রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ান; ওআইসিকে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান নিউজ ডেস্ক নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ৯:১৩ অপরাহ্ণ, মে ৫, ২০১৮ স্টাফ রিপোর্টার: মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পাশে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানো উচিত বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে ওআইসিকে অবশ্যই নেপিদোর ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।জোরপূর্বক বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের মর্যাদা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য আমি ওআইসিকে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি।’ হযরত মুহাম্মদ (স.) এর বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়ানোর অমোঘ বাণীর উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) নিপীড়িত মানবতার পাশে দাঁড়ানোর জন্য নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। কাজেই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি যখন জাতিগত নির্মূলের মুখোমুখি ওআইসি তখন নিশ্চুপ থাকতে পারে না।’ শনিবার (৫ মে) সকালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দু’দিনব্যাপী ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার ৪৫তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সভার (সিএফএম) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি একথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইসলামী সহযোগিতা সংস্থাকে অবশ্যই মিয়ানমার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা অনুযায়ী তাদের অধিবাসী রোহিঙ্গাদের দেশে নিরাপদে ফেরত নিয়ে যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিও আমাদের সবার মত মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার এবং জীবন-জীবিকার অধিকার রাখে।’ কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড এবং ওআইসি মহাসচিব ইউসুফ এ ওসাইমিন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে আইভরীকোস্ট-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ৪৪ তম সিএফএম’র সভাপতি মার্সেল আমন-তানোহ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কাছে ৪৫ তম সিএফএম’র সভাপতিত্ব হস্তান্তর করেন। তুরস্কের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং ওআইসি সম্মেলনের সভাপতির প্রতিনিধি বেকির বোজড্যাগসহ এশিয়া, আরব এবং আফ্রিকার পক্ষে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত ভাইস মিনিস্টার আব্দুর রাহমান মোহাম্মাদ ফাসির অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘নিপীড়িত মানবতার জন্য আমরা আমাদের চিন্তা ও সীমান্ত দুই-ই উন্মুক্ত করে দিয়েছি। মিয়ানমারের প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে সম্পূর্ণ মানবিক কারণে আমরা আশ্রয় দিয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে তাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের ব্যথায় ব্যথিত। কারণ, আমার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্য নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর আমি ব্যক্তিগতভাবে ছয় বছর দেশে ফিরতে পারিনি, উদ্বাস্তু হিসেবে বিদেশের মাটিতে কাটিয়েছি ‘ ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে ঢাকায় ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এমন একটা সময় অতিক্রম করছি যখন প্রযুক্তি প্রবাহ ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং যুব সমাজের কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইসঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে অসমতা, অসহিষ্ণুতা ও সামাজিক অবিচার এবং জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব। এসবের সমন্বিত প্রভাবে আমাদের ইসলামী চিন্তা-চেতনার মৌলিক ভিত্তি আজ হুমকির সম্মুখীন। এমন অবস্থা আগে কখনও আমরা দেখিনি। তিনি বলেন, এখনকার মত মুসলিম বিশ্ব আগে কখনও এত বেশি পরিমাণ সংঘাত, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, বিভাজন ও অস্থিরতার মুখোমুখি হয়নি। লক্ষ্য করা যায়নি এত ব্যাপক হারে বাস্তুহারা জনগোষ্ঠীর দেশান্তর। আজকে মুসলমান পরিচয়কে ভুলভাবে সহিংসতা ও চরমপন্থার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন সময় এসেছে আমাদের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙিতে পরিবর্তন আনার। সময় এসেছে টেকসই শান্তি, সংহতি ও সমৃদ্ধির আলোকে আমাদের ভবিষৎকে নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজানোর। শেখ হাসিনা বলেন, ইসলামী বিশ্বের রূপকল্প এমন হতে হবে যাতে আমরা