমানবন্দর জোনের সহকারী কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, “দুই পক্ষের লোকজন বিমানবন্দর গোল চত্বর ছাড়াও আবদুল্লাহপুর এলাকা ও আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিছুটা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, শ্লোগানও হয়েছে। দুই পক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা চলছে।”

সাদ পন্থি হিসেবে পরিচিত তাবলীগ জামাতের সুরা সদস্য মাওলানা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই পক্ষের লোকজন কয়েক দিন ধরে মাঠ দখল করে রেখেছে। ছোট ছোট ছেলেরা সেখানে আমাদের কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। জোড় ইজতেমায় যোগ দিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসল্লিরা ময়দানে যাওয়ার চেষ্টা করলে তারা বাধা দিচ্ছে। এ কারণে রাস্তায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।”

অন্যদিকে মাওলানা জুবায়েরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত তাবলিগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য মাওলানা আবদুল কুদ্দুস বলেন, “বাচ্চারা না, ওখানে বড়রাই আছে। তারা বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতির জন্য কাজ করছে। সাদের পক্ষের লোকজন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য আজ সেখানে যেতে চাইছে।”

বিমান বন্দর গোল চত্বরের উত্তর দিকে অবস্থান নিয়ে থাকা  জুবায়েরের অনুসারীদের জটলার মধ্যে বাব উস সালাম মাদ্রাসার ছাত্র মোহাম্মদ হানিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সকালে সাদের লোকজন আমাদের ওপর হামলা চালায়। প্রথমে তারা ইজতেমা ময়দানের দিকে আসতে থাকে।

আমাদের লোকজন তাদের মাঠে না যেতে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু তারা কোনো কথা না শুনে আমাদের ওপর আক্রমণ করে। এতে আমাদের ৫-৬ জন আহত হয়।

অন্যদিকে বরিশাল থেকে আসা সাদ সমর্থক দুলাল তালুকদার বলেন, “আমরা সকালবেলা জোড় ইজতেমায় যোগ দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের আটকে দেয়। কোনোভাবেই আমাদেরকে মাঠে যেতে দিচ্ছে না। আমরা কোনো ধরনের হামলা করিনি। পুলিশকে জানানো হয়েছে। আমরা মাঠে যেতে চাই।”

উপমহাদেশে সুন্নী মতাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় সংঘ তাবলিগ জামাতের মূলকেন্দ্র ভারতের দিল্লিতে। মাওলানা সাদের দাদা ভারতের ইসলামি পণ্ডিত ইলিয়াছ কান্ধলভি ১৯২০ এর দশকে তাবলিগ জামাত নামের এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন।

স্বেচ্ছামূলক এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধের প্রচার। বিতর্ক দূরে রাখতে এ সংগঠনে রাজনীতি ও ফিকাহ নিয়ে আলোচনা হয় না।

মাওলানা ইলিয়াছের মৃত্যুর পর তার ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ এবং তারপর মাওলানা ইনামুল হাসান তাবলিগ জামাতের আমিরের দায়িত্ব পালন করেন। মাওলানা ইনামুলের মৃত্যুর পর একক আমিরের বদলে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার দেওয়া হয় একটি শুরা কমিটির ওপর।

সেই কমিটির সদস্য মাওলানা জুবায়েরের মৃত্যুর পর মাওলানা সাদ আমিরের দায়িত্ব নেন এবং একক নেতৃত্বের নিয়ম ফিরিয়ে আনেন।

এ অবস্থায় মাওলানা জুবায়েরের ছেলে মাওলানা জুহাইরুল হাসান নেতৃত্বের দাবি নিয়ে সামনে আসেন এবং তার সমর্থকরা নতুন করে শুরা কমিটি গঠনের দাবি জানান।

কিন্তু সাদ তা প্রত্যাখ্যান করলে বিরোধ বড় আকার ধারণ করে। বিভিন্ন সময়ে মাওলানা সাদের বক্তব্য নিয়েও আলেমদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়।

নেতৃত্ব নিয়ে দিল্লির মারকাজ এবং দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসারীদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে চলতি বছর জানুয়ারিতে ঢাকায় বিশ্ব ইজতেমার সময়।

কয়েক বছর ধরে বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করে আসা সাদ কান্ধলভি এবার ঢাকায় এসে বিরোধীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। শেষ পর্যন্ত সরকারে মধ্যস্থতায় ইজতেমায় অংশ না নিয়েই তাকে ঢাকা ছাড়তে হয়।

বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদে ওই বিরোধের জের চলে বছরজুড়ে। গত এপ্রিলে দুই পক্ষের অনুসারীদের মধ্যে হাতাহাতিও হয়।

এই দ্বন্দ্বের মধ্যে সাদের অনুসারীরা ৩০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর টঙ্গীতে জোড় ইজতেমা এবং ১১ থেকে ১৩ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে দেওবন্দপন্থিরা ৭ থেকে ১১ ডিসেম্বর জোড় ইজতেমা এবং ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব অনুষ্ঠানের কথা জানায়।

দুই পক্ষ আলাদাভাবে ইজতেমা করার ঘোষণা দিলে উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়। এই পরিস্থিতিতে গত ১৬ নভেম্বর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সভাপতিত্বে এক বৈঠক থেকে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব স্থগিত করা হয়।

ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, উভয় পক্ষের মধ্যে সমাঝোতার মাধ্যমে বিশ্ব ইজতেমার একটি তারিখ নির্ধারণে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ভারতের দেওবন্দে যাবে। দুই পক্ষ সমঝোতায় এলে নতুন তারিখ ঘোষণা করা হবে।

কিন্তু সাদপন্থিরা ৩০ নভেম্বর থেকে জোড় ইজতেমা করার প্রসন্তুতি নিলে অন্যপক্ষ তুরাগ তীরে ইজতেমা মাঠের সব কটি ফটকে পাহারা বসায়। এই পরিস্থিতিতে সাদপন্থীরা গত ২৭ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে।

অন্যদিকে জুবায়েরপন্থিরা গত ২৪ নভেম্বর ইসিতে চিঠি দিয়ে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘ভয়াবহ অবনতির শঙ্কা’ প্রকাশ করে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করে।

এর ভিত্তিতে ইসির যুগ্মসচিব ফরহাদ আহাম্মদ খান শুক্রবার গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে চিঠি দিয়ে ৩০ ডিসেম্বর ভোটের আগে টঙ্গীতে তাবলীগ জামাতের যে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান না করার নির্দেশনা দেন।

Comments