জাতিসংঘ অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা

জুলাই বিপ্লব বিশ্ববাসীর জন্য আগামী দিনে অনুপ্রেরণা হবে: ড. ইউনূস

প্রকাশিত: ৮:০৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৪
শান্তিতে নোবেলজীয় অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লব আগামী দিনে বিশ্বাবাসীর জন্য ন্যায়ের পক্ষে লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা যোগাবে বলে বিশ্বমঞ্চে প্রত্যাশ ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

প্রফেসর ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের এই ‘মুনসুন অভ্যুত্থান’ আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা যুগিয়ে যাবে।’

শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে বাংলাদেশের সরকার প্রধান এসব কথা বলেন। নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১১টায় (বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ৯টা) ভাষণ শুরু করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের কথা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। এছাড়াও তিনি ইসরায়েলের ‍যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর উপস্থিতিতেই ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গণহত্যা বন্ধে যুদ্ধবিরতি কার্যকর, স্বাধীন ফিলিস্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বিশ্বনেতাদের প্রতি জোরালো আহ্বান জানান।

এসময় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নতুন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমাদের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমি তাই বিশ্ব সম্প্রদায়কে আমাদের নতুন বাংলাদেশের সাথে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাই।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এই জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তার প্রেক্ষিতেই আজ আমি বিশ্বসম্প্রদায়ের এ মহান সংসদে উপস্থিত হতে পেরেছি। আমাদের গণমানুষের, বিশেষ করে তরুণ সমাজের অফুরান শক্তি আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল রূপান্তরের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।’

জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের ছাত্র ও যুব সমাজের আন্দোলন প্রথমদিকে মূলত ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। পর্যায়ক্রমে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখেছে কীভাবে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ একনায়কতন্ত্র, নিপীড়ন, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজপথ এবং সামাজিক-যোগাযোগ মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল।’

‘আমাদের ছাত্রজনতা তাদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছে। তাদের এই সম্মিলিত সংকল্পের মধ্যেই আমাদের দেশের ভবিষ্যত নিহিত, যা এ দেশটিকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মাঝে একটি দায়িত্বশীল জাতির মর্যাদায় উন্নীত করবে বলে আমি বিশ্বাস করি’ বলেন প্রফেসর ইউনূস।

এই গণআন্দোলন রাজনৈতিক অধিকার ও উন্নয়নের সুবিধা বঞ্চিত বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারিত্ব চেয়েছিল। আমাদের জনগণ একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, যার জন্য আমাদের নতুন প্রজন্ম জীবন উৎসর্গ করেছিল।’

ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বীরত্বগাথা তুলে ধরে প্রফেসর ইউনূস আরও বলেন, ‘আমাদের এই তরুণরা যে প্রজ্ঞা, সাহস ও প্রত্যয় দেখিয়েছে তা আমাদের অভিভূত করেছে। বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করেও, বুক পেতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের এই তরুণরা। অবৈধ রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সোচ্চার হয়েছিল আমাদের তরুণীরা। স্কুলপড়ুয়া কিশোর-কিশোরীরা নিঃশঙ্কচিত্তে উৎসর্গ করেছিল তাদের জীবন। শত শত মানুষ চিরতরে হারিয়েছে তাদের দৃষ্টিশক্তি। আমাদের মায়েরা, দিনমজুরেরা ও শহরের অগণিত মানুষ তাদের সন্তানদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমেছিল রাজপথে। তপ্ত রোদ, বৃষ্টি, মৃত্যুভয়কে তোয়াক্কা না করে তারা সত্য ও ন্যায়সঙ্গত আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে দীর্ঘকালব্যাপী রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিচালনা করার অশুভ ষড়যন্ত্রকে পরাভূত করেছিল।’

জুলাই বিপ্লবে শহীদদের স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘জনগণের এই আন্দোলনে আমাদের জানা মতে, প্রায় আটশত-এরও বেশি জীবন আমরা হারিয়েছি স্বৈরাচারী শক্তির হাতে।’

বাংলাদেশি তরুণদের ভূয়সী প্রশংসা করে ডি. ইউনূস আরও বলেন, ‘উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর মানুষের গভীর বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পরে আমাদের ‘‘জেনারেশন জি’’ (প্রজন্ম জি) নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। এরকমটি আমরা দেখেছিলাম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সময়েও।’

(একুশনিউজ/২৭সেপ্টেম্বর/শাশা)

Comments