আমাদের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে পারি। নিজেরাই সকল দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমাধান করতে পারি। দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের পথ আমাদের নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন ফলাফল-কেন্দ্রিক নতুন কৌশল-সম্বলিত একটি রূপান্তরিত ওআইসি। তিনি এ প্রসঙ্গে ২০১৭ সালে রিয়াদ সম্মেলনে সন্ত্রাস দমনে যে চারদফা প্রস্তাব করেছিলেন তার পুনরোল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রথমত: আমাদের সন্ত্রাসীদের অস্ত্র সরবরাহের পথ বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত: সন্ত্রাসীদের অর্থ সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। তৃতীয়ত: ইসলামী উম্মার ভিতরে বিভেদ বন্ধ করতে হবে এবং চতুর্থত: নতুনভাবে সব পক্ষের জন্য সুবিধাজনক হয় এমন ব্যবস্থা রেখে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পথে যেকোন বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ জনশক্তি, এক তৃতীয়াংশের বেশি কৌশলগত সম্পদ এবং প্রচুর সম্ভাবনাময় কয়েকটি উদীয়মান শক্তিশালী অর্থনীতির দেশসহ অপার সম্ভাবনা ও সম্পদশালী মুসলিম বিশ্বের পিছিয়ে পড়ে বা অমর্যাদাকর অবস্থায় থাকার কোন কারণ নেই। তিনি বলেন, উন্নয়ন আমাদের অধিকার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আমাদের নাগালের মধ্যে এবং সামাজিক অগ্রগতির উপায় আমাদের হাতে। আমাদের এখন প্রয়োজন যৌথ ইসলামী কর্ম কৌশল ঢেলে সাজানো। তিনি এ প্রসঙ্গে তার পাঁচদফা চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরেন- এক: ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের উপর সকলকে আস্থাশীল হতে হবে। সাম্প্রদায়িক মানসিকতা বর্জন করতে হবে এবং ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করা বা সমাজে বিভাজন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। দুই: শান্তিপূর্ণ উপায়ে সকল বিবাদের সমাধান করতে হবে। আমাদের নিন্দুকদের কোন ধরনের হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তারের সুযোগ না দিয়ে নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। ওআইসিতে আমাদের বিরোধ মীমাংসার প্রক্রিয়াসমূহকে শক্তিশালী করতে হবে এবং আমাদের নিজস্ব শক্তি ও সম্পদসমূহের আরও উৎকর্ষ সাধন করতে হবে। তিন: আমাদের আত্মসচেতন আলোকিত জীবনযাপন করতে হবে। আমাদের মৌলিক বিশ্বাসকে অটুট রেখে আজকের আধুনিক সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে জীবনযাপন করতে হবে। তাহলেই ইসলাম-সম্পর্কিত ভীতি দূর হবে। আমাদের মুল্যবোধভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লালন করে আলোকিত বিশ্ব ব্যবস্থার পথ দেখাতে হবে। চার: দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূরীকরণ এবং জরুরি মানবিক দুরবস্থা মোকাবিলার জন্য ইসলামী সম্মেলন সংস্থার বলিষ্ঠ কর্মসূচিসহ একটি দ্রুত কার্যকর উন্নয়নমূলক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা আবশ্যক। ওআইসি-২০২৫ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সর্বশেষ: ইসলামের শাশ্বত মূল্যবোধ যেমন শান্তি, সংযম, ভ্রাতৃত্ব, সমতা, ন্যায়বিচার ও সমবেদনা থেকে আমাদের সর্বদা অনুপ্রেরণা ও শক্তি আহরণ করতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আসুন, আমরা আমাদের শক্তি ও সাহস একীভূত করার অঙ্গীকার করি এবং আমাদের মূল্যবোধ, সম্পদ ও সভ্যতাকে সুরক্ষা দেই। আসুন, আমরা সমঝোতা ও শান্তির বার্তা বিশ্বময় ছড়িয়ে দেই। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।’ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গ্রাজুয়েশন প্রাপ্তির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবসহ নানা বাধাবিপত্তি মোকাবিলা করে বাংলাদেশ সম্প্রতি তিনটি শর্তের সবগুলি পূরণ করে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সনদ পেয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘রূপকল্প ২০২১-এর আওতায় বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশের মডেল হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য সাফল্য দেখিয়েছে। এছাড়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এবং সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছে। জাতিসংঘ শান্তি মিশনের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে।’ তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয় – এ নীতিতে বিশ্বাস করতেন। আমরা মনে করি আজ ইসলামী বিশ্বে যেসব মতপার্থক্য ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা খোলামন নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব।’ খবর: বাসস। #একুশনিউজ/এএইচ Comments SHARES জাতীয় বিষয়: