বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা : বয়স নিয়ে যত জটিলতা নিউজ ডেস্ক নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ৪:০২ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১, ২০২৩ রোজিনা ইসলাম, ঢাকা ময়মনসিংহের ওয়াজউদ্দিন তালিকাভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর জন্মতারিখ ১৯৪৫ সালের ১ জানুয়ারি। ওয়াজউদ্দিনের বড় ভাই শাহাবউদ্দিন। জাতীয় পরিচয়পত্রের তাঁর জন্মতারিখ ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ। স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, তালিকায় নাম তুলতে ওয়াজউদ্দিন তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্রে নিজের বয়স সংশোধন করে বাড়িয়ে নিয়েছেন। এ কারণে ওয়াজউদ্দিনের চেয়ে তাঁর বড় ভাই শাহাবউদ্দিন বয়সে ছোট হয়ে গেছেন। নড়াইলের কালিয়ার এস এম সাজ্জাদ হোসেনের ‘সমস্যা’ ভিন্ন। তাই তিনি মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স কমানোর জন্য আবেদন করেছেন। সাজ্জাদের ভাষ্য, তাঁর বাবা ও চার ভাই গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু সরকার মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স ১২ বছর ৬ মাস নির্ধারণ করায় তিনি সমস্যায় পড়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ১৪ বছরের বেশি ছিল। পরে স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাঁর বয়স কমিয়ে দিয়েছেন। পরিচয়পত্র অনুযায়ী, তাঁর জন্মতারিখ ১৯৫৯ সালের ১৪ জুলাই। সে হিসাবে মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়সের চেয়ে তাঁর বয়স প্রায় এক বছর কম। এ কারণে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর সম্মানী ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই তিনি মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স কমানোর পক্ষে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সুপারিশ অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স ১২ বছর ৬ মাস নির্ধারণ করে ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি সংশোধিত পরিপত্র জারি করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর যেসব মুক্তিযোদ্ধার বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস ছিল, তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। জামুকার সবশেষ আটটি বৈঠকের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে বয়সসংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে অনেক আবেদন জমা পড়েছে। বিশেষ বিবেচনায় অনেকের বয়স প্রমার্জনের সুপারিশও করা হয়েছে। যেমন নেত্রকোনার কলমাকান্দার নূর হোসেন আকন্দের জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্মতারিখ ১৯৫৯ সালের ১১ ডিসেম্বর। জামুকার ৭৫তম বৈঠকে তাঁর নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তুলতে সুপারিশ করা হয়। তবে বয়সসংক্রান্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জামুকার ৮২তম বৈঠকে বিষয়টি পরীক্ষা করতে বলা হয়। নূর হোসেন আকন্দের দাবি, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। এ বিষয়ে তাঁর কাছে প্রমাণও আছে। জয়পুরহাটের বেলাল হোসেনের মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করা হয়েছিল। পরে জামুকার ৮৬তম বৈঠকে তাঁর নামের গেজেট পুনর্বহালসহ তাঁকে আবার সম্মানী ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বেলাল ইতিমধ্যে মারা গেছেন। তাঁর স্ত্রী রহমত আরা প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁর স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। জন্মসনদে তাঁর বয়স ঠিক ছিল। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্মতারিখ ভুল দেওয়া হয়েছিল। জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর বয়স সাড়ে ১২ বছরের কম হওয়ায় ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরে ভাতা চালুর জন্য আবেদন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকেরা বলছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম তোলার ক্ষেত্রে বয়সসংক্রান্ত বিষয়ে প্রায় একই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আবেদনকারীরা দাবি করছেন, মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁদের প্রকৃত বয়স বেশি ছিল। কিন্তু পরে বিদ্যালয় বা অন্য নথিতে বয়স কমিয়ে দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২ বছরেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে না পারাটা একটা ব্যর্থতা। এ বিষয়ে জামুকার সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বয়স নিয়ে অনেক ঝামেলা চলছে। আমরা নির্ধারণ করেছি, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় গেজেটভুক্ত হতে হলে ন্যূনতম বয়স হতে হবে সাড়ে ১২ বছর। কিন্তু অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তবে নথিতে বয়স কম দেখানো আছে। তাই প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা করতেই হয়।’ বয়স নিয়ে যত জটিলতা জামুকার ৭৪তম বৈঠকে নাটোরের সিংড়ার দাউদার রহমানকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তের সুপারিশ করা হয়। পরে মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার সমন্বিত তালিকায় (তৃতীয় পর্ব) তাঁর নাম গেজেটভুক্ত হয়। দাউদারের বিরুদ্ধে বয়স জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। তদন্তে দেখা যায়, দাউদারের আবেদন উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি নামঞ্জুর করে পাঠিয়েছিল। তা সত্ত্বেও তাঁর নাম গেজেটভুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ২০২০ সালের অক্টোবরে মন্ত্রণালয় দুই হাজার জনের তথ্য পায়, যাঁদের বয়স নিয়ে ঝামেলা রয়েছে। নথি অনুযায়ী, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁদের বয়স ৮ থেকে ১০ বছর ছিল। আবার কারও জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পরে। এমনটা ভুলে হয়েছে, নাকি অনিয়ম-জালিয়াতি করে তাঁদের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ঢোকানো হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, জন্মসনদসহ বিভিন্ন নথির ভিত্তিতেই জাতীয় পরিচয়পত্র হয়। অনেকে নিজেদের প্রয়োজনমতো বয়স কমান বা বাড়ান। এখন যদি জাতীয় পরিচয়পত্রকে মানদণ্ড ধরা হয়, তাহলে অনেকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ঢুকে পড়বেন, আবার অনেকে বাদ পড়বেন। বয়স প্রমার্জনের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্রে যদি কারও বয়স ভুল লেখা হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করতে পারেন যে তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, তাহলে আমরা বয়স প্রমার্জনের সুপারিশ করি। তবে সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে ন্যূনতম বয়স সাড়ে ১২ বছর হতে হবে।’ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালে একটি পরিপত্র প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স হতে হবে ১৩ বছর। ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি মন্ত্রণালয় সংশোধিত পরিপত্র জারি করে। সংশোধিত পরিপত্রে ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস নির্ধারণ করা হয়। সংশোধিত পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে বেশ কয়েকজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হাইকোর্টে রিট করেন। ২০১৯ সালের ১৯ মে সংশোধিত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না।’ হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনটি আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। শরীয়তপুরের নড়িয়ার বাদশা মিয়ার গেজেট বাতিল করা হয় ২০১৩ সালের জুন মাসে। তবে উপজেলা কমিটির যাচাই-বাছাইয়ের পর তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। ১০ বছর পর ২০২৩ সালে জামুকার ৮৬তম বৈঠকে তাঁর গেজেট পুনর্বহাল ও সম্মানী ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। খাগড়াছড়ির বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসেম মোল্লা বার্ধক্যের কারণে উপজেলা কমিটির যাচাই-বাছাইয়ে উপস্থিত হতে পারেননি। তাই তাঁর গেজেট ও সম্মানী ভাতা বাতিল করা হয়। তবে জামুকার ৮৬তম বৈঠকে তাঁর গেজেট ও সম্মানী ভাতা আবার চালুর সিদ্ধান্ত হয়। অভিযোগের ভিত্তিতে টাঙ্গাইলের বীর মুক্তিযোদ্ধা এন এম শাহনেওয়াজের গেজেট বাতিল করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে তাঁর গেজেট পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নেয় জামুকা। জামুকার সবশেষ আটটি বৈঠকের তথ্য অনুযায়ী, একইভাবে এক হাজারের বেশি মুক্তিযোদ্ধার গেজেট পুনর্বহাল করা হয়েছে। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার দেলোয়ার হোসেন মুক্তিযোদ্ধা নন বলে অভিযোগ ওঠে। অভিযোগটি করেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও নবাবগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান। পরে অভিযোগের তদন্ত হয়। শুনানিতে উপস্থিত হননি দেলোয়ার। নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণে তিনি কোনো দালিলিক সনদ উপস্থাপনেও ব্যর্থ হন। দিনাজপুর জেলা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মোকসেদুর রহমান বলেন, দেলোয়ারের বাবা আফতাব উদ্দিন মহান মুক্তিযুদ্ধকালে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণও করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম বলেন, ‘অনিয়মের মাধ্যমে কারো নাম তালিকায় ঢুকেছে কি না, তা তদন্তের আগে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না। তবে কেউ অনিয়ম করে থাকলে তাঁর নাম বাদ যাবে। তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ একটি প্রথম আলোর প্রতিবেদন। Comments SHARES জাতীয় বিষয়: মুক্তিযোদ্ধা তালিকা