ইয়াসমিন ট্রাজেডি, দিনাজপুর

ইয়াসমিন ট্রাজেডি দিবস : থেমে নেই নারী নির্যাতন, গত ৫ বছরে বেড়েছে রেকর্ড হারে

প্রকাশিত: ১১:৪২ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২৪, ২০২২

আজ ইয়াসমিন ট্রাজেডি দিবস। ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট। দিনাজপুরের এক ঘটনায় নড়েচড়ে ওঠে সারাদেশের মানুষ। ১৯৯৫ সালের এইদিনে দিনাজপুরে বিপথগামী কিছু পুলিশ সদস্যের হাতে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছিলো কিশোরী ইয়াসমিন।

এ ঘটনায় উত্তাল হয়ে পড়েছিলো পুরো দিনাজপুর। পুলিশি হেফাজতে তরুনী ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে আইন-শৃংখলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছিলো সামু, সিরাজ ও কাদের নামে ৩ জন প্রতিবাদী নাগরিক । আহত আর পঙ্গুত্ব হয় আরও শতাধিক মানুষ।

পরবর্তীতে এ ঘটনার প্রেক্ষিতে বিক্ষুদ্ধ জনতা দিনাজপুর কোতয়ালী থানা, ৩টি পুলিশ ফাড়ি, কাস্টমস গোডাউন, ৪টি পত্রিকা অফিসসহ বেশ কিছু স্থাপনা ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেয়। আন্দোলন গ প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।

দিনটি স্বরণে ২৪ আগষ্ট এই দিনটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে দেশের বিভিন্ন মানবাধিকার ও নারীবাদী সংগঠন।

সেদিন যা হয়েছিলো :

দিনাজপুর দশ মাইল মোড়, সময় তখন ভোর ৪টা। দিনাজপুর শহর অভিমুখে ফিরতে গাড়ীর জন্য অপেক্ষামান ঢাকা থেকে ফেরত আসা তরুণী ইয়াসমিন। ফজরের নামাজ পড়তে বের হওয়া স্থানীয় মুসল্লিরা তরুণীকে দিনাজপুর শহরে নিরাপদে যেতে তাকে তুলে দিলেন একটি টহল পুলিশের ভ্যানে। মুসল্লিরা পুলিশকে অনুরোধ করলেন তরুণীকে দিনাজপুরে নিরাপদে পৌঁছে দিতে।

কিন্তু পুলিশ ভ্যানে উঠেই ইয়াসমিনকে বিদায় নিতে হবে পৃথিবী থেকে তা জানা ছিলো না কারো। ১০ মাইল থেকে দিনাজপুর শহরের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার, আসার পথে তৎকালীন ব্রাক স্কুলের সামনে ভোরের দিকে পুলিশ ভ্যানে উপস্থিত ৩ জন সদস্য এসআই মইনুল, কনেস্টবল সাত্তার ও অমৃত ইয়াসমিনের শ্লীলতাহানী ঘটিয়ে চলন্ত পিকআপ ভ্যান থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসী পরে এ ঘটনার বিবরণ দেয়।

ইয়াসমিনের এই হৃদয়বিদারক মৃত্যুর ঘটনা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যার জের ধরে বিক্ষুব্ধ হাজার হাজার জনতা কোতয়ালী থানা ঘেরাও করে। লুট হয় একে একে কাষ্টমস্ গোডাউনসহ শহরের বিভিন্ন সরকারী ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। জ্বালিয়ে দেয়া হয় ৪ টি পত্রিকা অফিস ও প্রেসক্লাব।

২৭ আগষ্ট বিক্ষুব্ধ জনতা একে একে রাজপথে নেমে এসে সকল প্রশাসনিক কর্মকর্তার বদলি এবং দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তি দাবী করলে জনতার উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলী করে। এ ঘটনায় সামু, কাদের ও সিরাজ নিহত হয়। আহত হয় আরও শতাধিক ব্যক্তি। তাদের মধ্যে এখনও বেঁচে আছেন কয়েকজন মৃত্যু যন্ত্রণায়।

দিনাজপুর থেকে নিরাপত্তাজনিত কারণে পরবর্তীতেন ইয়াসমিন হত্যা মামলাটি স্থানান্তর করা হয় রংপুরে। রংপুর বিশেষ আদালতে ইয়াসমিন হত্যা মামলার স্বাক্ষ্য প্রমান শেষে দোষী প্রমানিত ৩ পুলিশ সদস্যেকে ফাঁসির আদেশ দেন।

উপমহাদেশের ইতিহাসে দোষী পুলিশদের ফাঁসিতে মৃত্যু কার্যকরের ঘটনা এটাই প্রথম। তবে লুট হয়ে যাওয়া কাষ্টমস্ গোডাউনসহ শহরের বিভিন্ন সরকারী ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালামালের এখন হদিস পাওয়া যায়নি। বিচার হয়নি লুন্ঠনকারীদের। ২৪ আগষ্ট এই দিনটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে দেশের বিভিন্ন সংগঠন।

ইয়াসমিনের স্মরণে দিনাজপুরের দশ মাইল এলাকায় তৈরী করা হয়েছে ইয়াসমিন স্মরণী। দিবসটি বিভিন্ন সংগঠন নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।

দিবসটি পালনে ইয়াসমিনের পরিবার এবং বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান দিনব্যাপী দোয়া মাহফিল, কবর জিয়ারত ও আলোচনা সভাসহ গ্রহন করেছে বিভিন্ন কর্মসূচী । ইয়াসমিন ট্রাজেডি’র কালের স্বাক্ষী এই ইয়াসমিনের মা। তাই ইয়াসমিনের মায়ের প্রাণের দাবী- আর যেন না ঘটে আইন-শৃংখলা বাহিনী’র হেফাজতে ইয়াসমিন ট্রাজেডি’র মতো জঘন্যতম ঘটনা।

সময়ের পরিবর্তনে সামু, কাদের ও সিরাজের স্মৃতি ফলকগুলো হারিয়ে গিয়েছে দিনাজপুর থেকে। দিনাজপুরের মানুষের সবচেয়ে বড় সংঘবদ্ধ আন্দোলন ছিল এটাই। যে সময় দিনাজপুরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। তার মধ্যেও আন্দোলন চলছিল। দিনাজপুরের মানুষ প্রতিবছর এই দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

কিন্তু নারী নির্যাতন বন্ধ হয়নি এখনো। এমন মন্তব্য নিহত ইয়াসমিনের মা ও নারী সমাজের।

দেশের একটি শীর্ষ গণমাধ্যমের আজকের একটি প্রতিবেদনেে উঠে এসেছে ভয়ংকর সব তথ্য। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার প্রায় অর্ধেক ধর্ষণের।

পাঁচ বছর ধরে ধর্ষণের মামলার হার বেড়েই চলছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, বিচারপ্রক্রিয়ার দুর্বলতা, দীর্ঘসূত্র এবং দোষীদের বিচার না হওয়ার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব বলছে, এ বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ৭ হাজার ৩৫০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের মামলা ৩ হাজার ৫২৩টি।

/এসএস/একুশনিউজ/

Comments