ইজারার করাল গ্রাসে অস্তিত্ব সংকটে নড়াইলের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার

প্রকাশিত: ১:৩৭ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৯

উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি: ভূমিদস্যুদের লোভের গ্রাসে অস্তিত্ব সংকটে নড়াইলের নড়াগাতী থানার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি প্রায় ১০ বছর ধরে রক্ষায় সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সচেতন মানুষ।

নড়াইলের নড়াগাতি বাজারের পেরিফেরি জায়গা-জমি দেখিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষ নানা সময়ে বিভিন্ন সুবিধাভোগী ভূমিদস্যুদের মাঝে ইজারা দেয়ায় দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে আসছে এ শহীদ মিনারের জায়গা। নামমাত্র কাঠামো সর্বস্ব অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ শহীদ মিনারটি।

একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে বিগত দু’বছর বইমেলাও করতে পারেনি এলাকাবাসী। ভূমিখেকোদের ইজারার করাল গ্রাসে যেকোনো সময় বিলীন হয়ে যেতে পারে মহান শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর এই স্তম্ভটি। শহীদ মিনার রক্ষায় সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধাসহ অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্থানীয় সচেতন মানুষেরা। নড়াইলের নড়াগাতি

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালে নড়াইলের কালিয়া উপজেলা থেকে আলাদা করে নড়াইলের নড়াগাতি থানা ঘোষণা হওয়ার পরে জয়নগর ইউনিয়ন পরিষদের ভবনে কার্যক্রম শুরু হয়। নড়াইলের নড়াগাতি থানা অফিসের সামনে পুলিশের একটি স্যালুট মঞ্চ তৈরি হয়। ২০০৮ সালে থানা ভবন স্থানাস্তরিত হওয়ার পর ওই স্যালুট মঞ্চে স্থানীয় উদীচীর উদ্যোগে শহীদ মিনারটি তৈরি হয়। ধীরে ধীরে স্থানীয় চাঁদায় গড়ে ওঠে নড়াগাতি থানার কেন্দ্রীয় এ শহীদ মিনারটি।

নড়াইলের নড়াগাতি বাজারের সাথে থানা, মুক্তিযোদ্ধা অফিস, আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কার্যালয় ও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একমাত্র শহীদ মিনার এটি। ভাষাদিবস থেকে শুরু করে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বঙ্গবন্ধুর শাহাদাৎবার্ষিকীসহ নানা জাতীয় দিবসে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর এটাই একমাত্র জায়গা অত্র এলাকাবাসির।

জায়গাটি সরকারি খাস জমি হওয়ায় থানাভবন সরে যাবার পর থেকেই স্থানীয় ভূমিখেকোদের নজর ছিলো তা দখলের। আর জায়গা দখলে একমাত্র বাধা হয় শহীদ মিনার। শুরু হয় শহীদ মিনার ধ্বংসের পরিকল্পনা। ২০১৬ সালে উপজেলা প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি শহীদ মিনারের আশপাশে ১৪টি জায়গা ইজারা বন্দোবস্ত নেয়। কয়েক দফা শহীদ মিনার ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা করে তারা। এরপর রাতের আধারে শহীদ মিনার চত্বরে থাকা গাছ কেটে ধীরে ধীরে শহীদ মিনারের চারিদিকে ঘর তুলতে শুরু করে। শুরু থেকেই উপজেলা প্রশাসনের লোকেরা আর্থিক সুবিধা নিয়ে ইজারা প্রদান করছেন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। ২০১৭ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারি এ নিয়ে ‘মিনার ভাঙার ষড়যন্ত্র’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করে জাতীয় দৈনিক ও স্থানীয় পত্রিকায়।

উদীচীর নেতৃবৃন্দ গত ৩ বছর ধরে উপজেলা, জেলা প্রশাসনের কাছে ধর্ণা দিয়েও ইজারা বন্ধ করতে পারেননি। বরং নতুনভাবে গোপনে ইজারা নিয়ে ঘর তুলে শহীদ মিনারে ঢোকার পথ বন্ধ করে দিয়েছে তারা। উদীচী কার্যালয় ভেঙে ফেলতে চেয়েছে সন্ত্রাসীরা। ২০১৮ সালে নড়াইলের জয়নগর ইউপি চেয়ারম্যান এটিকে ইউনিয়ন পরিষদের জায়গা দাবি করে মামলা করলে ওই জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করেন আদালত। ফলে গত দুই বছর ধরে শহীদ দিবসকে কেন্দ্র করে বইমেলা করতে পারেনি এলাকাবাসী।

