মোবাইল ইন্টারনেটের দাম কেন লাগামহীন? শাহনূর শাহীন শাহনূর শাহীন লেখক ও মনোস্বাস্থ্য সাংবাদিক প্রকাশিত: ৭:৩৫ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৩, ২০২৩ মোবাইল ইন্টারনেটের দাম নিয়ে গ্রাহকের ভোগান্তি আর আক্ষেপের শেষ নেই। সরকার, প্রশাসন, কর্তৃপক্ষ এমনকি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর ক্ষোভ প্রকাশেও অপারেটরদের গা-ছাড়া ভাব লক্ষ্য করা যায় প্রায় সময়। বাংলাদেশে টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানীগুলোর গলাকাটা ব্যবসায়িক দৌরাত্যে রীতিমতো অতিষ্ঠ গ্রাহকরা। সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) মোবাইল ইন্টারনেট সেবাদাতা কোম্পানীগুলোকে ডাটাপ্যাকের মেয়াদ সর্বনিম্ন ৭ দিন করে প্যাকেজের সংখ্যা কমানোর নির্দেশনা দেয়। অপারেটরগুলো শুরু থেকেই এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে। এটা করতে গিয়ে দাম বাড়ানোর হুমকিও দেয় তারা। এমনকি শেষ পর্যন্ত তারা তাই করে। এক লাফে ইন্টারনেটের দাম বেড়ে যায় ৩০ শতাংশ। এরপর এ নিয়ে ফের ক্ষোভ প্রকাশ করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। গত ৫ নভেম্বর টেলিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বিটিআরসির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পুনরায় দাম কমানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। সময় বেঁধে দেওয়া হয় ১০ নভেম্বর পর্যন্ত। মোবাইল অপারেটরগুলো ইন্টারনেটের দাম কমাতে গড়িমসি করলেও মন্ত্রীর কঠোর অবস্থানের কারণে শুক্রবার রাত ১২টার পর থেকে বর্ধিত দাম প্রত্যারপূর্বক বিভিন্ন প্যাকেজের আগের দামে ফিরে গেছে। অর্থাৎ সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী ৩ ও ১৫ দিন মেয়াদি প্যাকেজ বাদ দিয়ে সর্বনিম্ন ৭ ও সর্বোচ্চ ৩০ দিনের প্যাকেজ নির্ধারণ করা হয় যাতে তৎকালীন ডাকা প্যাকের দামে কোনো পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ তিনদিনের প্যাকেজ একই দামে ৭ দিন মেয়াদে দিতে হবে মর্মে নির্দেশনা প্যাকেজের সংখ্যা কমানোর সময়ই দিয়েছিলো বিটিআরসি। কিন্তু প্রথমবার এটা আমলে নেয়নি কোম্পানীগুলো। এ বিষয়ে জানতে বিটিআরসির একজন পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি নিজ দায়িত্বের বাইরের বিষয় উল্লেখ করে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। টেলিটক এর ‘গ্রামীণ এলাকায় নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও ৫জি পরিষেবা’ প্রকল্পের পরিচালক মো. খায়রুল হাসান বলেন, ‘‘আমাদের এই প্রকল্পের মালামাল চলে এসেছে। খুব শীঘ্রই এগুলো ইনস্টল হবে। আশা করি ডিসেম্বর নাগাদ একটা পরিবর্তন দেখতে পাবেন’’। টেলিটকের ইন্টারনেট এবং বান্ডেল প্যাকগুলোর সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে বেসরকারি সেবাদাতা কোম্পানীগুলোর প্যাকেজ রেট ৪৫-৫০ শতাংশ বেশি। সাধারণত যেকোনো পণ্য একসঙ্গে বেশি পরিমাণে ক্রয় করলে তার দাম কমে আসে। সেই হিসেবে টেলিটকের ৪০ জিবি ও ৮০০ মিনিটের প্যাকটি কিনতে গ্রাহকের খরচ পড়ে মাত্র ৫৪৮ টাকা। যেখানে বর্তমান বাজার রেটের তুলনায় সর্বনিম্ন ৬০ পয়সা মিনিট ধরা হলেও প্রতি ১ জিবি ইন্টারনেটের দাম পড়ে মাত্র ১ টাকা ৭০ পয়সা। বিপরীতে বেসরকারি টেলিকোম্পানী গ্রামীণ ফোনের ৩০ জিবি ও ৭০০ মিনিটের প্যাকটি কিনতেই গ্রাহককে গুনতে হচ্ছে ৭৯৯ টাকা। যা টেলিটকের তুলনায় ৪৫ শতাংশেরও বেশি। সরকারি মালিকানাধীন হওয়ায় নেটওয়ার্ক বিস্তারে কোথায় কোথায়ও বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে টেলিটক। সেকারণে কম খরচে গ্রাহকদের সেবা দেওয়ার অনেক বেশি সক্ষমতা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। তাছাড়া নেই অতি মুনাফার প্রবনতাও। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেটওয়ার্ক স্বল্পতার কারণে গ্রাহকরা এই সুবিধা নিতে পারছে না। এর পেছনে কারণ কী জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির সিস্টেম অপারেশন বিভাগের কর্মকর্তা (পরিচালক), সন্দীপ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সারাদেশের টেলিটকের নেটওয়ার্ক স্টেশন (টাওয়ার) রয়েছে মাত্র ৫ হাজার। যেটা অন্যান্য বেসরকারি কোম্পানীর তুলনায় খুবই নগন্য- যা সর্বনিম্ন হিসেবে এক পঞ্চমাংশ। আমরা চেষ্টা করতেছি এটাকে সন্তোষজনক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। বর্তমানে আমাদের একটা প্রজেক্ট চলমান আছে। আমি ঠিক ডিসেম্বর বলবো না, তবে আশা করি পরবর্তী ছ’মাসের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন আসবে। তবে সেটাও অন্যান্য অপারেটরদের তুলনায় সামান্যই। এরপরও আমাদের আরো কিছু প্রজেক্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেগুলো প্রোপার ইনভেস্টমেন্ট পেলে এবং বাস্তবায়ন হলে আশা করি একটা সক্ষমতার জায়গায় পৌঁছাতে পারবো। তখন সেটা গ্রাহককে স্বস্তি দিতে পারবে’’। সন্দীপ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমরা সিস্টেম থেকে প্রতিনিয়তই বলি। চাহিদাপত্র দেই। কেননা, আমরা সিস্টেমে যতই উন্নতি করি না কেন- প্রয়োজনীয় স্টেশন না থাকলে কোনোভাবেই সবত্র নেটওয়ার্ক পৌঁছানো সম্ভব হবে না’’। বাংলাদেশে গ্রামীণফোন ব্যবসা শুরু করে ১৯৯৭ সালে অন্যদিকে বাংলালিংক ১৯৯৯ সালে। অন্যান্য অপারেটরের তুলনায় বাংলালিংকের সর্বনিম্ন ৫০ হাজার নেটওয়ার্ক স্টেশন আছে। বিপরীতে প্রায় কাছাকাছি সময়ে ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করেও টেলিটক কেন এত পিছিয়ে? এর পেছনে বেসরকারি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একচেটিয়া স্বার্থ রক্ষার কারণ রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে ‘বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন’ এর সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘টেলিটকের যারা উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তারা সবাই সরকারি কর্মকর্তা। কাজের ক্ষেত্রে তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। গ্রাহক সন্তোষ্ট হলো কি হলো না, সে বিষয়ে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। গ্রাহক সেবার কোনো ইচ্ছাই তাদের নেই। সরকারি চাকরি করছে, বেতন পাচ্ছে, সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। অনিয়মে অভিযুক্ত হলে বড়জোর অন্য কোথাও বদলি হচ্ছে। এই কারণে তাদের কাজে কোনো পেশাদারিত্ব নেই। মূলত যেই উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার টেলিটক প্রতিষ্ঠা করেছিলো জবাবদিহিতার অভাবে সেটার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। টেলিটক যদি নেটওয়ার্ক বিস্তারে সক্ষমতা রাখতে পারতো তাহলে অন্তত একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরী হতো। এটা না হওয়ায় বেসরকারি কোম্পানীগুলো একচেটিয়া ব্যবসা করার সুযোগ পাচ্ছে’’। সাতদিন মেয়াদে গ্রামীণফোনের সর্বনিম্ন ১ জিবি ইন্টারনেটের দাম ৪৮ টাকা। একই মেয়াদে ২ জিবি’র দাম ৬৯ টাকা। রবি-এয়ারটেলেরও একই চিত্র। সাধারণত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই ২ জিবি ইন্টারনেট দুইদিন ব্যবহার করতে পারেন না। তার আগেই শেষ হয়ে যায়। অথচ উচ্চ মূল্যস্ফিতির এই সময়েও সমমূল্যের চাল কিনলে একজন মানুষ অনায়াসেই দুইদিন চালিয়ে নিতে পারবেন। এই অবস্থায় সর্বশেষ নির্দেশিত ঘোষণা অনুযায়ী মোবাইল অপারেটরগুলোর ঘোষিত সমন্বিত মূল্য তালিকাও যৌক্তিক কিনা এমন প্রশ্নে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘অবশ্যই না। প্রতিযোগিতামূলক বাজার না থাকায় কোম্পানীগুলো ইচ্ছে মতো দাম নির্ধারণ করছে। প্রতিনিয়ত গ্রাহক ঠকাচ্ছে। এমনকি কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই। এর দায় শুধু ওই কোম্পানী বা টেলিটকের না। বিটিআরসিরও দায় রয়েছে। কোম্পানীগুলো চাইলেই কিন্তু একটা প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারে না। প্যাকেজের অনুমোদন লাগে। বিটিআরসি কেন এই অযৌক্তিক মূল্যের অনুমোদন দিয়ে আসছে, এই দায় তারা এড়াতে পারবে না। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি যে, মোবাইল সেবা কোম্পানীর সকল সেবার দাম পুনর্নির্ধারণ করা হোক। এবং সেক্ষেত্রে গ্রাহক প্রতিনিধিসহ অন্যান্য অংশীজনদের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা হবে না’’। /একুশনিউজ/এসএস/ Comments SHARES বিশেষ প্রতিবেদন বিষয়: টেলিটকমোবাইল ইন্টারনেটের দাম কেন লাগামহীন?শাহনূর শাহীন