নড়াইলের নড়াগাতী থানা উদীচী সভাপতি আব্দুস সাত্তার বলেন, আমি কালিয়া ইউএনও, নড়াইলের ডিসি ইমদাদুল হক সাহেবসহ সবার কাছে শহীদ মিনার রক্ষার জন্য ধর্না দিয়েছি। ডিসি সাহেব ভূয়া ইজারাদারদের উচ্ছেদ করতে নির্দেশ দিলেও নড়াইলের কালিয়া ইউএনও তা করেননি। শহীদ মিনার রক্ষার চেয়ে ইজারার ব্যাপারে ওনারা বেশি আগ্রহী। তবে আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও শহীদ মিনারটি রক্ষা করবো।

এলাকাবাসীর অভিযোগ নড়াইলের নড়াগাতি থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহাবুব আলম, জয়নগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি চৌধুরী শওকত, নড়াগাতি থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক লিংকন চৌধুরী, যুবলীগ নেতা কামাল মোল্যা, বাহারুল চৌধুরী, ওয়ার্ড মেম্বর সবুর মোল্যা, যুবনেতা রাসেল শেখসহ নামে-বেনামে প্রায় ১৪ জন নানা প্রভাব খাটিয়ে শহীদ মিনারের জায়গা ইজারা নিয়েছেন।

নড়াইলের জয়নগর ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাজী নওশের আলী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ১০ বছর ধরে আমরা এখানে ফুল দেই। সেই জায়গায় মার্কেট হবে দোকান-পাট হবে, তাহলে আমারা কোথায় গিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবো? জঙ্গলে গিয়ে জানাবো? আমরা চাই সঠিক মর্যাদা দিয়ে এই শহীদ মিনারকে সংস্কার করা হোক।

মুক্তিযোদ্ধা জলিল বিশ্বাস বলেন, নড়াইলের নড়াগাতী থানার লক্ষাধিক মানুষের একমাত্র কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এটি। এখানে আমরা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানসহ শহীদদের স্মরণে ফুল দেই, বই মেলার আয়োজন করি। আর এই যায়গা যদি ইজারার দখলে চলে যায় তাহলে আমরা এই অনুষ্ঠানগুলো কোথায় করবো!

সম্প্রতি শহীদ মিনার এলাকা পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসককে নড়াইলের কালিয়ার ইউএনও একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। যেখানে তিনি শহীদ মিনারটিকে ৩ বছরের এবং অস্থায়ী উল্লেখ করে ইজারার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তিনি ওই প্রতিবেদনে শহীদ মিনারের জন্য কোনো জায়গা বরাদ্দ নাই বলে শহীদ মিনারের স্থাপনাকে দখলকৃত জায়গা উল্লেখ করেছেন। এতে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এলাকার মানুষ।
নড়াইলের নড়াগাতি থানা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইশাবুল আলম জানান, ২০০৮ সালে এই শহীদ মিনারের জন্য এমপি মহোদয় সরকারি অনুদানও দিয়েছিলেন। শহীদ মিনার ধ্বংস করে কিভাবে সরকারি কর্মকর্তরা ইজারা দেয় সেটা আমি বুঝি না। ইজারার লাভ আগে নাকি শহীদ মিনার আগে এনারা তা ভুলে গেছেন।

নড়াইলের নড়াগাতি বাজার কমিটির সভাপতি রুবেল চৌধুরী অভিযোগ করেন, কালিয়ার ইউএনও এখানকার প্রতিটি ইজারার বিনিময়ে দেড় থেকে আড়াই লক্ষ টাকা নিয়েছেন। এখন তারা ওই ইজারাদারদের পক্ষ নিয়ে শহীদ মিনার ধ্বংসের পরিকল্পনা করছেন। শহীদ মিনার থাকলে ওনাদের পকেট তো ভরবে না। তাই শহীদ মিনার থেকে ইজারা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ।

এ ব্যাপারে নড়াইলের কালিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নাজমুল হুদা বলেন, মামলার কারণে ইজারা বন্ধ রয়েছে। আমি কাউকে ইজারা দেইনি। আমার আগের ইউএনও সাহেব দিয়ে গেছেন। শহীদ মিনার রক্ষা না করে জমি ইজারা প্রসঙ্গে নড়াইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কাজী মাহবুবুর রশীদ বলেন, শহীদ মিনার রক্ষা করতে হলে ওই জমির পেরিফেরি পরিবর্তন করতে হবে। নতুবা শহীদ মিনারটি সরাতে হবে। সরেজমিন শহীদ মিনারের অবস্থান দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে। টাকা নিয়ে ইজারার অভিযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিআইজে/

Comments